শনিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৫

'জলাঙ্গি' মানব হয়েও 'জলদাস' কেন হইনি আমি ! [চলার পথের গল্প # ৬৫]

আমার দলিত জীবন দহন : ১
-----------------------------
'জলাঙ্গি' মানব হয়েও 'জলদাস' কেন হইনি আমি !
==============================
কৈশোরে আমার বাড়ির চারদিকে অনেক কুচকুচে কালো হিন্দু জেলে বাস করতো, যাদের 'জলদাস' বলতো সবাই। ঐ জেলেদের মাঝে শীতগাঁয়ের পরিচিত রোদের মুগ্ধতা মেখে চকচকে জলজীবনে বড় হয়েছি আমি। আনন্দের বোধেভরা জলকেন্দ্রিক এক অনন্য জীবন ছিল আমার। সুন্দরের পেয়ালায় জলচুমুতে দিনের ৩/৪-ঘন্টাই জলে কাটাতাম আমি। যে মাটির ঘ্রাণে বড় হয়েছি আমি, তাতে দক্ষ কৃষক কিংবা ঝড়ঝঞ্চার পেশিবহুল হাড়কালো জেলে হওয়ার কথা ছিল আমার। শ্যামলা ফিঙে রঙা আ্মি অল্পদিনেই নৌকো জীবনে পরিপূর্ণ তামাটে 'জলদাসে' পরিণত হতাম। কিন্তু মেধাবি মা আমায় 'জলদাস' হতে দিলো না; সুমির প্রেমিক হতে দিলোনা; সুতপার জনক হতে দিলোনা। অধিবিদ্যাা, নীতিবিদ্যা, তর্কবিদ্যা, ধর্মবিদ্যা, দর্শনবিদ্যা, মানববিদ্যা, মানবিকতাবিদ্যা ইত্যাকার নানাবর্ণীয় বিদ্যাগুলো শেখাতে জলমগ্ন জীবন থেকে নিয়ে এ্লো 'বিদ্যানগর' ঢাকাতে আমায়। নানা শাস্ত্রে বিদ্যাধারী হয়ে, শ্যামলে ফিঙে রঙ ছেড়ে উজ্জ্বল রঙা চাকুরি নামক দাসত্বের শৃঙ্খল গলায় পড়লাম আমি। সাথে যুক্তি, বিজ্ঞান, মুক্তি আর বোধের দু:খাতুর আত্মমৈথুনের সুখ-স্বপ্ন আঁকড়ে ধরলো আমায় অষ্টমার্গে। মাঝে সাঝে গাঁয়ে যেতাম যখন, গাঁয়ের কাপাসতুলোয় বোনা জীবনের ঘামগন্ধের অভীপ্সা জাগতো আমার মনে। ইচ্ছে হতো আশালতা সূর্যেকে সারথি করে দূর সমুদ্রে ভেসে যাই মাছ শিকারে; নেশাতুর বেসামাল বিটপের মত অঘোরে ঘুমোবো তামারঙা বুকখোলা জলদাসি নারীসঙ্গে হোগলা চাটাইয়ে। ভালবাসার বুদবুদ ঝড়োবাতাসে আপ্লুত জীবনের গান শোনাবে আমার সহ-জলদাসরা। মেঘনার জলরাক্ষস থেকে ছিনিয়ে আনবো যৌবনাশ্রুর ডুবন্ত জেলে নৌকো। বর্ষার ঘুর্ণিপাকে জলাঙ্গি প্রপাতে ধরবো ধাববান ইলিশ। আর ধীবর রমণিকুলের দেহজ অঙ্গের আভরণে খুঁজবো জীবনের সুখস্বপ্নের অন্নজল। অবসরে ক্লান্ত জীবনের গায়েন-বায়েন আর পটুয়া হয়ে আঁকবো জেলে জীবনের রক্তাভ জলপ্রপাতের চিত্র! মাঘের শীতে পোহাবো আগুনপোড়া ধান খড়ের ওম। জল আর রৌদ্রবাহী মেঘবাতাসে ভেসে বেড়োবো, প্রথম প্রেমের সুর-স্বপ্নের সুমিকে নিয়ে জলতলে। 
:
কিন্তু এসব প্রেমজশব্দ খসিয়ে, অন্বিত ভাললাগাকে দলিত করে, মার মতো এক স্বাধীন বৈশ্বিক নিখাঁদ মানুষ হলাম আমি। বৈশ্বিক মেধার অভিঘাত জ্বরে আক্রান্ত হয়ে, প্রজ্ঞার চাকুতে শান দিতে দিতে, আর সুখকে আঁকড়ে ধরতে, কত পথই ঘুরলাম আমি এ জীবন ট্রেনে। কিন্তু কোটি মানুষের ক্রূর ভোগ আর ধর্মান্ধ মনীষা আর বোধের দহনে পুড়েছি আমি সারাক্ষণ। ত্রস্ত ঈশ্বরের সৃষ্টিতত্ত্বে ভীত মানুষেরা, ঘাসরঙা মেঘের খোঁপায় ফুটতে দেয়নি আমার ভাললাগার চতুর্বণা ফুলগুলো। আমার সৃষ্টিশীলতা অন্ধকার নিখাঁদ সন্ত্রাসি ভয়ে হু-হু করছে বুকের ভেতর। এ বিজ্ঞান আর যুক্তির বসন্তেও, প্রজ্ঞার জীবন্ত শব্দগুলোকে কথার ভঙ্গুর সাঁকোয় পারাপার করতে পারিনি আমি। রাজনৈতিক বাঙলাদেশের ভাললাগার বধির বাতিঘরে প্র্জ্বলিত করতে পারিনি, সুন্দরের লিথিয়াম আলোকমালা। প্রাতের অমৃতসূর্য দুপুরে দেখাতে পারেনি তার মেঘভাঙা ঝিকিমিকি রোদ। 
:
তাই এ ধিকৃত জীবনে কষ্টফুলের গোপন পাঁপড়িরা জানতে চায় আমার কাছে, জলাঙ্গি মানব হয়েও জলদাস কেন হইনি আমি? অপ্রতিরোধ্য একাদিক্রমে নিজের কাছে বার বার জানতে চেয়েছি আমি, জলাঙ্গি মানব হয়েও জলদাস কেন হইনি আমি? তাহলে সুখ পেতাম, স্বপ্ন পেতাম, সুমি পেতাম, সুতপা পেতাম, আর পেতাম নীলাভ স্লিপিং পিলে অভিজাত ফ্লাটে ঘুমহীন বিষাদময় রাত্রির বদলে, সাঁওতালরঙা সুমির ভালবাসার ভোটকা মেছোগন্ধের দেহজ সুখের অনন্ত রাত!

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন