শনিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৫

মেঘনার লঞ্চডুবির ঘটনার পরবর্তী পর্ব বৃটেনের প্লিমাউথে [চলার পথের গল্প # ৬৪]

মেঘনার লঞ্চডুবির ঘটনার পরবর্তী পর্ব বৃটেনের প্লিমাউথে
===================================
[ একটি সত্যি ঘটনার বড়গল্প ]
:
২০০৬ সনে বৃটেনের প্লিমাউথের এক্সিটার ভার্সিটিতে Top Management and School Education শীর্ষক একটা প্রশিক্ষণে গিয়েছিলাম ক'মাসের জন্যে। ঐ ভার্সিটির College of St Mark & St John ক্যাম্পাসে ছিল আমাদের ক্লাস। ৫/৬-জন বৃটিশ টিচার নিয়মিত ক্লাস নিতেন আমাদের। Teacher Education & Research Center বিষয়ে বৃটিশ সোনালী চুল আর নীল চোখের এক তরুণি ক্লাস নিতেন নিয়মিত। সংক্ষেপে ক্লাস রুটিনে তার নাম লেখা ছিল MsRY। সব টিচারদের নামই এমন সংক্ষেপে লেখা খাকাতে টিচারদের আমরা RY, MT, ET নামেই চিনতাম, প্রকৃত নাম জানতাম না। আমরা বাংলাদেশি গ্রুপ শুনে MsRY একদিন ক্লাসে জানালেন তার নাম 'ঋতা ইয়াসমিন'। তার মা বাংলাদেশের চরফ্যাশানের এবং বাবা আইরিশ। অক্সফোর্ডে পড়তে এসে তার মা ভালবেসে বিয়ে করেছে তার বাবাকে, তাই মাও এখানের সিটিজেন। বৃস্টলে থাকে তার মা-বাবা। চাকুরিসূত্রে সে ডেভোনের এ্ প্লিমাউথে সাময়িক থাকছে এখন। বিয়ে করেনি এখনো, এমন কথা বললো হাসতে হাসতে প্রায় ত্রিশ বছরের ঋতা। নানা কথা প্রসঙ্গে জানালো টিচার MsRY যে, বেশ কবার মার সাথে বাংলাদেশে গিয়েছিল সে। একবার বাংলাদেশে ফেরি ডুবিতে বড় নদীতেও ডুবে গিয়েছিল মা ও সে তার ১০-বছর বয়সে। এক গ্রাম্য ছেলে নদী থেকে তুলেছিল সে আর তার মাকে মৃত্যুর কাছ থেকে। এরপরো প্রায় দেড় ঘন্টার পুরো ক্লাস MsRY নানা কথা বললেন ইংরেজি আর ভাঙা বাঙলায়। কি্ন্তু কিছুই আর বুঝতে পারিনি আমি। কি বলছে সে তার একটি শব্দও কানে ঢুকলো না আমার। আমি হারিয়ে গেলাম আমার কৈশোরে, আমার গাঁয়ে মেঘনার তীরে, যেখানে দুপুর বেলা চার-পাঁচশ মানুষ নিয়ে ডুবেছিল একটি লঞ্চ, আজ থেকে ১৮-১৯ বছর আগে। 
:
কুড়ি বছর আগের আমার গাঁয়ের কথা 
========================
আমার গ্রামীণ দেয়ালহীন স্কুলটি ছিল মেঘনার ঠিক তীরঘেষা। ক্লাসে বসে আমরা তাকিয়ে দেখতাম পালতোলা নৌকো, নানারঙের জাহাজ আর কত জলযান চলে যাচ্ছে এদিক থেকে ওদিকে। দক্ষিণ বাংলার ঢাকাগামি যাত্রীবাহি জলযানগুলো প্রায় সবই এ নদী দিয়ে আসা-যাওয়া করতো। বর্ষা মৌসুমে প্রবল জলঘুর্ণন আর ঢেউ জাগতো এ নদীর বুকে। 
