শনিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৫

আমার স্কুল জীবনের ১ম প্রেমপত্রের জবাব [চলার পথের গল্প # ৬৬]

আমার স্কুল জীবনের ১ম প্রেমপত্রের জবাব
==========================
হিন্দু ধর্মধারী সুমি আর আমি ১ম থেকে ৯ম শ্রেণি পর্যন্ত একসাথে পড়েছি একই স্কুলে একই ক্লাসে। ওর বাপ-দাদা পুরুষাণুক্রমে ঢাক বাজাতো, তাই ঢাকী বলা হতো ওদের পরিবারকে। আমাদের বাড়ির সামান্য পুবে ঠিক নদীর তীরে ছিল সুমিদের বাড়ি। আমি প্রায়ই হাফপ্যান্ট খুলে সুমির ঘরে রেখে নদীতে ঝাপ দিতাম। সুমি আমার প্যান্ট হাতে দাঁড়িয়ে থাকতো নদীতীরে। আমরা ৩/৪-জনে একসাথে স্কুলে যেতাম দলবেঁধে। বর্ষার জলকাদাতে সুমিকে অনেকবার হাত ধরে বাঁশের সাঁকো পার করিয়েছি আমি। কিশোর স্বৈরাচারি আমার কথা না মানাতে দুয়েকবার মেরেছিও তাকে খুব। একবার আমার মার কাছে নালিশ করেছিল সুমি, ওরা গরিব বলে আমি নাকি প্রায়ই মারি তাকে। কেঁদেছিল সে খুব মার আঁচল ধরে। আর কোনদিন মারিনি সুমিকে। সেই থেকে সুমির জন্য পাগল ছিলাম আমি। রাস্তায় প্রায়ই তাকে চিমটি দিতাম কখনো ভালবেসে, কখনো খ্যাপাতে। ক্লাস এইটে উঠেই বন্ধুর সহায়তায় প্রেমপত্র লিখে সুমির হাতে গুজে দেই একদিন। কিন্তু সে দুতিনদিনেও ফেরতপ্রেমপত্র না দেয়াতে আবার ক্ষেপি তার উপর। রাস্তায় একাকি পেয়ে চেপে ধরে বলি গ্রাম্য দৃঢ়তায়, 'কেন প্রেম করবি না আমার সাথে বল'? চোখ ভিজিয়ে আর গলা কাঁপিয়ে সুমি বলে, আমরা হিন্দু, ঢাকি আর খুব গরিব। তোমার সাথে প্রেম করলে কখনো বিয়ে হবেনা আমাদের। তোমার ধনী মুসলিম পরিবার মারবে আমার মা-বাবাকে। তাই ভয়ে জবাব দেইনি চিঠির। কিন্তু 'লাভ ইউ'। সুমির 'লাভ ইউ' শুনে মনের অলিন্দ ছুঁয়ে সুন্দরের অলিক তন্দ্রা ভেঙে জেগে উঠি আমি মেঘনা তীরে। সারাদিন নদীতে সাঁতার কাটতে থাকি 'লাভ ইউ'র রোমান্সে! পকেট খালি করে প্রেমপত্রে সহায়তাকারী বন্ধুকে বাজারে "চান বিস্কুট" আর "স্টার সিগারেট" কিনে দুজনে স্টিমারের মত ধোয়া ছাড়তে থাকি স্কুলের মাঠে দুজনে প্রেম পাওয়ার আনন্দে। 
:
৯ম শ্রেণিতে ওঠার কিছুদিনের মধ্যে খবর আসে এক জেলে তরুণের সাথে বিয়ে হচ্ছে সুমির। কাঁদতে কাঁদতে মাকে বলি, 'মা সুমিকে বিয়ে করবো আমি'। হাসতে হাসতে মা গড়াগড়ি যায় মাটিতে। রাগে মার কাপড় টানতে টানতে খুলে ফেলি আমি। বড়বোন এসে থাপ্পর দেয় গালে জোরে আমায়। রাগে ঘাসকাটা বড় দা হাতে নেই সুমির বাবাকে কোঁপাতে। দুপুরের খোলা ঘরে ঢাকীকে না পেয়ে তার দুটো 'ঢাক' ভেঙে ফিরে আসি নিজ ঘরে বীরদর্পে। সিনেমাপাগল আমাকে নিয়ে মা শহরে যায় সিনেমার লোভ দেখিয়ে। মন ভরে সিনেমা দেখে, নতুন জামা কিনে, নানাবাড়ি বেড়ানো শেষ করে, যখন ফিরে আসি গাঁয়ে, সুমি ঢাকী তখন ইলিশ ধরা কুচকুচে কালো দক্ষ জেলে গোপাল জলদাসের স্ত্রী সুমি জলদাস।
:
একবার ইচ্ছে হলো গোপালের নৌকা ফুটো করে রাতে মেঘনাতে ভাসিয়ে দিই সাহসি রাজপুত্রের মতো। কিন্তু ভয়ে তা না করে জালগুলো কেটে দিলাম এক রাতে ধারালো ব্লেড কিনে রাগে। মনে আছে মা নতুন জাল কিনে দিয়েছিল গোপাল জলদাসকে। নদী তীরে গেলে সুমি দৌঁড়ে চলে যেতো ঘরে তার, হয়তো ভয়ে কিংবা ভালবাসায় জানিনা আমি। একসময় এ ভালবাসা বিরক্তি, শেষে ঘৃণায় পরিণত হলো আমার। এসএসসি পাস করে শহুরে হলাম আমি। ঢাবিতে পড়া শেষ করে বিদেশ চলে যাই। তারপর জীবন কবিতার কত পাতা ওল্টালাম। দারুচিনি লবঙ্গি বনের ঘ্রাণতায় কত দেশ ঘুরলাম! কত মানুষ দেখলাম! নুতন প্রেমে পড়লাম, নতুন কষ্টের দহনে সুমি ঢাকির স্মৃতি ধুসর করে দিলো জীবন থেকে। বছর কুড়ি আ্গে নদীগ্রাসে ভেঙে গেলো আমাদের বাড়ি, সুমিদের বাড়ি, আমার অন্য সব স্বজনদের বাড়ি। সব পরিচিত স্বজনরা কে কেোথায় নতুন বাস্তুতে গেল সব জানিনা আমি। ঢাকায় অভিজাত এলাকার বাসিন্দা হিসেবে আর খোঁজ নিতে পারিনি গরিব স্বজনদের। সুমি জলদাস দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখে আছে জলদাস জেলেনি হিসেবে, এটাই কেবল জানতাম বন্ধুদের কাছ থেকে। 
:
ফিলিপিনে ১৫-দিনের ম্যানেজমেন্ট কোর্সে অংশ নিতে লিস্টে নাম এসেছে আমার একটা গ্রুপের সাথে। তার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম ভিসা-টিকেট প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন জিও এসবের। হঠাৎ গাঁ থেকে ফোন এলো স্কুলের প্রাক্তন বন্ধু রফিকের। সুমি জলদাস মৃতপ্রায়। থাকে নতুন জেগে ওঠা চর আরেক কেতুপুরে। আমাকে দেখতে চায় সে মৃত্যুর আগে। ছুটি না নিয়েই রাতের লঞ্চে উঠে পড়লাম সুমির নতুন চরে যেতে। ঢাকা থেকে রাঙাবালির দ্বিতল লঞ্চ, যা ঐ চরে স্টপেজ দেয় ভোরের দিকে।
:
জুতো খুলে প্যান্ট গুটিয়ে জলচরে নামলাম আমি আরো অনেক চরজীবি মানুষের সাথে লঞ্চ থেকে। বন্ধু রফিক নৌকো নিয়ে অপেক্ষা করছে আমার জন্য। চারদিকে অথৈ মেঘনার ঘোলা জল। মাঝে মাঝে কেবল মাথা তোলা জেলে কৃষকদের বাড়িগুলো। উজান থেকে আসা জোয়ারের অযাচিত জল পুরো চরকে মিনি সমুদ্রে পরিণত করে রেখেছে। সূর্য ওঠার সাথেই আমরা নৌকো ভেড়ালাম একদম সুমি জলদাসের কাচা ঘরের ভিটির সাথেই। 
: 
শন-খড়ের ছাউনি আর হোগলা পাতার বেড়া দেয়া সুমি জলদাসের ঘর। চারদিকে খোলা কেবল বেশ কটি কলা আর মাদার গাছ লাগানো। এক চিলতে উঠোন, যা ঘিরে রেখেছে চরের নল খাগড়া জাতীয় তৃণঘাস। তার মাঝে সুপোরি গাছের হাতে বানানো খাটে শুয়ে আছে ঝরা বকুলের চাঁদর গায়ে সুমি নামের মাঝ বয়সি এক নারী। সেবা করছে তার কিশোরি মেয়েটি পাশে বসে। অনেক বছর পর দু:খের কফি রঙের ফিঙে পাখির মতো দেখলাম সুমিকে। বনস্পতির সুষমায় নিটোল ভরাট শরীরের অষ্টম শ্রেণির সুমির বদলে, এক ক্ষয়িষ্ণু ধুসরতার জীবন বয়ে জল চাতকের প্রতীক্ষায় মুখ তুলে চাইলো সুমি আমার দিকে। মেঘরাজ্যের আনন্দ বৃষ্টির দেবতার মতো সাহস দিয়ে সুমিকে বললাম, 'কেন এতোদিন জানাওনি আমায়? এতো ঘৃণা কেন পুষলে তুমি এতো বছর? ঢাকায় কিংবা ভারতে চিকিৎসা করাতে কেন দিলে না আমায় তুমি'? কিছুই বললো না সুমি, গর্ভিণী ধৃত মৃতপ্রায় মাছের ঘোলাটে চোখের মত কেবল তাকিয়ে রইলো আমার মুখের দিকে। দহনের জলচর মাঝে সজাগ হয়ে এবার হাত ধরলাম সুমির। অর্ধোস্ফূট সত্যের মুখোমুখি হয়ে সুমি কেবল চোখ ঝড়ালো ক্রমাগত। আমি বুকের কষ্টকে আটকে বৃদ্ধ ধ্যানী জারুল গাছের মত প্রজ্ঞাময়তায় বলি, 'তোমার চিকিৎসার কাগজপত্র সব দেখি'? বন্ধু রফিক আর কিশোরি সুতপা বিছানার নিচ থেকে পুরণো সব কাগজপত্র বের করে। কিশোর ছেলে আর স্বামী সাগরে গেছে মাছ ধরতে দিন পনেরো আগে, কোন খোঁজ নেই তাদের। কিশোরি মেয়েটিই মুখে জল দিচ্ছে, দেখভাল করছে শূন্য একাকি ঘরে মা সুমিকে। মৃতলোকের প্রত্নঘোরের দরজায় দাঁড়ানো সুমির কাগজপত্র নিয়ে নৌকোযোগে যাত্রা করি শহরের পথে। প্লান, পরিচিত এক ডাক্তারের সাথে কথা বলবো আগে, তারপর দেখি সে কি বলে? 
:
কোন সুখ কিংবা আশার কথা বললো না ডাক্তার বন্ধু। ব্লাড ক্যান্সারের শেষ পর্যায় সুমির। রক্ত দেয়া দরকার ছিল মাঝে মাঝে কিংবা বোনমেরু ট্রান্সফার। যা করতে পারেনি সুমি জলদাসের পরিবার।এ খারাপ খবর বয়ে শহর থেকে ছোট লঞ্চে ফিরতে বিকেল হলো আমার। ভাটার টানে জল নেমে গেছে, তাই ভেজা শুকনো ডাঙায় নামলাম লঞ্চ থেকে। ঘাটে দাঁড়ানো বন্ধু রফিক চোখ মুছে বললো, একটু আগে মারা গেছে সুমি। সুতপা মেয়েটি কাঁদছে একাকি। এখানে হিন্দু পরিবার আর নেই, সব ভারত চলে গেছে পরিজায়ী পাখি হয়ে। কি করবো আমরা? স্বামী ছেলেও সাগরে। তাদের কোন মোবাইলও নেই যে খবর দেব।
:
স্কুল সময়ের পুরণো জীবন সন্তরণে অপূর্ণতার আঁধার ঘরে দাঁড়াই সুমির লাশের পাশে। মার মৃত জীবনের কষ্টকর বাতি হাতে সুতপা মেয়েটি জড়িয়ে ধরে আমায়। রফিক আর আগত প্রতিবেশিরা বলে, মারা যাওয়ার প্রাকমূহূর্তে কথা বলেছিল সুমি, মেয়েটিকে যেন দেখি আমি এ অনুরোধ করেছিল সে। ইঞ্জিনচালিত নৌকো পাঠিয়ে পাশের গাঁ থেকে হিন্দু জেলেদের ডেকে আনি সুমির শেষ কৃত্যানুষ্ঠানে। সব আনুষ্ঠানিকতা করাই পাশের সব মানুষদের ডেকে। ভরা দশমীর শরমী চাঁদের মত সুমির দিকে তাকিয়ে ইচ্ছে করে ওর কপালে শেষ সিঁদুর পরাই আমি। কিন্তু অধীর হিংসায় মহাকম্প ভয়ের ধর্ম জননী হাত চেপে রাখে আমার। সুমিকে যখন চিতায় তোলে সবাই হরিনাম জপে, কান্নার নিশুতি হাওয়ায় চরের বৃক্ষ আর ঘাসফুলেরা ঘুরতে থাকে চারদিকে আমার। সুপান্থের জালে আটকে পরা ইলিশের মত, সপ্তরঙা নগ্ন দু:খরা ভেসে বেড়ায় মেঘনার ঘোলা জলে। বৃহন্নলা অশ্বথ গাছ হয়ে আমি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি সুমির দিকে চোখ রেখে। এ কাকদ্বীপের গুবরে শালিকেরা আষাঢ়ের জলবন্দী গেরস্থের ঘরে কাঁদে সুমি আর তার কন্যা সুতপার দু:খে। 
:
জীবন বেহালার বারোয়ারি মানব জমিনের করুণ ধ্বনিতে চিতায় আগুন দেয় হিন্দু জেলে জলদাসরা। গোধূলির প্রাকসন্ধ্যায় ব্যথাতুর ঘুঘু ডাকা সময়ে আমার চোখের সামনেই জ্বলতে থাকে, আমার প্রথম প্রেমপত্র গ্রহণকারী সুমির শীর্ণকায় দেহ। জ্বলতে থাকা আগুনে নিঃশব্দ লিপ্তির বিষাদে মন কাঁদতে থাকে আমার। হাটুভাঙা কষ্টের কান্না দমাতে আমি ৮-বছরের সুতপাকে নিয়ে ৭-টা চক্র দেই জ্বলন্ত চিতার চারদিকে। ক্ষীয়মান নক্ষত্রের কান্নার মতো সুমির দেহ এক সময় লিন হয় বাতাস আর অগ্নিদহনে। জীবন নাচনের বায়বীয় সুড়ঙ্গে ঢুকে আমি সুতপাকে নিয়ে নামি মেঘনার ঘোলাজলে। যেখানে ফেলা হয়েছে সুমির দেহজ ভস্ম। মৌলিকতার দুঃখবোধসমগ্র ধুয়ে দিতে, ডুব দিতে থাকি আমি ক্রমাগত সুতপার হাত ধরে। পৃথিবীর সকল ভোগবাদি জ্যামিতির হিসেব ফেলে আমি শ্বাশত গাংচিলের ডানায় উড়তে থাকি তখন। জীবনের গভীরে থাকা রুদ্ধ ঘ্রাণ এবার বেড়িয়ে আসে কান্নার জলতলে। 
:
অন্ধকার রাতে চোখ ঝলসানো সপ্তরঙা সার্চলাইট ফেলে ঢাকাগামি লঞ্চ থামে সুমির গাঁয়ে। আমার জ্বলন্ত মেটামরফসিস জীবন ট্রাকে সুতপা জলদাসকে নিয়ে পা রাখি লঞ্চের সিঁড়িতে। অন্ধকার রাতের মেঘনার জলত্রাসের অনাগত রুপকথার মাঝেও সুতপার হাত ধরে আমি দেখতে পাই, আগামির আনন্দময়তার প্রসন্ন তারারা হাসছে আকাশে। জীবনের শুকনো পাতারা কান্না ছেড়ে স্বশব্দে বের করছে তাদের নতুন কুঁড়ি। ঘোর রাত্রির মেঘনার জনকল্লোলে স্বচ্ছতায় দেখতে পাই আমি সুমিকে চিঠি হাতে। আমার জীবনের বুকপকেটে ৮ম শ্রেণি থেকে রক্ষিত ছিন্নতর শ্বাশত প্রেমপত্রের জবাব নিয়ে সুমি হাত জাগিয়ে জলমাঝে এবার। দুর্বোধ্য কবিতার অনন্য বোধের মত সুমি বলছে তার ফেরত চিঠিতে, আমার কন্যা সুতপাকে দেখো রেখো তুমি। ওতো তোমারই প্রথম প্রেমের সন্তান। তাকে দিয়ে গেলাম তোমার হাতে।