:
সপ্তম শ্রেণির দুর্বোধ্য ইংরেজি ক্লাসে যখন Cow রচনা মুখস্ত না পারার কারণে কান ধরে বেঞ্চে দাঁড়িয়ে নদীর ঢেউ গুণছিলাম ক'জনা, ঠিক তখনই সিনেমার রোমাঞ্চকর দৃশ্যের মত ঢাকাগামি একটা যাত্রীবাহি লঞ্চ ডুবতে দেখলাম প্রবল ঢেউয়ে। মওকা পেয়ে কানধরা গ্রুপের সবাই প্রবল দৌঁড় দিলাম নদীতীরে। গাঁয়ে দক্ষ সাঁতারু হিসেবে ইতোমধ্যেই সুনাম অর্জন করেছিলাম আমি। কিন্তু পাহাড়সম প্রবল ঢেউ দমিয়ে দিলো আমায় প্রমত্ত এ মেঘনায় ঝাঁপ দিতে। কাছে নৌকোও ছিলনা যে নৌকো নিয়ে যাই উদ্ধারে! তাই হিরো হয়েও ঠায় দাঁড়িয়ে লঞ্চটির ডোবা দেখছিলাম ঔৎসুক ভিরু কিশোর হিসেবে। কিন্ত ২০১৫'র ফিউচার মানব-বাদিকে প্রমত্তা ঢেউ আর দমাতে পারলো না, যখন তার নজরে পড়লো, এক নারী জলতলে ডুবে যাচ্ছে, তার অল্পবয়সি মেয়েটি নিয়ে।
:
প্রবল স্রোতে ঝাঁপ দিয়ে আমি নির্বিঘ্নে পৌঁছুতে পারছিলাম না ঐ নারী আর তার শিশুকে উদ্ধার করতে। ঢেউ আমাকে বারবার বিচ্ছিন্ন করছিল তাদের নৈকট্যে যেতে। কি এক অমোঘ প্রজ্ঞায় আমি এবার ডুব দিলাম প্রবল স্রোত মাঝে। শরীরের সকল শক্তি একাকারে জলবাঁধাকে তুচ্ছ করে ঠিক মাথা তুললাম একদম ওদের শরীর ঘেষে। মাথা আর হাত দিয়ে ভাসিয়ে রাখলে চাইলাম নারী আর তার কন্যাকে। ডুবন্ত নারীর শরীর থেকে টেনে খুলে ফেললাম তার শাড়ি, যাতে সে ডুবে না যায়। প্রবল ঢেউ আর স্রোতে ৩-জনেই ডুবে যাচ্ছি দেখে, কলাগাছ কেটে, আর ছেঁড়া জাল নিয়ে কানধরা গ্রুপের ৪-কিশোর বন্ধু লাফিয়ে পড়লো জলে। কলাগাছ আর জাল ধরে ভেসে রইল ঐ নারী আর তার সাঁতার না জানা শহুরে কন্যা। আমরা ৫-জনে অনেক কষ্টে জলের সাথে লড়াই করে টেনে তুললাম তাদের বালির চরে। ক্লান্তিতে আমি শুয়ে রইলাম চোখবুজে বালিতে অনেকক্ষণ। বন্ধুরা উ্দ্ধার করলো আরো মানুষ, আর তাদের ভেসে যাওয়া নানাবিধ জিনিসপত্র। মৃত্যুতে আরো ভেসে গেল ৩০-জনের মতো, যাদের অধিকাংশ ছিল শাড়িপরা নারীরা। 
: 
আমার ডুবে যাওয়ার কথা শুনে মা কাঁদতে কাঁদতে বালুচরে এলো জেলে নৌকোতে। মাকে দেখেই উঠে বসলাম আমি, দৌঁড়ে জড়িয়ে ধরলো মা আমায়। বললো, কেন নামলি এতো স্রোত আর ঢেউর মাঝে? পাশের নারী আর তার কিশোরী মেয়েকে দেখিয়ে বললাম, না ধরলে ডুবে যেতো মা-মেয়ে। তাকিয়ে মা তার নিজ শাড়িতে ঢাকলো নারীর শাড়িহীন ভেজা দেহ। নৌকোতে ফিরলাম বিকেলে আমরা বাড়িতে, ঐ নারী আর তার মেয়েসহ। নৌকোতে বসেই মহিলা জানালেন, তারা বৃটেনে থাকে পুরো পরিবার। ভোলার চরফ্যাশানে বাবার বাড়ি তার। ৪/৫ দিন আগে মেয়েসহ চরফ্যাশন গিয়ে, ঢাকা ফিরছিলেন এ লঞ্চে। দুদিন পর বৃটেন ফিরে যাওয়ার কথা তাদের স্বামীর কাছে। মাকে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলেন মহিলা। বললেন, আপনার ছেলে না হলে দুজনেই এখন মরা লাশ হতাম। আমি একটু জানলেও, আমার মেয়ে সাঁতার জানেনা একটুও। ডুবে যা্চ্ছিল সে প্রায়, এ সময় আপনার ছেলেটি এলো ডুব দিয়ে আমাদের কাছে।
:
সুযোগ পেয়ে মা এবার তার 'একিলিস' 'হারকিউলিস' আর 'হেক্টর'সম ছেলের নানাবিধ প্রশংসা করলেন। আমি গদগদ হয়ে এই প্রথম লন্ডনি নারী আর কন্যার দিকে তাকালাম। আরে এ নারীতো অপ্সরির মত সুন্দরি, আর তার মেয়েটি একদম বিদেশিদের মত সোনালী চুলের। গ্রামে এমন ঝকঝকে মেয়ে একটিও দিখিনি আমি আগে। জীবনে এই প্রথম কোন নারীকে ভ্রু-প্লাগ করা, হাতা কাটা গেঞ্জি গায়ে এতো মোহনীয়রূপে দেখলাম আমি। তারা ৪-দিন রইলো আমাদের বাড়ি। জলে ডুবে ভয় পেয়েছিল খুব, জ্বর হয়েছিল মা মেয়ের দুজনেরই রাতে। কিছুই ছিলোনা তাদের। আমার মা নিজ শাড়ি পরতে দিয়েছিল ঐ মহিলাকে। মেয়েটি আমার ছোট বোনের গ্রাম্য তাঁতশাড়ি পড়েছিল দুদিন। জ্বর কমলে ওদের নিয়ে পুরো গাঁ ঘুরে বেড়িয়েছেন আমার মা, সাথে থাকতাম আমিও প্রাণদায়ী বীর হিসেবে। ওদের কারণে দুদিন স্কুলে যাইনি আমি, এ এক মহাপ্রাপ্তি। খবর পেয়ে তার ভাইরা ৩-দিন পর আসে আমাদের গাঁয়ের বাড়ি একটা ট্রলার ভরে ১০-১২ জনের দল। বিয়ে বাড়ির মত আমাদের বাড়িতে উৎসব হয়েছিল সেদিন। খাসি, মুরগি আর মহিষের ঘন দধিতে হাত ডুবিয়ে খেলাম সবাই। ৪-দিন পর ঐ নারী আর তার মেয়েকে তুলে দিতে গেলাম আমরা দুপুরের ঢাকাগামি লঞ্চে সবাই। মহিলাটি কেঁদেছিল আমার মাকে জড়িয়ে অনেকক্ষণ। বিদায়ের প্রাক্কালে আমার হাত ধরে বলেছিল, আমি যেন ঠিকমত পড়ালেখা করি, তাহলে লন্ডন বেড়াতে নেবে আমায়। ঋতা নামের মেয়েটি অশ্রুসজল চোখে আমায় জড়িয়ে ধরে ভাঙা বাংলায় বলেছিল, তোমার জন্যই বাঁচলাম আমি। থ্যাংকু বন্ধু। আমি মনে রাখবো চিরদিন তোমায়! বিদায়ক্ষণে ওদের বাঁচানোর আনন্দে কেঁদেছিলাম আমি, যতক্ষণ দেখা গিয়েছিল লঞ্চটি, ততক্ষণ ঐ দিকে তাকিয়ে থেকে অশ্রু ঝরেছিল আমার।