'জলাঙ্গি' মানব হয়েও 'জলদাস' কেন হইনি আমি ! [চলার পথের গল্প # ৬৫]

আমার দলিত জীবন দহন : ১
-----------------------------
'জলাঙ্গি' মানব হয়েও 'জলদাস' কেন হইনি আমি !
==============================
কৈশোরে আমার বাড়ির চারদিকে অনেক কুচকুচে কালো হিন্দু জেলে বাস করতো, যাদের 'জলদাস' বলতো সবাই। ঐ জেলেদের মাঝে শীতগাঁয়ের পরিচিত রোদের মুগ্ধতা মেখে চকচকে জলজীবনে বড় হয়েছি আমি। আনন্দের বোধেভরা জলকেন্দ্রিক এক অনন্য জীবন ছিল আমার। সুন্দরের পেয়ালায় জলচুমুতে দিনের ৩/৪-ঘন্টাই জলে কাটাতাম আমি। যে মাটির ঘ্রাণে বড় হয়েছি আমি, তাতে দক্ষ কৃষক কিংবা ঝড়ঝঞ্চার পেশিবহুল হাড়কালো জেলে হওয়ার কথা ছিল আমার। শ্যামলা ফিঙে রঙা আ্মি অল্পদিনেই নৌকো জীবনে পরিপূর্ণ তামাটে 'জলদাসে' পরিণত হতাম। কিন্তু মেধাবি মা আমায় 'জলদাস' হতে দিলো না; সুমির প্রেমিক হতে দিলোনা; সুতপার জনক হতে দিলোনা। অধিবিদ্যাা, নীতিবিদ্যা, তর্কবিদ্যা, ধর্মবিদ্যা, দর্শনবিদ্যা, মানববিদ্যা, মানবিকতাবিদ্যা ইত্যাকার নানাবর্ণীয় বিদ্যাগুলো শেখাতে জলমগ্ন জীবন থেকে নিয়ে এ্লো 'বিদ্যানগর' ঢাকাতে আমায়। নানা শাস্ত্রে বিদ্যাধারী হয়ে, শ্যামলে ফিঙে রঙ ছেড়ে উজ্জ্বল রঙা চাকুরি নামক দাসত্বের শৃঙ্খল গলায় পড়লাম আমি। সাথে যুক্তি, বিজ্ঞান, মুক্তি আর বোধের দু:খাতুর আত্মমৈথুনের সুখ-স্বপ্ন আঁকড়ে ধরলো আমায় অষ্টমার্গে। মাঝে সাঝে গাঁয়ে যেতাম যখন, গাঁয়ের কাপাসতুলোয় বোনা জীবনের ঘামগন্ধের অভীপ্সা জাগতো আমার মনে। ইচ্ছে হতো আশালতা সূর্যেকে সারথি করে দূর সমুদ্রে ভেসে যাই মাছ শিকারে; নেশাতুর বেসামাল বিটপের মত অঘোরে ঘুমোবো তামারঙা বুকখোলা জলদাসি নারীসঙ্গে হোগলা চাটাইয়ে। ভালবাসার বুদবুদ ঝড়োবাতাসে আপ্লুত জীবনের গান শোনাবে আমার সহ-জলদাসরা। মেঘনার জলরাক্ষস থেকে ছিনিয়ে আনবো যৌবনাশ্রুর ডুবন্ত জেলে নৌকো। বর্ষার ঘুর্ণিপাকে জলাঙ্গি প্রপাতে ধরবো ধাববান ইলিশ। আর ধীবর রমণিকুলের দেহজ অঙ্গের আভরণে খুঁজবো জীবনের সুখস্বপ্নের অন্নজল। অবসরে ক্লান্ত জীবনের গায়েন-বায়েন আর পটুয়া হয়ে আঁকবো জেলে জীবনের রক্তাভ জলপ্রপাতের চিত্র! মাঘের শীতে পোহাবো আগুনপোড়া ধান খড়ের ওম। জল আর রৌদ্রবাহী মেঘবাতাসে ভেসে বেড়োবো, প্রথম প্রেমের সুর-স্বপ্নের সুমিকে নিয়ে জলতলে। 
:
কিন্তু এসব প্রেমজশব্দ খসিয়ে, অন্বিত ভাললাগাকে দলিত করে, মার মতো এক স্বাধীন বৈশ্বিক নিখাঁদ মানুষ হলাম আমি। বৈশ্বিক মেধার অভিঘাত জ্বরে আক্রান্ত হয়ে, প্রজ্ঞার চাকুতে শান দিতে দিতে, আর সুখকে আঁকড়ে ধরতে, কত পথই ঘুরলাম আমি এ জীবন ট্রেনে। কিন্তু কোটি মানুষের ক্রূর ভোগ আর ধর্মান্ধ মনীষা আর বোধের দহনে পুড়েছি আমি সারাক্ষণ। ত্রস্ত ঈশ্বরের সৃষ্টিতত্ত্বে ভীত মানুষেরা, ঘাসরঙা মেঘের খোঁপায় ফুটতে দেয়নি আমার ভাললাগার চতুর্বণা ফুলগুলো। আমার সৃষ্টিশীলতা অন্ধকার নিখাঁদ সন্ত্রাসি ভয়ে হু-হু করছে বুকের ভেতর। এ বিজ্ঞান আর যুক্তির বসন্তেও, প্রজ্ঞার জীবন্ত শব্দগুলোকে কথার ভঙ্গুর সাঁকোয় পারাপার করতে পারিনি আমি। রাজনৈতিক বাঙলাদেশের ভাললাগার বধির বাতিঘরে প্র্জ্বলিত করতে পারিনি, সুন্দরের লিথিয়াম আলোকমালা। প্রাতের অমৃতসূর্য দুপুরে দেখাতে পারেনি তার মেঘভাঙা ঝিকিমিকি রোদ। 
:
তাই এ ধিকৃত জীবনে কষ্টফুলের গোপন পাঁপড়িরা জানতে চায় আমার কাছে, জলাঙ্গি মানব হয়েও জলদাস কেন হইনি আমি? অপ্রতিরোধ্য একাদিক্রমে নিজের কাছে বার বার জানতে চেয়েছি আমি, জলাঙ্গি মানব হয়েও জলদাস কেন হইনি আমি? তাহলে সুখ পেতাম, স্বপ্ন পেতাম, সুমি পেতাম, সুতপা পেতাম, আর পেতাম নীলাভ স্লিপিং পিলে অভিজাত ফ্লাটে ঘুমহীন বিষাদময় রাত্রির বদলে, সাঁওতালরঙা সুমির ভালবাসার ভোটকা মেছোগন্ধের দেহজ সুখের অনন্ত রাত!