:
আর যো্গাযো্গ বা দেখা হয়নি ওদের সাথে আমাদের। একটা বিচ্ছিন্ন চরের মানুষদের সাথে যোগাযোগ হয়তো জটিল ছিল তাদের জন্যে। কিংবা তখন মোবাইলের যুগ ছিল না। আ্মাদের ডাক ঠিকানাও নেয়নি তারা, হয়তো ভুলে গিয়েছিল লঞ্চ ডোবার স্মৃতি কিংবা কি কারণ জানিনা আমি। আমরা ভুলে গিয়েছিলাম তাদের, যেমন তারা ভুলে গিয়েছিল আমাকে, আমাকে মাকে, আর আমার গাঁ-কে।
:
ক্লাস শেষে MsRY কখন চলে গেল জানিনা। সহপাঠী অন্যেরাও চলে গেছে অনেকক্ষণ। লাঞ্চ আওয়ার শেষ করে কৈশোরের কুসুমপুরেের উচ্ছ্বাস নিয়ে বেড়ুলাম ক্লাস থেকে। পশ্চিম বৃটেনের বরফাচ্ছন্ন প্লিমাউথের পিচ্ছিল ভেজা পথ ধরে যখন একাকি হাঁটছি ডরমেটরির দিকে, ক্ষীণকায় পোয়াতি কুকুরের প্রসবের কষ্টের মত একটা কষ্ট ঘিরে ধরলো আমায়। প্রাক সন্ধ্যায় খোঁজ নিতে গেলাম MsRY এর স্টুডেন্ট সেন্টারে। তথ্য ঘেটেঘুটে তারা জানালো, ক্যাম্পাসে থাকেনা ঐ টিচার। প্লিমথ শহরের একটা ফ্লাটের ঠিকানা দিলো আমায়, সাথে ফোন নম্বর। কয়েন ফেলে ফোন করলাম টিচার রিতাকে। দেখা করতে চাই তার সাথে বাসায় এমন কথা বললাম। কিন্তু ঘন তুষারপাতে বের হতে নিষেধ করলেন তিনি। বললেন জরুরি কথা থাকলে কাল ক্লাসে দেখা হবে আমাদের, তখন যেন বলি। ফোন রেখে দিলাম। বরফের ভেতর পা ডুবিয়ে হেঁটে এলাম রুমে। ভেতরে পেজা তুলোর মত তুষার গুড়ো ঢুকেছে জুতোয়। দরজার পাশে এসে আবার বরফ ভেঙে কয়েন ফেললাম ফোনে। বললাম, ম্যাম তোমার মায়ের ফোন নম্বরটা চাই, দেবে? কেন জানতে চাইলো সে। বললাম বিশেষ দরকার, পরিচিত আমার খুব। ঋতা অকুটিল সরলতায় ফোন নম্বর দিলো মায়ের। বৃস্টলে ফোন লাগালাম আমি তখনই। দু-বারের চেষ্টায় ঋতার মাকে পেলাম ফোনে। পাঁচ মিনিটের মাথায় বোঝাতে সক্ষম হলাম আমি কে, আর কিভাবে এখন ডেভোনের প্লিমাউথে। ফোন কাঁপিয়ে তখনই পারলে ঝাপটে ধরে ঋতার মা আমায়। ঋতাকে কেন এ কথা বলিনি তাও বারবার জানতে চাইলো আমার কাছে। পকেটে আর কয়েন না থাকাতে কেটে গেলো লাইনটা। এবার ইচ্ছেমত তুষারে পা ডুবিয়ে, গা ভিজিয়ে বরফে ঢেকে দিতে চাইলো মনটা। কিশোরের মত দৌঁড়ালাম অনেকক্ষণ ডরমেটরির চারদিকে। ই্চ্ছে হলো বরফে ঢাকা রডোডেনড্রেন গাছটাকে ছাড়িয়ে দেই শক্ত বরফ থেকে, যাতে বেড়োতে পারে তার নতুন কুঁড়ি, যেটি আটকে আছে অনেক দিন শক্ত বরফে! 
:
১০-টায় ক্লাস ছিল আমাদের। তাই তাড়া ছিলনা ওঠার। নটায় কফির জন্যে দুধ মিশ্রিত পানি দিলাম চুলোয়। টিভি অন করে চ্যানেল ঘুরাচ্ছি এমন সময় দরজায় ঠক-ঠক শন্দ। খুলতেই দেখি ঋতা ম্যাডাম। কেবল জানতে চাইলো, আমি সেই কিনা! হ্যা সূচকে মাথা নাড়াতেই জড়িয়ে ধরলো আমায়। রুম কাঁপিয়ে চিৎকার শুরু করলো ঝংকৃত হাসিতে। তার হাসি আর চিৎকারে পাশের রুমের সবাই ছুটে এলো। ঋতা ব্যখ্যা করলো সবাইকে আমার কুড়ি বছর আগের হিরত্ব আর বিরত্বের কাহিনি। 
:
দেখতে দেখতে সরকারি প্রশিক্ষণ শেষ হলো আমাদের। এবার ফেরার পালা। প্লিমাউথ থেকে ৬০০কিমি দুরে লন্ডনে ফিরবো আমরা। আধুনিক বাস নিয়ে যাবে আমাদের লন্ডনে, সেখান থেকে দুদিন পর ফ্লাইট। ঋতার মার অনুরোধ, যাওয়ার পথে যেন বৃস্টলে নামি আমি সেখানে তার বাড়ি। ঋতাও যাচ্ছে আমার সাথে তার বাড়িতে। সারাপথ ঋতা আর আমি পাশাপাশি সিটে বসলাম। নানা কথা, গল্প, আর হাসিতে মাতিয়ে রাখলো ঋতা আমায়। বৃস্টল হাইওয়ের কফিশপে ঋতার মা বাবা অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্যে। বাস থামতেই ওর মা আর বাবা জড়িয়ে ধরলো আমায়। কাঁদলো প্রকাশ্যে সবার সামনে। আমার লাগেজপত্র নিজেরা নামিয়ে তুললো নিজ গাড়িতে। বাড়ি না পৌঁছানো অবধি সারাপথ কথা বললো ওর মার অব্যাহত গতিতে। কেন যোগাযোগ করতে পারলোনা এতদিনে, তারও নানাবিধ ব্যাখ্যা দিলো সে। আমাকে দেখে সে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর কিছু দেখছে, এ কথা বলতেও ভুললেন না তিনি।
:
ঐদিনসহ পরের পুরো দিনই রইলাম ঋতাদের বৃস্টলের বাড়িতে আমি। পারলে পুরো বৃটেনের সব সুখ কিনে দেয় আমায় ঋতা, তার মা, আর বাবা। লং ড্রাইভে বৃটেনের "ল্যান্ডসএন্ড"-এ নিয়ে যায় আমায়, ঘুরিয়ে দেখায় কত কি? সখে লাগানো নিজের বাগানের 'এ্যাসপারাগাছ' আর 'সিলারি' তুলে আনে ঋতা আমার জন্যে। মনে হলো ঋতাও চলে আসবে বাংলাদেশে আমার সাথে। ওদের ভালবাসায় মুগ্ধ হই আমি। ভাবতে থাকি পৃথিবীতে জন্মের পর যত কাজ করেছি আমি, সম্ভবত এর মাঝে শ্রেষ্ঠতর সুখকর কাজটি ছিল ঋতা আর তার মাকে টেনে তোলা। জীবনের শ্রেষ্ঠতর রাতটি শেষ হলো আমার। এবার পরিকল্পনা মোতাবেক আমাকে সরাসরি হিথরো নিয়ে আসবে ঋ্তার পরিবার। 
:
৪-ঘন্টা লং ড্রাইভ করলো ঋতা আর তার মা ভাগাভাগি করে। বাবা গাড়ি চালান না এখন চোখের প্রবলেমে। আমরা সরাসরি হিথরোর ২-নম্বর টার্মিনালে ঢুকলাম, যেখানে মিট করবো আমি আমার গ্রুপ মেম্বারদের সাথে, যারে বাসে চলে এসেছিল দুদিন আগে লন্ডনে। বোর্ডিং করে লাগেজপত্র সব দিয়ে ইমিগ্রেশনে ঢোকার আগে, এয়ারপোর্টে ক্যাফেতে নিয়ে গেলে ঋতার পরিবার আমাদের গ্রুপের সবাইকে। একটা ছোট্ট অনুষ্ঠানের মত আয়োজন। শেষ বিদায়ের চা-চক্র। ১০-মিনিটের এ চা-চক্রে