 


মেঘনার লঞ্চডুবির ঘটনার পরবর্তী পর্ব বৃটেনের প্লিমাউথে [চলার পথের গল্প # ৬৪]

মেঘনার লঞ্চডুবির ঘটনার পরবর্তী পর্ব বৃটেনের প্লিমাউথে
===================================
[ একটি সত্যি ঘটনার বড়গল্প ]
:
২০০৬ সনে বৃটেনের প্লিমাউথের এক্সিটার ভার্সিটিতে Top Management and School Education শীর্ষক একটা প্রশিক্ষণে গিয়েছিলাম ক'মাসের জন্যে। ঐ ভার্সিটির College of St Mark & St John ক্যাম্পাসে ছিল আমাদের ক্লাস। ৫/৬-জন বৃটিশ টিচার নিয়মিত ক্লাস নিতেন আমাদের। Teacher Education & Research Center বিষয়ে বৃটিশ সোনালী চুল আর নীল চোখের এক তরুণি ক্লাস নিতেন নিয়মিত। সংক্ষেপে ক্লাস রুটিনে তার নাম লেখা ছিল MsRY। সব টিচারদের নামই এমন সংক্ষেপে লেখা খাকাতে টিচারদের আমরা RY, MT, ET নামেই চিনতাম, প্রকৃত নাম জানতাম না। আমরা বাংলাদেশি গ্রুপ শুনে MsRY একদিন ক্লাসে জানালেন তার নাম 'ঋতা ইয়াসমিন'। তার মা বাংলাদেশের চরফ্যাশানের এবং বাবা আইরিশ। অক্সফোর্ডে পড়তে এসে তার মা ভালবেসে বিয়ে করেছে তার বাবাকে, তাই মাও এখানের সিটিজেন। বৃস্টলে থাকে তার মা-বাবা। চাকুরিসূত্রে সে ডেভোনের এ্ প্লিমাউথে সাময়িক থাকছে এখন। বিয়ে করেনি এখনো, এমন কথা বললো হাসতে হাসতে প্রায় ত্রিশ বছরের ঋতা। নানা কথা প্রসঙ্গে জানালো টিচার MsRY যে, বেশ কবার মার সাথে বাংলাদেশে গিয়েছিল সে। একবার বাংলাদেশে ফেরি ডুবিতে বড় নদীতেও ডুবে গিয়েছিল মা ও সে তার ১০-বছর বয়সে। এক গ্রাম্য ছেলে নদী থেকে তুলেছিল সে আর তার মাকে মৃত্যুর কাছ থেকে। এরপরো প্রায় দেড় ঘন্টার পুরো ক্লাস MsRY নানা কথা বললেন ইংরেজি আর ভাঙা বাঙলায়। কি্ন্তু কিছুই আর বুঝতে পারিনি আমি। কি বলছে সে তার একটি শব্দও কানে ঢুকলো না আমার। আমি হারিয়ে গেলাম আমার কৈশোরে, আমার গাঁয়ে মেঘনার তীরে, যেখানে দুপুর বেলা চার-পাঁচশ মানুষ নিয়ে ডুবেছিল একটি লঞ্চ, আজ থেকে ১৮-১৯ বছর আগে। 
:
কুড়ি বছর আগের আমার গাঁয়ের কথা 
========================
আমার গ্রামীণ দেয়ালহীন স্কুলটি ছিল মেঘনার ঠিক তীরঘেষা। ক্লাসে বসে আমরা তাকিয়ে দেখতাম পালতোলা নৌকো, নানারঙের জাহাজ আর কত জলযান চলে যাচ্ছে এদিক থেকে ওদিকে। দক্ষিণ বাংলার ঢাকাগামি যাত্রীবাহি জলযানগুলো প্রায় সবই এ নদী দিয়ে আসা-যাওয়া করতো। বর্ষা মৌসুমে প্রবল জলঘুর্ণন আর ঢেউ জাগতো এ নদীর বুকে। 
:
সপ্তম শ্রেণির দুর্বোধ্য ইংরেজি ক্লাসে যখন Cow রচনা মুখস্ত না পারার কারণে কান ধরে বেঞ্চে দাঁড়িয়ে নদীর ঢেউ গুণছিলাম ক'জনা, ঠিক তখনই সিনেমার রোমাঞ্চকর দৃশ্যের মত ঢাকাগামি একটা যাত্রীবাহি লঞ্চ ডুবতে দেখলাম প্রবল ঢেউয়ে। মওকা পেয়ে কানধরা গ্রুপের সবাই প্রবল দৌঁড় দিলাম নদীতীরে। গাঁয়ে দক্ষ সাঁতারু হিসেবে ইতোমধ্যেই সুনাম অর্জন করেছিলাম আমি। কিন্তু পাহাড়সম প্রবল ঢেউ দমিয়ে দিলো আমায় প্রমত্ত এ মেঘনায় ঝাঁপ দিতে। কাছে নৌকোও ছিলনা যে নৌকো নিয়ে যাই উদ্ধারে! তাই হিরো হয়েও ঠায় দাঁড়িয়ে লঞ্চটির ডোবা দেখছিলাম ঔৎসুক ভিরু কিশোর হিসেবে। কিন্ত ২০১৫'র ফিউচার মানব-বাদিকে প্রমত্তা ঢেউ আর দমাতে পারলো না, যখন তার নজরে পড়লো, এক নারী জলতলে ডুবে যাচ্ছে, তার অল্পবয়সি মেয়েটি নিয়ে।
:
প্রবল স্রোতে ঝাঁপ দিয়ে আমি নির্বিঘ্নে পৌঁছুতে পারছিলাম না ঐ নারী আর তার শিশুকে উদ্ধার করতে। ঢেউ আমাকে বারবার বিচ্ছিন্ন করছিল তাদের নৈকট্যে যেতে। কি এক অমোঘ প্রজ্ঞায় আমি এবার ডুব দিলাম প্রবল স্রোত মাঝে। শরীরের সকল শক্তি একাকারে জলবাঁধাকে তুচ্ছ করে ঠিক মাথা তুললাম একদম ওদের শরীর ঘেষে। মাথা আর হাত দিয়ে ভাসিয়ে রাখলে চাইলাম নারী আর তার কন্যাকে। ডুবন্ত নারীর শরীর থেকে টেনে খুলে ফেললাম তার শাড়ি, যাতে সে ডুবে না যায়। প্রবল ঢেউ আর স্রোতে ৩-জনেই ডুবে যাচ্ছি দেখে, কলাগাছ কেটে, আর ছেঁড়া জাল নিয়ে কানধরা গ্রুপের ৪-কিশোর বন্ধু লাফিয়ে পড়লো জলে। কলাগাছ আর জাল ধরে ভেসে রইল ঐ নারী আর তার সাঁতার না জানা শহুরে কন্যা। আমরা ৫-জনে অনেক কষ্টে জলের সাথে লড়াই করে টেনে তুললাম তাদের বালির চরে। ক্লান্তিতে আমি শুয়ে রইলাম চোখবুজে বালিতে অনেকক্ষণ। বন্ধুরা উ্দ্ধার করলো আরো মানুষ, আর তাদের ভেসে যাওয়া নানাবিধ জিনিসপত্র। মৃত্যুতে আরো ভেসে গেল ৩০-জনের মতো, যাদের অধিকাংশ ছিল শাড়িপরা নারীরা। 
: 
আমার ডুবে যাওয়ার কথা শুনে মা কাঁদতে কাঁদতে বালুচরে এলো জেলে নৌকোতে। মাকে দেখেই উঠে বসলাম আমি, দৌঁড়ে জড়িয়ে ধরলো মা আমায়। বললো, কেন নামলি এতো স্রোত আর ঢেউর মাঝে? পাশের নারী আর তার কিশোরী মেয়েকে দেখিয়ে বললাম, না ধরলে ডুবে যেতো মা-মেয়ে। তাকিয়ে মা তার নিজ শাড়িতে ঢাকলো নারীর শাড়িহীন ভেজা দেহ। নৌকোতে ফিরলাম বিকেলে আমরা বাড়িতে, ঐ নারী আর তার মেয়েসহ। নৌকোতে বসেই মহিলা জানালেন, তারা বৃটেনে থাকে পুরো পরিবার। ভোলার চরফ্যাশানে বাবার বাড়ি তার। ৪/৫ দিন আগে মেয়েসহ চরফ্যাশন গিয়ে, ঢাকা ফিরছিলেন এ লঞ্চে। দুদিন পর বৃটেন ফিরে যাওয়ার কথা তাদের স্বামীর কাছে। মাকে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলেন মহিলা। বললেন, আপনার ছেলে না হলে দুজনেই এখন মরা লাশ হতাম। আমি একটু জানলেও, আমার মেয়ে সাঁতার জানেনা একটুও। ডুবে যা্চ্ছিল সে প্রায়, এ সময় আপনার ছেলেটি এলো ডুব দিয়ে আমাদের কাছে।
:
সুযোগ পেয়ে মা এবার তার 'একিলিস' 'হারকিউলিস' আর 'হেক্টর'সম ছেলের নানাবিধ প্রশংসা করলেন। আমি গদগদ হয়ে এই প্রথম লন্ডনি নারী আর কন্যার দিকে তাকালাম। আরে এ নারীতো অপ্সরির মত সুন্দরি, আর তার মেয়েটি একদম বিদেশিদের মত সোনালী চুলের। গ্রামে এমন ঝকঝকে মেয়ে একটিও দিখিনি আমি আগে। জীবনে এই প্রথম কোন নারীকে ভ্রু-প্লাগ করা, হাতা কাটা গেঞ্জি গায়ে এতো মোহনীয়রূপে দেখলাম আমি। তারা ৪-দিন রইলো আমাদের বাড়ি। জলে ডুবে ভয় পেয়েছিল খুব, জ্বর হয়েছিল মা মেয়ের দুজনেরই রাতে। কিছুই ছিলোনা তাদের। আমার মা নিজ শাড়ি পরতে দিয়েছিল ঐ মহিলাকে। মেয়েটি আমার ছোট বোনের গ্রাম্য তাঁতশাড়ি পড়েছিল দুদিন। জ্বর কমলে ওদের নিয়ে পুরো গাঁ ঘুরে বেড়িয়েছেন আমার মা, সাথে থাকতাম আমিও প্রাণদায়ী বীর হিসেবে। ওদের কারণে দুদিন স্কুলে যাইনি আমি, এ এক মহাপ্রাপ্তি। খবর পেয়ে তার ভাইরা ৩-দিন পর আসে আমাদের গাঁয়ের বাড়ি একটা ট্রলার ভরে ১০-১২ জনের দল। বিয়ে বাড়ির মত আমাদের বাড়িতে উৎসব হয়েছিল সেদিন। খাসি, মুরগি আর মহিষের ঘন দধিতে হাত ডুবিয়ে খেলাম সবাই। ৪-দিন পর ঐ নারী আর তার মেয়েকে তুলে দিতে গেলাম আমরা দুপুরের ঢাকাগামি লঞ্চে সবাই। মহিলাটি কেঁদেছিল আমার মাকে জড়িয়ে অনেকক্ষণ। বিদায়ের প্রাক্কালে আমার হাত ধরে বলেছিল, আমি যেন ঠিকমত পড়ালেখা করি, তাহলে লন্ডন বেড়াতে নেবে আমায়। ঋতা নামের মেয়েটি অশ্রুসজল চোখে আমায় জড়িয়ে ধরে ভাঙা বাংলায় বলেছিল, তোমার জন্যই বাঁচলাম আমি। থ্যাংকু বন্ধু। আমি মনে রাখবো চিরদিন তোমায়! বিদায়ক্ষণে ওদের বাঁচানোর আনন্দে কেঁদেছিলাম আমি, যতক্ষণ দেখা গিয়েছিল লঞ্চটি, ততক্ষণ ঐ দিকে তাকিয়ে থেকে অশ্রু ঝরেছিল আমার।
:
আর যো্গাযো্গ বা দেখা হয়নি ওদের সাথে আমাদের। একটা বিচ্ছিন্ন চরের মানুষদের সাথে যোগাযোগ হয়তো জটিল ছিল তাদের জন্যে। কিংবা তখন মোবাইলের যুগ ছিল না। আ্মাদের ডাক ঠিকানাও নেয়নি তারা, হয়তো ভুলে গিয়েছিল লঞ্চ ডোবার স্মৃতি কিংবা কি কারণ জানিনা আমি। আমরা ভুলে গিয়েছিলাম তাদের, যেমন তারা ভুলে গিয়েছিল আমাকে, আমাকে মাকে, আর আমার গাঁ-কে।
:
ক্লাস শেষে MsRY কখন চলে গেল জানিনা। সহপাঠী অন্যেরাও চলে গেছে অনেকক্ষণ। লাঞ্চ আওয়ার শেষ করে কৈশোরের কুসুমপুরেের উচ্ছ্বাস নিয়ে বেড়ুলাম ক্লাস থেকে। পশ্চিম বৃটেনের বরফাচ্ছন্ন প্লিমাউথের পিচ্ছিল ভেজা পথ ধরে যখন একাকি হাঁটছি ডরমেটরির দিকে, ক্ষীণকায় পোয়াতি কুকুরের প্রসবের কষ্টের মত একটা কষ্ট ঘিরে ধরলো আমায়। প্রাক সন্ধ্যায় খোঁজ নিতে গেলাম MsRY এর স্টুডেন্ট সেন্টারে। তথ্য ঘেটেঘুটে তারা জানালো, ক্যাম্পাসে থাকেনা ঐ টিচার। প্লিমথ শহরের একটা ফ্লাটের ঠিকানা দিলো আমায়, সাথে ফোন নম্বর। কয়েন ফেলে ফোন করলাম টিচার রিতাকে। দেখা করতে চাই তার সাথে বাসায় এমন কথা বললাম। কিন্তু ঘন তুষারপাতে বের হতে নিষেধ করলেন তিনি। বললেন জরুরি কথা থাকলে কাল ক্লাসে দেখা হবে আমাদের, তখন যেন বলি। ফোন রেখে দিলাম। বরফের ভেতর পা ডুবিয়ে হেঁটে এলাম রুমে। ভেতরে পেজা তুলোর মত তুষার গুড়ো ঢুকেছে জুতোয়। দরজার পাশে এসে আবার বরফ ভেঙে কয়েন ফেললাম ফোনে। বললাম, ম্যাম তোমার মায়ের ফোন নম্বরটা চাই, দেবে? কেন জানতে চাইলো সে। বললাম বিশেষ দরকার, পরিচিত আমার খুব। ঋতা অকুটিল সরলতায় ফোন নম্বর দিলো মায়ের। বৃস্টলে ফোন লাগালাম আমি তখনই। দু-বারের চেষ্টায় ঋতার মাকে পেলাম ফোনে। পাঁচ মিনিটের মাথায় বোঝাতে সক্ষম হলাম আমি কে, আর কিভাবে এখন ডেভোনের প্লিমাউথে। ফোন কাঁপিয়ে তখনই পারলে ঝাপটে ধরে ঋতার মা আমায়। ঋতাকে কেন এ কথা বলিনি তাও বারবার জানতে চাইলো আমার কাছে। পকেটে আর কয়েন না থাকাতে কেটে গেলো লাইনটা। এবার ইচ্ছেমত তুষারে পা ডুবিয়ে, গা ভিজিয়ে বরফে ঢেকে দিতে চাইলো মনটা। কিশোরের মত দৌঁড়ালাম অনেকক্ষণ ডরমেটরির চারদিকে। ই্চ্ছে হলো বরফে ঢাকা রডোডেনড্রেন গাছটাকে ছাড়িয়ে দেই শক্ত বরফ থেকে, যাতে বেড়োতে পারে তার নতুন কুঁড়ি, যেটি আটকে আছে অনেক দিন শক্ত বরফে! 
:
১০-টায় ক্লাস ছিল আমাদের। তাই তাড়া ছিলনা ওঠার। নটায় কফির জন্যে দুধ মিশ্রিত পানি দিলাম চুলোয়। টিভি অন করে চ্যানেল ঘুরাচ্ছি এমন সময় দরজায় ঠক-ঠক শন্দ। খুলতেই দেখি ঋতা ম্যাডাম। কেবল জানতে চাইলো, আমি সেই কিনা! হ্যা সূচকে মাথা নাড়াতেই জড়িয়ে ধরলো আমায়। রুম কাঁপিয়ে চিৎকার শুরু করলো ঝংকৃত হাসিতে। তার হাসি আর চিৎকারে পাশের রুমের সবাই ছুটে এলো। ঋতা ব্যখ্যা করলো সবাইকে আমার কুড়ি বছর আগের হিরত্ব আর বিরত্বের কাহিনি। 
:
দেখতে দেখতে সরকারি প্রশিক্ষণ শেষ হলো আমাদের। এবার ফেরার পালা। প্লিমাউথ থেকে ৬০০কিমি দুরে লন্ডনে ফিরবো আমরা। আধুনিক বাস নিয়ে যাবে আমাদের লন্ডনে, সেখান থেকে দুদিন পর ফ্লাইট। ঋতার মার অনুরোধ, যাওয়ার পথে যেন বৃস্টলে নামি আমি সেখানে তার বাড়ি। ঋতাও যাচ্ছে আমার সাথে তার বাড়িতে। সারাপথ ঋতা আর আমি পাশাপাশি সিটে বসলাম। নানা কথা, গল্প, আর হাসিতে মাতিয়ে রাখলো ঋতা আমায়। বৃস্টল হাইওয়ের কফিশপে ঋতার মা বাবা অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্যে। বাস থামতেই ওর মা আর বাবা জড়িয়ে ধরলো আমায়। কাঁদলো প্রকাশ্যে সবার সামনে। আমার লাগেজপত্র নিজেরা নামিয়ে তুললো নিজ গাড়িতে। বাড়ি না পৌঁছানো অবধি সারাপথ কথা বললো ওর মার অব্যাহত গতিতে। কেন যোগাযোগ করতে পারলোনা এতদিনে, তারও নানাবিধ ব্যাখ্যা দিলো সে। আমাকে দেখে সে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর কিছু দেখছে, এ কথা বলতেও ভুললেন না তিনি।
:
ঐদিনসহ পরের পুরো দিনই রইলাম ঋতাদের বৃস্টলের বাড়িতে আমি। পারলে পুরো বৃটেনের সব সুখ কিনে দেয় আমায় ঋতা, তার মা, আর বাবা। লং ড্রাইভে বৃটেনের "ল্যান্ডসএন্ড"-এ নিয়ে যায় আমায়, ঘুরিয়ে দেখায় কত কি? সখে লাগানো নিজের বাগানের 'এ্যাসপারাগাছ' আর 'সিলারি' তুলে আনে ঋতা আমার জন্যে। মনে হলো ঋতাও চলে আসবে বাংলাদেশে আমার সাথে। ওদের ভালবাসায় মুগ্ধ হই আমি। ভাবতে থাকি পৃথিবীতে জন্মের পর যত কাজ করেছি আমি, সম্ভবত এর মাঝে শ্রেষ্ঠতর সুখকর কাজটি ছিল ঋতা আর তার মাকে টেনে তোলা। জীবনের শ্রেষ্ঠতর রাতটি শেষ হলো আমার। এবার পরিকল্পনা মোতাবেক আমাকে সরাসরি হিথরো নিয়ে আসবে ঋ্তার পরিবার। 
:
৪-ঘন্টা লং ড্রাইভ করলো ঋতা আর তার মা ভাগাভাগি করে। বাবা গাড়ি চালান না এখন চোখের প্রবলেমে। আমরা সরাসরি হিথরোর ২-নম্বর টার্মিনালে ঢুকলাম, যেখানে মিট করবো আমি আমার গ্রুপ মেম্বারদের সাথে, যারে বাসে চলে এসেছিল দুদিন আগে লন্ডনে। বোর্ডিং করে লাগেজপত্র সব দিয়ে ইমিগ্রেশনে ঢোকার আগে, এয়ারপোর্টে ক্যাফেতে নিয়ে গেলে ঋতার পরিবার আমাদের গ্রুপের সবাইকে। একটা ছোট্ট অনুষ্ঠানের মত আয়োজন। শেষ বিদায়ের চা-চক্র। ১০-মিনিটের এ চা-চক্রে আবার ঋতার মা আর ঋতা আমার পরিচয় তুলে ধরলো এক 'সাহসি মহাবীর' হিসেবে। একে একে গ্রুপের অন্যদেরও পরিচয় করালেন সবার সাথে। শেষে মূহূর্তে ক্যাফেতে ঢুকলো বাঙালি বৃটিশ ঝকমকে চেহারার এক যুবক। এসেই 'হাই ডার্লিং' বলে জড়িয়ে ধরে প্রায় কোলে করে উপরে তুলে ফেললো ঋতাকে। ঋতার মা ঐ যুবকের কাছেও তুললো ধরলো আবার আমার তথাকথিত "মহামানবীয়" পরিচয় এবং সাথে তার পরিচয়ও। 'টমাস ইব্রাহিম' হচ্ছে ঋতার ফিঁয়াসে তথা প্রেমিক। পেশাগত ব্যস্ততার জন্য আসতে দেরি হয়েছিল তার। আগামি বসন্তে মানে দুমাস পর ঋতার সাথে বিয়ে হবে টমাসের মুসলিম রীতিতে। ঋতা আর টমাস এখন এক ফ্লাটেই থাকে। কেবল ছয়মাসের জন্যে ঋতা গিয়েছিল এক্সিটার ভার্সিটিতে, যা শেষ হবে আর ১-মাস পরই। তখন ঋতা চলে আসবে লন্ডনে টমাসের কাছে।
:
বিদায় দিতে প্রায় টারমাকের কাছাকাছি চলে আসে ঋতা, টসাম, তার মা, আর বাবা। টমাস বৃটিশ ক্যালিডোনিয়ান এয়ারের পাইলট, তাই সিঁড়ি পর্যন্ত আসতে পারলো তারা। বোর্ডিং ব্রিজে পা রাখার প্রাক-মূহূর্তে ঋতা আর তার মা এবার জড়িয়ে ধরে আমায়। অঝোড়ে কাঁদতে থাকে দুজনে আমায় জড়িয়ে। আমি আর সামলাতে পারিনা নিজেকে। পৃথিবীর সকল শোঁক এসে এক অনন্ত ভালবাসায় ঋণী করে বুক ভেঙে দেয় আমার। কষ্টদ্রোহে জীবনের ণত্ব-ষত্ব, প্রকৃতি আর প্রত্যয়জ্ঞান ভুলে যাই আমি। ওদের ভালবাসার ঘনিষ্ঠ বিষক্রিয়ায় মরে যেতে ইচ্ছে হয় আমার। ককপিট ভেঙে বিজনেস ক্লাসের প্রথম সারিতে বসে গ্লাসের ফোকড়ে ষ্পষ্ট দেখি আমি ঋতা পরিবারকে। কৈশোরিক আনন্দ স্কুলের শৃঙ্খলিত ঘণ্টায় বেজে ওঠা শব্দের মাঝে ঋতা আর তার মাকে প্রচণ্ড জলঘুর্ণাবর্তে আঁকড়ে ধরি আমি। দু:খ কাচামালে গলিত স্বর্ণনির্মিত পাত্রে মা-মেয়েকে ভালবাসতে ইচ্ছে করে আমার। কিন্তু হঠাৎ তাবৎ বিমর্ষতা, সমস্ত মলিনতার মাঝে বেদনার সুসুপ্তির গন্ধেমাখা সুন্দরেরা পালিয়ে যায় এ নভোযান থেকে। আকাশের হিম তারা সকল পরিপূর্ণা অঘ্রাণের এক রোদ হয়ে আমায় বলে, পুরাণো জন্মের ঋণ শোধ হয়েছে এবার, চলো ফিরে যাই জলদাস সমাজে। 
:
লাল নীল বর্ণালী মেঘ কেটে কেটে বিমান এগুতে থাকে ঢাকার দিকে, প্রসারণশীল এই নক্ষত্রখচিত আকাশে সুখের বহতা বাতাসের একগুচ্ছ আনন্দ শ্লোক আমায় হাতছানি দেয় দূর নক্ষত্র থেকে, আর বলে মহাকাশীয় নক্ষত্র ঘাসফুলে তুমি চলে এসো, ভাললাগার শ্বাসরুদ্ধকর নভোখেয়ায় তুমি ঘুরে বেড়াবে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে। বিমান যতই ঢাকার দিকে এগুতে থাকে, সুখের আকাশছোঁয়া এক মহাকাশীয় জ্বলন্ত চুল্লিতে প্রবেশ করি আমি, যেখানে অবিস্মরণিয় ভুলেরা দৌঁড়োয় সুখ মথিত করে মেঘরাজ্যে, তারার রাজ্যে, নক্ষত্ররাজ্যে !




তুষার, নদী, নারী এবং মৃত্যু কফিনের গল্প [ গল্প # ৬৩ ]

তুষার, নদী, নারী এবং মৃত্যু কফিনের গল্প
==========================
একটা অজ পাড়াগাঁয়ে বসতি থাকলেও, স্কুল জীবন থেকেই পড়ালেখা আর জ্ঞানের প্রতি ভীষণ ঝোঁক ছিল আমার। ৮ম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ৫-টি সুন্দর ঝকঝকে রঙিন বাঙলা পত্রিকা পেতাম আমি রেজিস্ট্রি ডাকযোগে। প্রতি সপ্তাহে যখন সপ্তবর্ণা সুঘ্রাণের সোভিয়েত ইউনিয়ন, সোভিয়েত নারী, উদয়ন, যুববার্তা, আর 'সোভিয়েত সমীক্ষা' আসতো প্রগতি প্রকাশন, জুবভস্কি বুলভার, মস্কো থেকে সরাসরি এক ভাঙা গ্রামীণ স্কুলে, তখন সত্যিই টিচারসহ অনেকেই বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকাতো আমার দিকে। খুব পড়ুয়া আর যৌক্তিক ছিলাম আমি। পরপর ৩-বার সোভিয়েত মানুষ আর জীবন সম্পর্কে ঐসব পত্রিকায় প্রকাশিত কুইজের উত্তর দিয়ে গিফট পেলাম আমি সোভিয়েত সরকার থেকে। স্কুলে থাকতেই কিশোর বয়সে ডাক এলো আমার সোভিয়েত ভ্রমণের। জীবনে ঢাকার বাইরে যা্ইনি কোথাও আমি। সেই আমি একসময় ৮-জনের এক গ্রুপে 'এ্যারোফ্লো'তে পৌঁছলাম মস্কোতে। জীবনে প্রথম বিমানে উঠে সে কি শিহরণ আর ভয়! তা আরেকদিন বলবো আরেক জীবনপাতাতে !
: 
২১-দিনের এ শিক্ষাভ্রমণে ৪-দিন মস্কোতে ছিলাম আমরা। অনেক ঐতিহাসিক স্থান ঘুরলাম লেলিনগ্রাদ, মস্কোতে সরকারি প্রতিনিধিদের সাথে, যা কিছুটা স্মৃতিতে ঝাপসা এখন। কিন্তু যেটা এতোদিনেও আমার স্মৃতিতে জ্বলজ্বলে ছবির মত ভাসতে তা হচ্ছে, ১৪-দিন 'ইউলিনা দুদিয়ানা' পরিবারের সাথে আমার আনন্দ আর বেদনার যাপিত জীবন। আমাদের ৮-জন শিক্ষার্থীতে ৮-টা সোভিয়েত গ্রামীণ পরিবারের সাথে দু-সপ্তাহের জন্যে সংযুক্ত করা হয়েছিল। যাতে সোভিয়েত জীবনধারা একদম কাছ থেকে দেখে তা বাংলাদেশের মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারি আমরা। মস্কো থেকে অনেক দুরে মঙ্গোলিয়া সীমান্তের বেশ উত্তরে বৈকাল হৃদের সন্নিকটে 'ইরকুটস্ক' জেলার 'নভো-ইরকুটস্ক' নামের গ্রামটিতে কাঠের দোতলা বাড়িতে বাস করতো 'ইউলিনা দুদিয়ানা'র পরিবার। স্বামী আন্না আলেক্সান্দর, সতের বছরের ছেলে 'উলিয়ানভ', আর পনেরো বছরের মেয়ে 'ইলিয়া দিমিত্রি'-কে নিয়ে সমবায়ি কৃষি খামারের 'সুপার' বা 'ম্যানেজার' হিসেবে ঐ খামারের একটা বাড়িতেই বসবাস করতো ইউলিনার পরিবার। ওপরের তলায় থাকতো ছেলেমেয়ে আর নিচে তারা। সমবয়সি শিক্ষার্থী হিসেবে আমাকেও্ থাকতে দেয়া হয়েছিল ওপরে দুভাইবোনের সাথে। বৈকাল হ্রদের তীরে 'নাদেজদা কনস্তানতিনোভনা ক্রুপস্কায়া' স্টেট সেকেন্ডারি স্কুলে পড়তো দুভাইবোন। ওদের সাথে দুবার ঐ স্কুলে গিয়েছিলাম আমি, ক্লাসেও বসেছিলাম শিক্ষার্থীদের মতই। রুশ ভাষা ছাড়াও ওরা স্কুলে শিখতো 'চুভাশ' ভাষা। আমি সামান্য দুচারটি রুশ শব্দ ছাড়া কিছুই বুঝতাম না। কেবল তাকিয়ে থাকতাম সবার মুখের দিকে অদ্ভুৎ বি্স্ময়ে।
:
'নভো-ইরকুটস্ক' গাঁয়ের প্রায় সব নারী পুরুষ কাজ করছো কৃষি খামারে। সোভিয়েত নারীরা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের সর্বক্ষেত্রে সমানে চলতো পুরুষের সাথে। এমনকি 'নভো-ইরকুটস্ক' গাঁয়ের কৃষি খামারটি ছিল 'ইউলিনা দুদিয়ানা' নামের ঐ নারীর নিয়ন্ত্রণে। 
সমতার বীজ বপনকৃত এমনসব মানুষের আলোতে সম্ভবত আলোকিত হয়েছি আমি। প্রায় সারাদিন হেঁটে হেঁটে পুরো খামার দেখতাম এক পরমানন্দের মার্গে। গম, আলু, ভুট্টা, আর নানাবিধ সবজি ছাড়াও অনেক ফুলের চাষও হতো খামারে। 'হার্বেস্টার কম্বাইন্ড' নামে এক ফসল কাটার যন্ত্রে গম কাটা হতো তখন। আমি অনেকবার ঐ যন্ত্রে উঠে বসেছিলাম ড্রাইভারের পাশে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত সবাই কাজ করতো খামারে। কেউ ফসল লাগাতো, কেউ যত্ন করতো, কেউবা তুলে নিতো বাজারজাত করণের জন্যে। তামাটে বাঙালি হিসেবে 'নভো-ইরকুটস্ক'র সব সাদা মানুষের মাঝে আমার বেশ কদর ছিল। কারো ভাষা আমি বুঝতাম না, কেউ বুজতো না আমার ভাষা, তারপরো সবাই হেসে-হেসে কথা কইতো আমার সাথে। মেয়েদের কোন মেকাপ বা রূপচর্চা করতে দেখিনি ওখানে, তা ছাড়াই তাদের রূপ অনন্য মুগ্ধতায় ভরা ছিল। স্লোভাক নৃগোষ্ঠী আর সংস্কৃতির সংমিশ্রণে গাঁয়ের রং ছিল ওদের ঝকঝকে। কৃষিতে যৌথীকরণ তথা কৃষক যৌথ খামারের আওতায় চলে এসেছিল পুরো গ্রাম। হাজার চারেক মানুষের সবাই কৃষক ছিল, কেবল ৪-জন কামার আর অন্য পেশার কজন মানুষ ছাড়া। 
:
বৈকাল হ্রদ ছিল 'নভো-ইরকুটস্ক' গ্রাম থেকে দুঘন্টার পথ। আমরা ট্রান্স সাইবেরিয় ট্রেনে চেপে ছুটির দিনে বৈকাল হ্রদে গিয়েছিলাম একদিন। এটি ছিল সাইবেরিয়ার দক্ষিণভাগে অবস্থিত একটি সুপেয় পানির মুগ্ধকর হ্রদ। এর উত্তরে ছিল 'ইর্কুৎস্ক' আর 'ওবলাস্ত' শহর। 'ওব' আর 'লেনা' থেকে সৃষ্ট ছোটনদী 'আঙ্গারা'র মাধ্যমে হ্রদের পানি বাইরে নিষ্কাশিত হতো প্রতিদিন। হ্রদের পানি তুষারময় থাকলেও, আঙ্গারা নদীর জল বরফে জমে গিয়েছিল। আমরা প্লান করলান স্কুল ছুটির দিন আঙ্গারা নদীর বরফে দৌঁড়োবো সবাই মিলে। একদিন আমরা ঘুরতে গেলাম ইভালগিনস্কীর উরাল ঘনবনময় পর্বতমালায়। যেখান থেকে দেখা যেতো উত্তর থেকে দক্ষিণের তুন্দ্রা, তৈগা, স্তেপ ও অর্ধ-ঊষর বরফাচ্ছিত মরুভূমি। সেখানেও মানুষ বাস করতো অদ্ভুৎ সব পোশাক পরে, নানা প্রতিকুলতায় ফলাতো তারা গম, যব, আর ভুট্টা। এক বিস্ময়কর জীবনে বেঁচে থাকতে দেখেছি মানুষদের। 
:
খাবার খুব কম খেলেও, প্রায় সবাই রাতে ভদকা থেতো ও এলাকার মানুষেরা। গাঁয়ের দোকানে প্রাপ্তবয়স্ক নারীপুরুষ প্রত্যেকেই সপ্তাহে এক বোতল ভদকা পেতো ফ্রি। তারপরো ২-রুবেল ১৫-কোপেইকে কিনতে পাওয়া যেতো, ভদকার পুরো বোতল। ইউলিনা আর তার স্বামী আন্না আলেক্সান্দর রাত ৯-টার পরই ভদকা খেয়ে টাল হতো প্রায় প্রতিদিন। কৈশোরিক চপলতায় বন্ধু 'উলিয়ানভ' আর 'ইলিয়া'কে একদিন বললাম, ভদকা খেলে কি হয়? এক ফাঁকে তারা কিচেন থেকে নিয়ে আসে পুরো ভদকার বোতল। ৩-জনে দোতলার দরজা বন্ধ করে ভদকা খাই অনেকক্ষণ। কিন্তু কিছুই বুঝিনি আমি, কি খেলাম, কেন খেলাম, কি হয়েছিল রাতে সেদিন। তবে এক স্বপ্নের মাঝে উড়েছিলাম তা মনে আছে আমার। পরদিন ধরা পড়লে আমাকে দেখিয়ে 'উলিয়ানভ' আর 'ইলিয়া' রক্ষা পায় মা-বাবার চোখরাঙানি থেকে।
:
'নভো-ইরকুটস্ক' এলাকাটি রাশিয়ান শীতলতম এলাকা হিসেবে প্রায় সারাবছর হিমশীতল এবং শৈত্যপূর্ণ থাকতো। অতিরিক্ত তুষারপাতে বরফাচ্ছন্ন থাকতো রাস্তাগুলো প্রায়ই। কখনো শৈত্যপ্রবাহ সৃষ্টি হয়ে সারাদিন হাড়কাঁপানো ঠান্ডায় ওক কাঠ জ্বালিয়ে ঘরে বসে থাকতাম আমরা সবাই চুল্লির পাশে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার ঝকঝকে রোদ উঠতো ফসলের মাঠে। ২০-৩০ মিনিটে তুষার ঝেরে ফসলের গাছগুলো সজিবতা ফিরে পেয়ে হেসে উঠতো খিলখিলিয়ে ।
:
আমার চলে আসার ঠিক আগেরদিন আমরা ইউলিনার পুরো পরিবার আর কজন প্রতিবেশি মিলে 'স্কি' করতে গেলাম 'ওব' আর 'লেনা' থেকে সৃষ্ট ছোটনদী 'আঙ্গারা'য়, যেটি তখন ঢাকা ছিল ঘন তুষারে। ছেলে 'উলিয়ানভ', আর মেয়ে 'ইলিয়া' স্কিতে পারদর্শী ছিল খুব। আমি কবার চেষ্টা করে অদক্ষতায় পরে গেলাম পিচ্ছিল বরফে অদর্শনীয়ভাবে। সবার হাসি দেখে তাই বসে পড়লাম মা ইউলিনা, আর বাবা আন্নার পাশে। ওরা 'স্কি' করতে করতে অনেক দূরে চলে গেল। ওদের প্রতি ঈর্ষা জাগলো আমার, আর চুল ছিঁড়তে ই্চ্ছে করছিল নিজের ব্যর্থতায়। কিন্তু হঠাৎ বিস্মিত করে ১৭-বছরের দক্ষ উলিয়ানভ ডুবে গেল একটা বরফের চোরা গর্তে। বোন ইলিয়া তাকে উদ্ধারে গিয়ে আরেকটা ছোট গর্তে পরে গেল সেও। বিশ্রামরত আমরা ৪-৫ জনে দৌঁড়ে গেলাম ও্দের নৈকট্যে। অনেক সাবধান আর সতকর্তায় রশি ছুঁড়ে ইলিয়াকে টেনে তুলতে পারলেও, ১৭-বছরের টকটকে স্বণার্ভ চুলের 'উলিয়ানভ'কে আর খুঁজে পেলাম না আমরা। মূহূর্তে 'উলিয়ানভ' হারিয়ে গেল মা, বাবা, বোন আর স্বল্পদিনের এক বিদেশি বন্ধুর চোখের সামনেই। খবর পেয়ে Baikal rescue team এলো ঘন্টা খানেক পরে। বিশেষ কৌশলে বরফগর্তে নেমে তারা তুলে আনলো উলিয়ানভের শীতার্ত লাশ। 
:
সকালে ফেরার পালা আমার। সরকারি একজন প্রতিনিধি এসেছে মস্কোর ট্রেনে তুলে দেবে আমায়। প্রায় ১৩-দিন একসাথে থাকা উলিয়ানভের গন্ধ্যেভরা ন্যুব্জপীঠ পানশালা থেকে বেড়োই নিজের জিনিসপত্র নিয়ে। বুকের তোরঙ্গে রাখা রৌরব নরকের দাহ নিয়ে নিচে নামি আমি। বাইরে প্রচন্ড তুষারের মধ্যে একটা কফিনে রাখা হয়েছে উলিয়ানভের দেহ। ভেতরে কম্পমান চোখের জলে স্নাত এক বিদেশি কিশোর, যাদের দুজনকেই্ বিদায় দিতে দাঁড়িয়ে মা ইউলিনা দুদিয়ানা, বাবা আন্না আলেক্সান্দর আর মেয়ে ইলিয়া দিমিত্রি। ওদের ৩-জনের দিকে তাকিয়ে কিছুই বলতে পারিনা আমি। এক দ্যোতনাহীন, ব্যঞ্জনাবিহীন, সাচীকৃত হেমন্তের শীতে হাত কাঁপতে থাকে আমার। হারাণো হিমেল প্রেমের মৃত ঘণ্টার মত মাকে জড়িয়ে ধরি হৃদয়ের নিভৃত ভালবাসায়। ওরা ৩-জনে ডুকরে কেঁদে ওঠে এক সাথে। আমার শরীরের জিনের মধ্যে জন্ম নেয়া মানবিক অসুখে সংক্রামিত হয়ে ৪-জনে একত্রে ফুল দেই মৃতের কফিনে। 
:
একসাথে গাড়ি ছাড়ে আমাদের। একটাতে আমি যা্চ্ছি Irkutsk-Passazhirskiy ট্রেন স্টেশনে মস্কোগামি ট্রেন ধরতে। অন্যটাতে উলিয়ানভের কফিন সরকারি Funeral Cave এ এক অন্ধকার জীবনের ট্রেন ধরতে।
:
ব্লাদিভস্তক থেকে ছেড়ে আসা ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়ের এক্সপ্রেস ট্রেনে উঠলাম Passazhirskiy স্টেশন থেকে। সব রুশ মানুষের মাঝে সম্ভবত আমিই কফিবর্ণা বিদেশি। এবার তুষার থেমে সূর্যকরোজ্জ্বল হেমন্তের রোদ উঠলো ট্রেনে। মেঠো ইঁদুরের আদিম যৌনতার মত ট্রাকে জমা তুষার কেটেকেটে ট্রেন দৌঁড়ুতে শুরু করে আমাদের গন্তব্যে। ভলগা, কিয়েভ, লেনা, উফা, সামারা, নভোসিভিরস্ক, পার্ম, নভগরেদ, কোভেত, গ্রাচি আরো কত নাম না জানা গাঁ, নগর, নদী পার হয়ে ট্রেন চলে জীবনের দিকে। ট্রেন জার্নির আজন্ম লালিত আমার সব ভাললাগারা এবার নিস্পৃহ থাকে কি এক অবোধ গুমোট কান্নায়। লবণগোলা তিক্ত নোনতা জলের মত সব সুন্দরের মেঘেরা দুরে চলে যেতে থাকে আমার। পুরো ট্রেনে কষ্টের ক্ষতমুখেরা হাঁ করে বিকট গন্ধ ছড়ায় নাকে আর বোধে আমার। স্বপ্ন বীজের ক্রোড়ে বেঁচে থাকা জীবন এক নিরর্থক যন্ত্রণা মনে হয়। এই ঝড়ের মত ছুটে চলা ট্রেনটাকে একটা মৃত্যু কফিন হিসেবে দেখি, যার ভেতরে উলিয়ানভের মত আমার লাশ। ট্রেনটি ছুটে চলছে অস্তিত্ববিলীন এক মৃত্যুনগরীর দিকে; যেখানে কোন জীবন নেই, ভালবাসা নেই, হাসি নেই, নারী নেই, প্রেম নেই, ফুল নেই, পাখি নেই। কেবল আছে পুতিগন্ধময় প্রেমহীন শ্বাসরুদ্ধকর অসুখকর এক বুড়ো নৌকো। যে ক্লেদময় ভঙ্গুর নৌকোয় হিংসা বুননে চলে প্রতিক্ষণে সুন্দর স্বপ্নের ব্যবচ্ছেদ। 'প্রেতরাইকা' স্টেশনের পর রাত নামে 'ব্লাদিভস্তক' ট্রেনে। নির্নিমেষ জ্যোৎস্নায় স্নাত হয় রুশিয় আকাশ। এ মৃত্যু কফিনে শুয়ে শুয়ে আমি গুণতে থাকি খসে পরা নক্ষত্র আর উল্কারাজিদের। যার মাঝে আমি আছি, আছে উলিয়ানভ কিন্তু ইলিয়া দিমিত্রি নেই কেন? সে কি খসে পরা উল্কাপি্ণ্ড হবে না কখনো?


মঙ্গলবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

দলিত নারীর সাথে জীবন দহনের ঈদ যাপন [চলার পথের গল্প # ৬২

 দলিত নারীর সাথে জীবন দহনের ঈদ যাপন
:
কোলকাতা এসেছি গত ১৮ তারিখ প্রাগৈতিহাসিক দু:খগুলো ভুলতে । কথা ছিল মুর্শিদাবাদে ঈদের দিন কাটাবো কিন্তু ফেসবুক বন্ধুর মা মারা গেলেন পরশু হঠাৎ। অন্যজন আবার একইসাথে জন্ডিস আর টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি জটিল অবস্থায়। তাই মানবতার ঝান্ডাটি উড়িয়ে হাজার দুয়ারি এক্সপ্রেেসে বসলাম মুর্শিদাবাদের পথে। বিকেলে ফিরছি লালগোলা এক্সপ্রেসে। প্রায় খালি ট্রেনে আনন্দবাজারে পড়ছিলাম মক্কায় "আল্লাহর মেহমানদের" করুণ মৃত্যুুর খবর। বেলডাঙা থেকে এক অরূপসি নারী তার ৪/৫ বছরের সন্তান নিয়ে পাশে বসলেন আমার। প্রথমে নজর পড়েনি হঠাৎ রিণরিণে কান্নার শব্দ শুনি তাকিয়ে দেখি কাঁদছে ঐ নারী। পাশের সব যাত্রীরা জানতে চাইলো কান্নার কারণ। অনেক কথা বললো নারী, যার মর্মার্থ হচ্ছে স্বামী নামক পুরুষটি নেশাগ্রস্থ অবস্থায় তাকে মারধর করে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। এ পৃথিবীতে ঐ নারীর মা-বাবা, ভাইবোন কেউ নেই। তাই স্বামীর অত্যাচারে ঘর থেকে বের হয়ে ট্রেনে উঠে বসেছে সে শিশুসহ অজানার উদ্দেশ্যে। জানেনা সে কোথায় যাবে।
:
সবাই বোঝালো তাকে স্বামীর ঘরে ফিরে যেতে কিন্তু কিছুতেই যাবেনা সে। পলাশী থেকে বেলডাঙা পর্যন্ত প্রায় সবাই পরিচিতজন। অবশেষে ভয় দেখালো পরিচিত যাত্রীরা কোলকাতা গিয়ে কোথায় উঠবে সে? শিশুসহ বিপদে পড়বে সে নির্ঘাৎ। বার বার রক্তলাল চোখ মুছে অবশেেষে সিস্ধান্ত হলো বেলডাঙার দোকানি "সুব্রত" নিয়ে যাবে তাকে বেলডাঙা। ওঠাবে তার নিজ ঘরে। খবর দিয়ে আনবে স্বামীকে। তারপর মেলানোর চেষ্টা। সব শুনে কি করবো বিদেশী আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। ঢাকা হলে পুলিশ নিয়ে ধরে আনতাম দলিত নারীটির স্বামীটিকে। মামলা ঠুকে দিতাম ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে। কিন্তু এখানে অসহায় অবস্থায় কেবল শুনছি সব কিছু।
:
যাত্রীদের ইচ্ছেতে নারীটিকে নিয়ে নামলো "সুব্রত" কৃষ্ণনগর জংশনে। সে এখন অপমানিত নারীটির ঘর জোড়া দেয়ার চেষ্টা করবে। তাই ফিরে যাবে তারা বেলডাঙাতে ঐ নারী আর সুব্রতর বাড়ি। কিন্তু আমার নিজের সাথে যুদ্ধ শুরু হলো আমার। প্রতারণায় পড়বে নাতো নারীটি? কি করবো এখন? নারীটি কি সামনে এগিয়ে গিয়ে বিপদে পড়বে নাকি পেছনে গিয়ে? কৃষ্ণনগর ছাড়লো আমাদের ট্রেন নারী আর সুব্রতকে রেখে। দু:স্বপ্নের ভয়ে নির্ঘুম রাতের মত কষ্টকর সময় কাটছে আমার।
:
ট্রেন যতই এগুলো থাকে সামনে, বিবর্তিত পৃথিবীর ভূ-গোলকে আমি ঐ নাম না জানা নারীটিকে নিয়ে ভাবতে খাকি ক্রমাগত। মানবিক বিপন্ন বোধের ব্যাকরণে আমি মেলাতে পারিনা কোন সুত্র। অচেনা ঐ নারী আর তার সন্তানের জন্যে ক্ষীণ ভালবাসার প্রেমজ মধুরতা জাগে আমার মনে। আমি যতই অপলক দূর-দিগন্তে চোখ রাখি, ততই হৃদ মননে প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাস হয়ে ঐ নারী আমার সামনে কাঁদতে থাকে। সমগ্র পৃথিবীর প্রাগৈতিহাসিক গল্পগুলোর মাঝে এ নারী এক অনন্য চরিত্রে খেলা করে হৃদ মননে আমার। 
:
ক্রমাগত সন্ধ্যার আঁধারে দমদম জংশনে ঢোকার আগেই ট্রেন দাঁড়িয়ে যায় হঠাৎ। চোখ ঝলসানো আলো জ্বালিয়ে, আর তীব্র হুইসেল বাজিয়ে দ্রুতগামি এক ট্রেন লালগোলা এক্সপ্রেসের পাশ দিয়ে ছুটে আসে আকস্মিক । এক অশরিরী হাত হঠাৎ জানালা দিয়ে আমায়ে টেনে নিয়ে যায় ঐ কালান্তরের ট্রেনে। প্রচন্ড রোষে সব স্টেশন পাস কাটিয়ে ট্রেনটি ছুটতে থাকে বহরমপুরের দিকে। লাইনে দাঁড়ানো সব দুরপাল্লার, এক্সপ্রেস, প্যাসেঞ্জার, লোকাল ট্রনগুলো দ্রুত সরে গিয়ে কালান্তর ট্রেনকে ট্রাক ছেড়ে দেয়। যাত্রীহীন ঐ ট্রেনের ইঞ্জিনরুমে আমি আর ঐ অশরিরী মানুষ কেবল ছুটতে দেখি সমস্ত স্টেশন আর যাত্রী। যেন ট্রেনটি দিকচক্রবালে উড়ে যেতে থাকে যুদ্ধ বিমানের মত। এক সময় পলাশীর কাছে গিয়ে ঐ নারীর পাশাপাশি চলতে থাকে কালান্তর ট্রেন। একইভাবে সে জানালা দিয়ে টেনে আনে শিশুসহ ঐ নারীকে। চালকের আসনে বসায় তাকে। ছুটে চলছে কালান্তর ট্রেন পাশে আমি, শিশু, অশরিরী মানুষ আর নারী। 
:
প্রচণ্ড আলোকময়তায় ষ্পষ্ট দেখি আমি ট্রাকের ওপর একটা মানুষ। মানুষটি ঐ নারীটির স্বামী। তাকে ধরে এনেছে ঐ অশরীরি। নারীটি থামাতে চায় ট্রেনটি। কিন্তু অশরিরী দৃঢ়তায় বলে, চালিয়ে যাও ট্রেন থামালে বিপদ আছে তোমার। এবার চোখের জলরক্ত মুছে নারীটি ট্রেনের গতি আরো দ্রুততর করে। ঝড়োবেগে ট্রেন এগিয়ে যায় নাম না জানা নারীর স্বামীকে দ্বিখন্ডিত করে। তারপরো ট্রেন থামেনা। ঝরাপাতা কুয়াশায় হিম বিষণ্ণতা এড়িয়ে ট্রেন সামনে এগুতেই থাকে। স্বাপ্নিক দৃষ্টিভ্রমে উড়ে চলা ট্রেন যাত্রী হয়ে দু:খের যাপিতকালে ফিরে যেতে চাই আমি। আমার চোখ ঝাপসা হয়। কিছুুই নজরে পরেনা আমার। দু:খ জলের ন্যুব্জতা ভেঙে প্রচণ্ড রোষে কালান্তরের ট্রেন সামনে এগুতেই থাকে। ড্রাইভিং সিটে বসা ঐ দলিত নারী। 
:

https://web.facebook.com/logicalbengali/posts/1709763512591131:0

বুধবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

আঁচলের তলে বেড়ে ওঠা এক অকর্মণ্য সন্তানের (অ)কবিতা # ৬১



আঁচলের তলে বেড়ে ওঠা এক অকর্মণ্য সন্তানের (অ)কবিতা
:
আমার জীবনের বিবিধ প্রপঞ্চগুলো আলোকিত ঘনকের আকারে মা-ই সপ্তরঙা বানিয়েছেন। এটা কি বিস্ময়কর নয় যে, জীবনের প্রায় আধেক বেলা পশ্চিম দিগন্তে হেলে পরার পরও, মা'র আঁচলতলে বেঁচে থাকি আমি? জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই মার আঁচলে আবিস্কার করি নিজেকে প্রতিনিয়ত। কেবল স্কুলে বাজারে ঘুমোতে গেলেই আঁচল ছাড়তাম হয়তো্বা। স্নানও করতাম মার সা্থে তার আঁচল ধরে, এ জন্যে মার খেয়েছি বেশ কবার ভাইবোনের হাতে। ভার্সিটিতে পড়ার কালেও মা আর আমার প্রেমময়তা জেগে থাকতো সুদূর কদলীবনে হিরণ্ময় হরিণের মতো। নদীতীরের শিশিরাশ্রু বালুপথে মার আঁচলতলে পরজীবী প্রজাপতি হয়ে ওড়াউড়ি করতাম আমি প্রতিক্ষণে কতকাল কতদিন! এখন ধ্রুপদী সময়ের সিঁথিতে সিঁদুর হয়ে মা জেগে থাকে আমার হাতে তাঁর ছিন্ন আঁচলটি দিয়ে। বিশ্বের সর্বত্র আমি মার দেহজ ফুলের গন্ধ খুঁজে মরি পুরণো ক্ষয়িষ্ণু আঁচলটি ধরে-ধরে। কোলকাতার একুরিয়ামে স্বর্ণাভ বর্ণালী মাছের কেলিতে মায়ের আঁচলটি ভাসতে থাকে যখন, তখন দেহজ মেঘের বৃষ্টিরা জলজ চোখে নাচে সোনারঙ জলে ডু্ব দিয়ে দিয়ে। 
:
যাপিত জীবনের গার্হস্থ্যবেলায় যখন ঘুরতে যাই দক্ষিণ ভারতের Thrivananthapuram, তখন মাকে দেখি সৈকত বালুতে ওড়াতে তার অরঙ প্রজাপতি আঁচল, যা ধরে আছি আমি। সি-বিচ ছেড়ে সারিবদ্ধ কুয়াশাভরা পাতকুয়োয় দেখি মার আঁচলে সমুদ্র বাতাস নাচছে। অনামিকার যোধপুরের নগ্ন রেলক্রসিংয়ে মাকে দেখি জংশন মাস্টার হয়ে মৃত্তিকার ঘুমফুল মথিত করতে, মাটিতে আঁচল লুটিয়ে। আমার জীবন পথের পুরণো বিপর্যস্ত বাড়ির বুড়ো কঙ্কালের স্বপ্নবোনা রাতগুলো চিত্রনাট্য হয়ে উড়ে বেড়ায় মার আঁচলতলে। অপ্রতিভাবান আমি নিজ ব্যর্থতায় সহযোদ্ধা পেয়েছি মাকে সব রক্ষণাত্মক কিংবা আক্রমনাত্মক জীবন যুদ্ধে। ঈশ্বর ত্যাগি আমি মার আঁচল ত্যাগিনি কখনো, ধরে রাখি সর্বক্ষণ। তাই হয়তো তার আঁচলের গন্ধে এদেশ ছাড়তে পারিনি আমি বৈশ্বিক সব ভোগবাদি তাড়নায়ও। ফিরে আসি নিউজিল্যান্ড অস্ট্রেলিয়া ফ্রান্স কিংবা বুটেন ঘুরে এ হানাহানিপূর্ণ মননের কাঙালের দেশে। আর জীবনকে বাজি রেখে আঁচলের কথা ক্রমাগত লিখে যাই বোধহীন মৃত মানুষের মত। মা তোমার আঁচলটি কি মিশে গেছে মাটির সাথে, যে মাটি ছুঁয়ে যায় আমার ভাঙা মন প্রতিনিয়ত! অনেক দিন গত হওয়া মৃত মায়ের কাছে গেলে এখনো অবিকল তার রিণরিণে বাগ্বিধি শুনতে পাই, মৃত ধূসর ম্রিয়মান আঁচলতলে। 
:
বিষ্ণুদে, অমীয়চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ আর জীবনান্দের কবিতায় যখন খুঁজে মরি কলাকৈবল্যবাদ আর পাশ্চাত্য অনুসঙ্গের সব রূপসুষমা, তখন মার আঁচল প্রণোদনা দেয় আমায় বকফুল, ঘাসফুল, হিজলবন কিংবা ধূসর শালিকের উড়ে যাওয়া দিঘির টলটলে জলে। বোদলেয়ারের কাব্যনারীরা মার আঁচল হয়ে দাঁড়ায় হৃদপিন্ড বরাবর আমার! অ্যালেন গিন্সবার্গের কথায় মৌসুমী ভৌমিক যখন গাইতে থাকেন "শত শত চোখ আকাশটা দেখে, শত শত শত মানুষের দল, যশোর রোডের দুধারে বসত বাঁশের ছাউনি কাদামাটি জল" তখন হাজারো নাক্ষত্রিক ছুটে চলা মানুষের মাঝে মাঁয়ের আঁচল ধরা দেখি নিজেকে। আজ মায়ের মৃত্যুর দিনে আমার জীবন প্রান্তিকের হিসেবের খাতা ভরে ক্রমাগত লিখতেই থাকি লাল-নীল অক্ষরে মা-মাগো! 
:
পুনশ্চ !
:
[ কবিতা পোস্ট করিনা বলে অনেক ফেসবুক বন্ধুরা অনুযোগ করে আমায়। তাই মৃতদিবসে মাকে নিয়ে লিখলাম এ কবিতা। কিন্তু এটা কি কবিতা হলো, হলো কি গদ্য? হয়তো মাথামুণ্ডু কিছু্‌ই হয়নি। আসলে মায়ের আঁচলতলে মানুষ আমি। তাই আমায় দিয়ে কোন কিছু লেখা হবেনা কখনো কোনকালে। যতদিন ঐ আঁচল ধরে থাকবো আমি। হ্যা মা বেঁচে থাকলে নির্ভয়ে থাকতাম আমি পৃথিবীতে, লিখতাম শানিত ইস্পাতের মত। এমন কবিতা লিখতে পারতাম মার প্রণোদনায়, যা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিতো, ধ্বসে পড়তো সকল ধর্মান্ধ কবিতা, আর তাদের ধার্মিকতার মহাকাব্যগুলো। কারণ মা ছায়াময় বটবৃক্ষ হয়ে আগলে রাখতো আমায় এ জঙ্গীদের মাঝে, যেমন জঠরে রেখেছিল ন'মাস। মার বিকল্প আঁচল ধরতে পারি এ নারীর সন্ধান কেন পাইনি আমি আজো এ বিশ্বে? তাই কি আমি এমন অকর্মণ্য একটা মৃতমানুষ? যে পৃথিবী কাঁপানো কোন কবিতা লিখতে পারেনি আজো? ] 
:
গানের লিংক : 
মৌসুমী ভৌমিকের "শত শত চোখ আকাশটা দেখে, শত শত শত মানুষের দল, যশোর রোডের দুধারে বসত বাঁশের ছাউনি কাদামাটি জল"






https://www.facebook.com/logicalbengali/posts/1705969866303829





রবিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

অন্যায়ের দম্ভকে ভাঙো কাব্যের কালিতে সাজিয়ে দাও জ্ঞানের প্রাসাদ ! # ৬০

অন্যায়ের দম্ভকে ভাঙো কাব্যের কালিতে সাজিয়ে দাও জ্ঞানের প্রাসাদ !

সদ্য সমাপ্ত জেএসসি পরীক্ষা চলাকালে একটি বিভাগীয় শহরে যাই সরকারি কাজে। রাস্তায় বহু মানুষের জটলা দেখে "ইজি বাইক" থেকে উঁকি দিয়ে রাস্তায় রক্তাক্ত এক ১২/১৩ বছরের ফুটফুটে মেয়ে দেখে শিউরে উঠি আমি। নেমে জানতে পারি একটু আগে সাদিয়া আক্তার নামের এ জেএসসি পরীক্ষার্থী মেয়েটি পরীক্ষা দিতে যাওয়ার পথে ট্রাকের চাপায় মারা গেছে। সেও একটা ইজি বাইকে ছিল, অন্য গাড়ির ধাক্কায় তার বাইকটি কাত হয়ে পড়ে গেলে মেয়েটি পরে গিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে যায় কিন্তু হঠাৎ যমদূত হিসেবে একটা ট্রাক এসে খাতা কলম হাতের মেয়েটির মাথা থেতলে দেয় এবং তাৎক্ষণিকভাবে মেয়েটি প্রাণ হারায়। পথচারিরা ধাও্য়া করে ড্রাইভারসহ ট্রাকটি আটক করে পুলিশকে খবর দেয়।

মৃত্যু সংবাদ শুনে সবজি বিক্রেতা বাবাও ছুটে এসেছেন ঘটনাস্থলে। এক সময় পুলিশ এসে রাস্তা থেকে গাড়িতে রক্তাক্ত মেয়েটির লাশ তোলে পোস্ট মর্টেমের জন্যে। কিন্তু বিস্ময়করভাবে মেয়েটির বাবা সকল মানুষের সামনে পুলিশকে আপ্লুত কণ্ঠে বলতে থাকে, "আমার মেয়ের 'হায়াত' না থাকার কারণে সে মারা গেছে, তাই কোন ট্রাকের বিরুদ্ধে অভিযোগ বা পোস্টমর্টেম করাতে চাইনা আমি আমার মেয়েকে। আমি তাকে ধর্মীয় রীতিতে দাফন করতে চা্ই, আর আপনাদের থেকে আমার মেয়ের জন্যে দোয়া চাই"। অনেক পথচারীও তার কথাকে সাপোর্ট করলো ধ্বনি দিয়ে। নানা বাক বিতন্ডার পর এলাকার মানুষের হস্তক্ষেপে পুলিশ বাধ্য হলো বাবার হাতে সদ্য মৃত মেয়ের লাশ হস্তান্তরে।

আমি এক অসহায় বাবার সকরূণ আর্তি আর ভাগ্যের হাতে নিজেকে সমর্পণ, আর ১৩ বছরের অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া ঝকঝকে মেয়েটির অকাল মৃত্যু পরবর্তী ঘটনা রুদ্ধশ্বাসে দেখতে থাকি অবলীলায় পরাজিত সৈনিকের মত। তকদিরবাদী এ সমাজে মানুষের আর্তি আর বোধ আমাকে বার বার ধিক্কার দিতে থাকে মেয়েটির রাস্তায় শুকিয়ে যাওয়া রক্ত দেখিয়ে। কি সমাজ আর বোধের মাঝে আমরা বসবাস করছি তার ধিক্কারে আমি রক্তাক্ত হতে থাকি মেয়েটির মতই।

গতকাল ঐ সড়ক দিয়েই ঢাকা ফিরছিলাম আমি। আমার বাইকটি যখন মৃত মেয়েটির স্পটে এলো, প্রচণ্ড রোষে আমায় চেপে ধরলো সাদিয়া নামের মৃত মেয়েটি। সে সুষ্পষ্ট স্বরে আমার স্বরতন্ত্রী জ্বালিয়ে বলতেই থাকলো কোন এক নামহীন কবির অবোধ কথামালা। যা আমার নিউরনে বাজতে থাকে অনুক্ষণ এভাবে-

"সৃষ্টি দিয়ে ভাঙো, জীবনের অপূর্ণতা, জীর্ণ সংস্কারের খিলি, চন্দ্রবিন্দুর নদীতে। যেখানে ব্যর্থতা,গড়ে তোল চোখের বালি। সমাজ সংসারে, অন্যায়ের দম্ভকে, ভাঙো কাব্যের কালিতে, বদলে দাও সাজিয়ে দাও, জ্ঞানের প্রাসাদে, স্বপ্নের ডালিতে। ধরো সত্যের গান, রাখো মানির মান, বিবেকের ধারাপাতে, এক সাথে গাঁথা বর্ণ, বাঁধো তাঁতীর মতো জীবনের আদালতে। সংখ্যালঘু অন্যায়ের কারিগর, আকাশের থোকা কালো মেঘ, তন্দ্রা ছাড়ো, আঁখি মোছো, ভাঙো বিঘ্নের দ্বার, গড় মনে সত্য কথিকা। দিগন্তব্যাপী তীব্র প্লাবন আনো, শৃঙ্খলতায়, ন্যায়ের পক্ষে গান, বেপরোয়া অনিয়মের সিঁড়িঁ, বিদ্রোহ করো, রাখো কবিদের মান। তুমি কবি, লিখো কবিতা,মনে রঙ রাঙিয়ে সাহিত্যের রূপরসে জ্বলুক আগুন, উঠুক তুফান, কাব্যমনে, অন্যায় যেন যায় ধ্বসে। এ হোক দ্রোহি জীবনের গান।