আবার ঋতার মা আর ঋতা আমার পরিচয় তুলে ধরলো এক 'সাহসি মহাবীর' হিসেবে। একে একে গ্রুপের অন্যদেরও পরিচয় করালেন সবার সাথে। শেষে মূহূর্তে ক্যাফেতে ঢুকলো বাঙালি বৃটিশ ঝকমকে চেহারার এক যুবক। এসেই 'হাই ডার্লিং' বলে জড়িয়ে ধরে প্রায় কোলে করে উপরে তুলে ফেললো ঋতাকে। ঋতার মা ঐ যুবকের কাছেও তুললো ধরলো আবার আমার তথাকথিত "মহামানবীয়" পরিচয় এবং সাথে তার পরিচয়ও। 'টমাস ইব্রাহিম' হচ্ছে ঋতার ফিঁয়াসে তথা প্রেমিক। পেশাগত ব্যস্ততার জন্য আসতে দেরি হয়েছিল তার। আগামি বসন্তে মানে দুমাস পর ঋতার সাথে বিয়ে হবে টমাসের মুসলিম রীতিতে। ঋতা আর টমাস এখন এক ফ্লাটেই থাকে। কেবল ছয়মাসের জন্যে ঋতা গিয়েছিল এক্সিটার ভার্সিটিতে, যা শেষ হবে আর ১-মাস পরই। তখন ঋতা চলে আসবে লন্ডনে টমাসের কাছে।
:
বিদায় দিতে প্রায় টারমাকের কাছাকাছি চলে আসে ঋতা, টসাম, তার মা, আর বাবা। টমাস বৃটিশ ক্যালিডোনিয়ান এয়ারের পাইলট, তাই সিঁড়ি পর্যন্ত আসতে পারলো তারা। বোর্ডিং ব্রিজে পা রাখার প্রাক-মূহূর্তে ঋতা আর তার মা এবার জড়িয়ে ধরে আমায়। অঝোড়ে কাঁদতে থাকে দুজনে আমায় জড়িয়ে। আমি আর সামলাতে পারিনা নিজেকে। পৃথিবীর সকল শোঁক এসে এক অনন্ত ভালবাসায় ঋণী করে বুক ভেঙে দেয় আমার। কষ্টদ্রোহে জীবনের ণত্ব-ষত্ব, প্রকৃতি আর প্রত্যয়জ্ঞান ভুলে যাই আমি। ওদের ভালবাসার ঘনিষ্ঠ বিষক্রিয়ায় মরে যেতে ইচ্ছে হয় আমার। ককপিট ভেঙে বিজনেস ক্লাসের প্রথম সারিতে বসে গ্লাসের ফোকড়ে ষ্পষ্ট দেখি আমি ঋতা পরিবারকে। কৈশোরিক আনন্দ স্কুলের শৃঙ্খলিত ঘণ্টায় বেজে ওঠা শব্দের মাঝে ঋতা আর তার মাকে প্রচণ্ড জলঘুর্ণাবর্তে আঁকড়ে ধরি আমি। দু:খ কাচামালে গলিত স্বর্ণনির্মিত পাত্রে মা-মেয়েকে ভালবাসতে ইচ্ছে করে আমার। কিন্তু হঠাৎ তাবৎ বিমর্ষতা, সমস্ত মলিনতার মাঝে বেদনার সুসুপ্তির গন্ধেমাখা সুন্দরেরা পালিয়ে যায় এ নভোযান থেকে। আকাশের হিম তারা সকল পরিপূর্ণা অঘ্রাণের এক রোদ হয়ে আমায় বলে, পুরাণো জন্মের ঋণ শোধ হয়েছে এবার, চলো ফিরে যাই জলদাস সমাজে। 
:
লাল নীল বর্ণালী মেঘ কেটে কেটে বিমান এগুতে থাকে ঢাকার দিকে, প্রসারণশীল এই নক্ষত্রখচিত আকাশে সুখের বহতা বাতাসের একগুচ্ছ আনন্দ শ্লোক আমায় হাতছানি দেয় দূর নক্ষত্র থেকে, আর বলে মহাকাশীয় নক্ষত্র ঘাসফুলে তুমি চলে এসো, ভাললাগার শ্বাসরুদ্ধকর নভোখেয়ায় তুমি ঘুরে বেড়াবে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে। বিমান যতই ঢাকার দিকে এগুতে থাকে, সুখের আকাশছোঁয়া এক মহাকাশীয় জ্বলন্ত চুল্লিতে প্রবেশ করি আমি, যেখানে অবিস্মরণিয় ভুলেরা দৌঁড়োয় সুখ মথিত করে মেঘরাজ্যে, তারার রাজ্যে, নক্ষত্ররাজ্যে !




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন