মঙ্গলবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

দলিত নারীর সাথে জীবন দহনের ঈদ যাপন [চলার পথের গল্প # ৬২

 দলিত নারীর সাথে জীবন দহনের ঈদ যাপন
:
কোলকাতা এসেছি গত ১৮ তারিখ প্রাগৈতিহাসিক দু:খগুলো ভুলতে । কথা ছিল মুর্শিদাবাদে ঈদের দিন কাটাবো কিন্তু ফেসবুক বন্ধুর মা মারা গেলেন পরশু হঠাৎ। অন্যজন আবার একইসাথে জন্ডিস আর টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি জটিল অবস্থায়। তাই মানবতার ঝান্ডাটি উড়িয়ে হাজার দুয়ারি এক্সপ্রেেসে বসলাম মুর্শিদাবাদের পথে। বিকেলে ফিরছি লালগোলা এক্সপ্রেসে। প্রায় খালি ট্রেনে আনন্দবাজারে পড়ছিলাম মক্কায় "আল্লাহর মেহমানদের" করুণ মৃত্যুুর খবর। বেলডাঙা থেকে এক অরূপসি নারী তার ৪/৫ বছরের সন্তান নিয়ে পাশে বসলেন আমার। প্রথমে নজর পড়েনি হঠাৎ রিণরিণে কান্নার শব্দ শুনি তাকিয়ে দেখি কাঁদছে ঐ নারী। পাশের সব যাত্রীরা জানতে চাইলো কান্নার কারণ। অনেক কথা বললো নারী, যার মর্মার্থ হচ্ছে স্বামী নামক পুরুষটি নেশাগ্রস্থ অবস্থায় তাকে মারধর করে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। এ পৃথিবীতে ঐ নারীর মা-বাবা, ভাইবোন কেউ নেই। তাই স্বামীর অত্যাচারে ঘর থেকে বের হয়ে ট্রেনে উঠে বসেছে সে শিশুসহ অজানার উদ্দেশ্যে। জানেনা সে কোথায় যাবে।
:
সবাই বোঝালো তাকে স্বামীর ঘরে ফিরে যেতে কিন্তু কিছুতেই যাবেনা সে। পলাশী থেকে বেলডাঙা পর্যন্ত প্রায় সবাই পরিচিতজন। অবশেষে ভয় দেখালো পরিচিত যাত্রীরা কোলকাতা গিয়ে কোথায় উঠবে সে? শিশুসহ বিপদে পড়বে সে নির্ঘাৎ। বার বার রক্তলাল চোখ মুছে অবশেেষে সিস্ধান্ত হলো বেলডাঙার দোকানি "সুব্রত" নিয়ে যাবে তাকে বেলডাঙা। ওঠাবে তার নিজ ঘরে। খবর দিয়ে আনবে স্বামীকে। তারপর মেলানোর চেষ্টা। সব শুনে কি করবো বিদেশী আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। ঢাকা হলে পুলিশ নিয়ে ধরে আনতাম দলিত নারীটির স্বামীটিকে। মামলা ঠুকে দিতাম ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে। কিন্তু এখানে অসহায় অবস্থায় কেবল শুনছি সব কিছু।
:
যাত্রীদের ইচ্ছেতে নারীটিকে নিয়ে নামলো "সুব্রত" কৃষ্ণনগর জংশনে। সে এখন অপমানিত নারীটির ঘর জোড়া দেয়ার চেষ্টা করবে। তাই ফিরে যাবে তারা বেলডাঙাতে ঐ নারী আর সুব্রতর বাড়ি। কিন্তু আমার নিজের সাথে যুদ্ধ শুরু হলো আমার। প্রতারণায় পড়বে নাতো নারীটি? কি করবো এখন? নারীটি কি সামনে এগিয়ে গিয়ে বিপদে পড়বে নাকি পেছনে গিয়ে? কৃষ্ণনগর ছাড়লো আমাদের ট্রেন নারী আর সুব্রতকে রেখে। দু:স্বপ্নের ভয়ে নির্ঘুম রাতের মত কষ্টকর সময় কাটছে আমার।
:
ট্রেন যতই এগুলো থাকে সামনে, বিবর্তিত পৃথিবীর ভূ-গোলকে আমি ঐ নাম না জানা নারীটিকে নিয়ে ভাবতে খাকি ক্রমাগত। মানবিক বিপন্ন বোধের ব্যাকরণে আমি মেলাতে পারিনা কোন সুত্র। অচেনা ঐ নারী আর তার সন্তানের জন্যে ক্ষীণ ভালবাসার প্রেমজ মধুরতা জাগে আমার মনে। আমি যতই অপলক দূর-দিগন্তে চোখ রাখি, ততই হৃদ মননে প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাস হয়ে ঐ নারী আমার সামনে কাঁদতে থাকে। সমগ্র পৃথিবীর প্রাগৈতিহাসিক গল্পগুলোর মাঝে এ নারী এক অনন্য চরিত্রে খেলা করে হৃদ মননে আমার। 
:
ক্রমাগত সন্ধ্যার আঁধারে দমদম জংশনে ঢোকার আগেই ট্রেন দাঁড়িয়ে যায় হঠাৎ। চোখ ঝলসানো আলো জ্বালিয়ে, আর তীব্র হুইসেল বাজিয়ে দ্রুতগামি এক ট্রেন লালগোলা এক্সপ্রেসের পাশ দিয়ে ছুটে আসে আকস্মিক । এক অশরিরী হাত হঠাৎ জানালা দিয়ে আমায়ে টেনে নিয়ে যায় ঐ কালান্তরের ট্রেনে। প্রচন্ড রোষে সব স্টেশন পাস কাটিয়ে ট্রেনটি ছুটতে থাকে বহরমপুরের দিকে। লাইনে দাঁড়ানো সব দুরপাল্লার, এক্সপ্রেস, প্যাসেঞ্জার, লোকাল ট্রনগুলো দ্রুত সরে গিয়ে কালান্তর ট্রেনকে ট্রাক ছেড়ে দেয়। যাত্রীহীন ঐ ট্রেনের ইঞ্জিনরুমে আমি আর ঐ অশরিরী মানুষ কেবল ছুটতে দেখি সমস্ত স্টেশন আর যাত্রী। যেন ট্রেনটি দিকচক্রবালে উড়ে যেতে থাকে যুদ্ধ বিমানের মত। এক সময় পলাশীর কাছে গিয়ে ঐ নারীর পাশাপাশি চলতে থাকে কালান্তর ট্রেন। একইভাবে সে জানালা দিয়ে টেনে আনে শিশুসহ ঐ নারীকে। চালকের আসনে বসায় তাকে। ছুটে চলছে কালান্তর ট্রেন পাশে আমি, শিশু, অশরিরী মানুষ আর নারী। 
:
প্রচণ্ড আলোকময়তায় ষ্পষ্ট দেখি আমি ট্রাকের ওপর একটা মানুষ। মানুষটি ঐ নারীটির স্বামী। তাকে ধরে এনেছে ঐ অশরীরি। নারীটি থামাতে চায় ট্রেনটি। কিন্তু অশরিরী দৃঢ়তায় বলে, চালিয়ে যাও ট্রেন থামালে বিপদ আছে তোমার। এবার চোখের জলরক্ত মুছে নারীটি ট্রেনের গতি আরো দ্রুততর করে। ঝড়োবেগে ট্রেন এগিয়ে যায় নাম না জানা নারীর স্বামীকে দ্বিখন্ডিত করে। তারপরো ট্রেন থামেনা। ঝরাপাতা কুয়াশায় হিম বিষণ্ণতা এড়িয়ে ট্রেন সামনে এগুতেই থাকে। স্বাপ্নিক দৃষ্টিভ্রমে উড়ে চলা ট্রেন যাত্রী হয়ে দু:খের যাপিতকালে ফিরে যেতে চাই আমি। আমার চোখ ঝাপসা হয়। কিছুুই নজরে পরেনা আমার। দু:খ জলের ন্যুব্জতা ভেঙে প্রচণ্ড রোষে কালান্তরের ট্রেন সামনে এগুতেই থাকে। ড্রাইভিং সিটে বসা ঐ দলিত নারী। 
:

https://web.facebook.com/logicalbengali/posts/1709763512591131:0

বুধবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

আঁচলের তলে বেড়ে ওঠা এক অকর্মণ্য সন্তানের (অ)কবিতা # ৬১



আঁচলের তলে বেড়ে ওঠা এক অকর্মণ্য সন্তানের (অ)কবিতা
:
আমার জীবনের বিবিধ প্রপঞ্চগুলো আলোকিত ঘনকের আকারে মা-ই সপ্তরঙা বানিয়েছেন। এটা কি বিস্ময়কর নয় যে, জীবনের প্রায় আধেক বেলা পশ্চিম দিগন্তে হেলে পরার পরও, মা'র আঁচলতলে বেঁচে থাকি আমি? জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই মার আঁচলে আবিস্কার করি নিজেকে প্রতিনিয়ত। কেবল স্কুলে বাজারে ঘুমোতে গেলেই আঁচল ছাড়তাম হয়তো্বা। স্নানও করতাম মার সা্থে তার আঁচল ধরে, এ জন্যে মার খেয়েছি বেশ কবার ভাইবোনের হাতে। ভার্সিটিতে পড়ার কালেও মা আর আমার প্রেমময়তা জেগে থাকতো সুদূর কদলীবনে হিরণ্ময় হরিণের মতো। নদীতীরের শিশিরাশ্রু বালুপথে মার আঁচলতলে পরজীবী প্রজাপতি হয়ে ওড়াউড়ি করতাম আমি প্রতিক্ষণে কতকাল কতদিন! এখন ধ্রুপদী সময়ের সিঁথিতে সিঁদুর হয়ে মা জেগে থাকে আমার হাতে তাঁর ছিন্ন আঁচলটি দিয়ে। বিশ্বের সর্বত্র আমি মার দেহজ ফুলের গন্ধ খুঁজে মরি পুরণো ক্ষয়িষ্ণু আঁচলটি ধরে-ধরে। কোলকাতার একুরিয়ামে স্বর্ণাভ বর্ণালী মাছের কেলিতে মায়ের আঁচলটি ভাসতে থাকে যখন, তখন দেহজ মেঘের বৃষ্টিরা জলজ চোখে নাচে সোনারঙ জলে ডু্ব দিয়ে দিয়ে। 
:
যাপিত জীবনের গার্হস্থ্যবেলায় যখন ঘুরতে যাই দক্ষিণ ভারতের Thrivananthapuram, তখন মাকে দেখি সৈকত বালুতে ওড়াতে তার অরঙ প্রজাপতি আঁচল, যা ধরে আছি আমি। সি-বিচ ছেড়ে সারিবদ্ধ কুয়াশাভরা পাতকুয়োয় দেখি মার আঁচলে সমুদ্র বাতাস নাচছে। অনামিকার যোধপুরের নগ্ন রেলক্রসিংয়ে মাকে দেখি জংশন মাস্টার হয়ে মৃত্তিকার ঘুমফুল মথিত করতে, মাটিতে আঁচল লুটিয়ে। আমার জীবন পথের পুরণো বিপর্যস্ত বাড়ির বুড়ো কঙ্কালের স্বপ্নবোনা রাতগুলো চিত্রনাট্য হয়ে উড়ে বেড়ায় মার আঁচলতলে। অপ্রতিভাবান আমি নিজ ব্যর্থতায় সহযোদ্ধা পেয়েছি মাকে সব রক্ষণাত্মক কিংবা আক্রমনাত্মক জীবন যুদ্ধে। ঈশ্বর ত্যাগি আমি মার আঁচল ত্যাগিনি কখনো, ধরে রাখি সর্বক্ষণ। তাই হয়তো তার আঁচলের গন্ধে এদেশ ছাড়তে পারিনি আমি বৈশ্বিক সব ভোগবাদি তাড়নায়ও। ফিরে আসি নিউজিল্যান্ড অস্ট্রেলিয়া ফ্রান্স কিংবা বুটেন ঘুরে এ হানাহানিপূর্ণ মননের কাঙালের দেশে। আর জীবনকে বাজি রেখে আঁচলের কথা ক্রমাগত লিখে যাই বোধহীন মৃত মানুষের মত। মা তোমার আঁচলটি কি মিশে গেছে মাটির সাথে, যে মাটি ছুঁয়ে যায় আমার ভাঙা মন প্রতিনিয়ত! অনেক দিন গত হওয়া মৃত মায়ের কাছে গেলে এখনো অবিকল তার রিণরিণে বাগ্বিধি শুনতে পাই, মৃত ধূসর ম্রিয়মান আঁচলতলে। 
:
বিষ্ণুদে, অমীয়চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ আর জীবনান্দের কবিতায় যখন খুঁজে মরি কলাকৈবল্যবাদ আর পাশ্চাত্য অনুসঙ্গের সব রূপসুষমা, তখন মার আঁচল প্রণোদনা দেয় আমায় বকফুল, ঘাসফুল, হিজলবন কিংবা ধূসর শালিকের উড়ে যাওয়া দিঘির টলটলে জলে। বোদলেয়ারের কাব্যনারীরা মার আঁচল হয়ে দাঁড়ায় হৃদপিন্ড বরাবর আমার! অ্যালেন গিন্সবার্গের কথায় মৌসুমী ভৌমিক যখন গাইতে থাকেন "শত শত চোখ আকাশটা দেখে, শত শত শত মানুষের দল, যশোর রোডের দুধারে বসত বাঁশের ছাউনি কাদামাটি জল" তখন হাজারো নাক্ষত্রিক ছুটে চলা মানুষের মাঝে মাঁয়ের আঁচল ধরা দেখি নিজেকে। আজ মায়ের মৃত্যুর দিনে আমার জীবন প্রান্তিকের হিসেবের খাতা ভরে ক্রমাগত লিখতেই থাকি লাল-নীল অক্ষরে মা-মাগো! 
:
পুনশ্চ !
:
[ কবিতা পোস্ট করিনা বলে অনেক ফেসবুক বন্ধুরা অনুযোগ করে আমায়। তাই মৃতদিবসে মাকে নিয়ে লিখলাম এ কবিতা। কিন্তু এটা কি কবিতা হলো, হলো কি গদ্য? হয়তো মাথামুণ্ডু কিছু্‌ই হয়নি। আসলে মায়ের আঁচলতলে মানুষ আমি। তাই আমায় দিয়ে কোন কিছু লেখা হবেনা কখনো কোনকালে। যতদিন ঐ আঁচল ধরে থাকবো আমি। হ্যা মা বেঁচে থাকলে নির্ভয়ে থাকতাম আমি পৃথিবীতে, লিখতাম শানিত ইস্পাতের মত। এমন কবিতা লিখতে পারতাম মার প্রণোদনায়, যা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিতো, ধ্বসে পড়তো সকল ধর্মান্ধ কবিতা, আর তাদের ধার্মিকতার মহাকাব্যগুলো। কারণ মা ছায়াময় বটবৃক্ষ হয়ে আগলে রাখতো আমায় এ জঙ্গীদের মাঝে, যেমন জঠরে রেখেছিল ন'মাস। মার বিকল্প আঁচল ধরতে পারি এ নারীর সন্ধান কেন পাইনি আমি আজো এ বিশ্বে? তাই কি আমি এমন অকর্মণ্য একটা মৃতমানুষ? যে পৃথিবী কাঁপানো কোন কবিতা লিখতে পারেনি আজো? ] 
:
গানের লিংক : 
মৌসুমী ভৌমিকের "শত শত চোখ আকাশটা দেখে, শত শত শত মানুষের দল, যশোর রোডের দুধারে বসত বাঁশের ছাউনি কাদামাটি জল"






https://www.facebook.com/logicalbengali/posts/1705969866303829





রবিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

অন্যায়ের দম্ভকে ভাঙো কাব্যের কালিতে সাজিয়ে দাও জ্ঞানের প্রাসাদ ! # ৬০

অন্যায়ের দম্ভকে ভাঙো কাব্যের কালিতে সাজিয়ে দাও জ্ঞানের প্রাসাদ !

সদ্য সমাপ্ত জেএসসি পরীক্ষা চলাকালে একটি বিভাগীয় শহরে যাই সরকারি কাজে। রাস্তায় বহু মানুষের জটলা দেখে "ইজি বাইক" থেকে উঁকি দিয়ে রাস্তায় রক্তাক্ত এক ১২/১৩ বছরের ফুটফুটে মেয়ে দেখে শিউরে উঠি আমি। নেমে জানতে পারি একটু আগে সাদিয়া আক্তার নামের এ জেএসসি পরীক্ষার্থী মেয়েটি পরীক্ষা দিতে যাওয়ার পথে ট্রাকের চাপায় মারা গেছে। সেও একটা ইজি বাইকে ছিল, অন্য গাড়ির ধাক্কায় তার বাইকটি কাত হয়ে পড়ে গেলে মেয়েটি পরে গিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে যায় কিন্তু হঠাৎ যমদূত হিসেবে একটা ট্রাক এসে খাতা কলম হাতের মেয়েটির মাথা থেতলে দেয় এবং তাৎক্ষণিকভাবে মেয়েটি প্রাণ হারায়। পথচারিরা ধাও্য়া করে ড্রাইভারসহ ট্রাকটি আটক করে পুলিশকে খবর দেয়।

মৃত্যু সংবাদ শুনে সবজি বিক্রেতা বাবাও ছুটে এসেছেন ঘটনাস্থলে। এক সময় পুলিশ এসে রাস্তা থেকে গাড়িতে রক্তাক্ত মেয়েটির লাশ তোলে পোস্ট মর্টেমের জন্যে। কিন্তু বিস্ময়করভাবে মেয়েটির বাবা সকল মানুষের সামনে পুলিশকে আপ্লুত কণ্ঠে বলতে থাকে, "আমার মেয়ের 'হায়াত' না থাকার কারণে সে মারা গেছে, তাই কোন ট্রাকের বিরুদ্ধে অভিযোগ বা পোস্টমর্টেম করাতে চাইনা আমি আমার মেয়েকে। আমি তাকে ধর্মীয় রীতিতে দাফন করতে চা্ই, আর আপনাদের থেকে আমার মেয়ের জন্যে দোয়া চাই"। অনেক পথচারীও তার কথাকে সাপোর্ট করলো ধ্বনি দিয়ে। নানা বাক বিতন্ডার পর এলাকার মানুষের হস্তক্ষেপে পুলিশ বাধ্য হলো বাবার হাতে সদ্য মৃত মেয়ের লাশ হস্তান্তরে।

আমি এক অসহায় বাবার সকরূণ আর্তি আর ভাগ্যের হাতে নিজেকে সমর্পণ, আর ১৩ বছরের অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া ঝকঝকে মেয়েটির অকাল মৃত্যু পরবর্তী ঘটনা রুদ্ধশ্বাসে দেখতে থাকি অবলীলায় পরাজিত সৈনিকের মত। তকদিরবাদী এ সমাজে মানুষের আর্তি আর বোধ আমাকে বার বার ধিক্কার দিতে থাকে মেয়েটির রাস্তায় শুকিয়ে যাওয়া রক্ত দেখিয়ে। কি সমাজ আর বোধের মাঝে আমরা বসবাস করছি তার ধিক্কারে আমি রক্তাক্ত হতে থাকি মেয়েটির মতই।

গতকাল ঐ সড়ক দিয়েই ঢাকা ফিরছিলাম আমি। আমার বাইকটি যখন মৃত মেয়েটির স্পটে এলো, প্রচণ্ড রোষে আমায় চেপে ধরলো সাদিয়া নামের মৃত মেয়েটি। সে সুষ্পষ্ট স্বরে আমার স্বরতন্ত্রী জ্বালিয়ে বলতেই থাকলো কোন এক নামহীন কবির অবোধ কথামালা। যা আমার নিউরনে বাজতে থাকে অনুক্ষণ এভাবে-

"সৃষ্টি দিয়ে ভাঙো, জীবনের অপূর্ণতা, জীর্ণ সংস্কারের খিলি, চন্দ্রবিন্দুর নদীতে। যেখানে ব্যর্থতা,গড়ে তোল চোখের বালি। সমাজ সংসারে, অন্যায়ের দম্ভকে, ভাঙো কাব্যের কালিতে, বদলে দাও সাজিয়ে দাও, জ্ঞানের প্রাসাদে, স্বপ্নের ডালিতে। ধরো সত্যের গান, রাখো মানির মান, বিবেকের ধারাপাতে, এক সাথে গাঁথা বর্ণ, বাঁধো তাঁতীর মতো জীবনের আদালতে। সংখ্যালঘু অন্যায়ের কারিগর, আকাশের থোকা কালো মেঘ, তন্দ্রা ছাড়ো, আঁখি মোছো, ভাঙো বিঘ্নের দ্বার, গড় মনে সত্য কথিকা। দিগন্তব্যাপী তীব্র প্লাবন আনো, শৃঙ্খলতায়, ন্যায়ের পক্ষে গান, বেপরোয়া অনিয়মের সিঁড়িঁ, বিদ্রোহ করো, রাখো কবিদের মান। তুমি কবি, লিখো কবিতা,মনে রঙ রাঙিয়ে সাহিত্যের রূপরসে জ্বলুক আগুন, উঠুক তুফান, কাব্যমনে, অন্যায় যেন যায় ধ্বসে। এ হোক দ্রোহি জীবনের গান।


শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

চলার পথের চোখের দহন # ৫৯


পৃথিবীতে যত রকম জার্নি আছে তার মাঝে ট্রেনজার্নি খুবই প্রিয় আমার। তাই বিমান টিকেট ফিরিয়ে দিয়ে আমি ২০০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে চড়ে বসি "জ্ঞানেশ্বরি এক্সপ্রেসে" হাওড়া-থেকে মুম্বাই-পর্যন্ত ৩-দিনের বিরামহিন যাত্রা। কত মানুষ, কত পথ, কত সবুজের মাঠ পেড়িয়ে ট্রেন ছুটে চলে বেঙ্গল, উড়িষ্যা, ঝাড়খন্ড, বিহার, ছত্তিসগড়, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রের নাম জানা না জানা কত স্টেশন ফেলে। আমি বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি কৃষিজমিতে মালকোচা মারা বিহারি নারীদের কাজের গতিতে, সারা মুখ তিলক-চন্দনে ল্যাপ্টানো কেরালা তরুণির হিন্দি আর ইংরেজি কথা শুনে হাসি আটকাতে পারিনা আমি। কৃষাণি যখন তার নিজের বাগানের আপেল আর কাজু বেচতে আসে জানালার ফাঁক দিয়ে আধুনিক ট্রেনে আমি বিস্ময়ে মানুষ আর তার সংগ্রামশীলতায় বিমোহিত হই। এক সময় তারাভরা রাতে ছুটে চলা ঝিকঝিক ট্রেনের শব্দ যখন মহারাষ্ট্রের "বইহাটি-খাজুরাহ-অজন্তা-ইলোরা" স্টেশন ফেলে এগুতে থাকে সামনে, তখন ঘুমহীন রাতে জীবনানন্দ আমার পাশে এসেে বসে তার কবিতা নিয়ে - সে নিজেই যেন প্রকৃতির নিঝুমতার মাঝে আবৃতি করতে থাকে --

"একটি নক্ষত্র আসে; তারপর একা পায়ে চ'লে
ঝাউয়ের কিনার ঘেঁষে হেমন্তের তারাভরা রাতে
সে আসবে মনে হয়; - আমার দুয়ার অন্ধকারে
কখন খুলেছে তার সপ্রতিভ হাতে!
হঠাৎ কখন সন্ধ্যা মেয়েটির হাতের আঘাতে
সকল সমুদ্র সূর্য সত্বর তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাত্রি হতে পারে
সে এসে এগিয়ে দেয়; 
শিয়রে আকাশ দূর দিকে
উজ্জ্বল ও নিরুজ্জ্বল নক্ষত্র গ্রহের আলোড়নে
অঘ্রানের রাত্রি হয়;
এ-রকম হিরন্ময় রাত্রি ইতিহাস ছাড়া আর কিছু রেখেছে কি মনে।

শেষ ট্রাম মুছে গেছে, শেষ শব্দ, কলকাতা এখন
জীবনের জগতের প্রকৃতির অন্তিম নিশীথ;
চারিদিকে ঘর বাড়ি পোড়ো-সাঁকো সমাধির ভিড়;
সে অনেক ক্লান্তি ক্ষয় অবিনশ্বর পথে ফিরে
যেন ঢের মহাসাগরের থেকে এসেছে নারীর
পুরোনো হৃদয় নব নিবিড় শরীরে"।

হানাহানির এ বাংলাদেশ : অভাবী দুই ভাইবোনের ভালবাসার ক্লেদাক্ত গল্প : ৫৮

হানাহানির এ বাংলাদেশ : অভাবী দুই ভাইবোনের ভালবাসার ক্লেদাক্ত গল্প
‘বঙ’ থেকে ‘বাংলা’ নামের এ দেশটিতে এক সময় ভালবাসা, সহানুভূতি, অন্যের সুখ-দুঃখে অংশগ্রহণ, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের কমতি ছিলনা। এ জন্যেই হয়তো ‘সতীদাহে’র মত মারাত্মক জীবনঘাতী চরম ‘আত্মত্যাগে’র ভালবাসার কাহিনী এ সেদিনও বাঙালি সমাজে প্রচলিত ছিল। রবীন্দ্রনাথের ‘একগাঁয়ে’ কবিতায়ও ভালবাসার চমৎকার উদাহরণ আমরা দেখেছি কিন্তু আজ এ ‘ডিজিট্যাল ভোগবাদী বাঙালি সমাজে’ নানা সমস্যা আর বিবিধ প্রপঞ্চে অক্টোপাসের মত জড়িয়ে পড়া এ জাতি এখন অতিক্রম করছে চরম ক্রান্তিকাল। ছেলেবেলায় গ্রামের যে ‘দত্তবাড়ি’ গেলে জলপান মানে ‘মোয়া-সন্দেশ’ না খেয়ে ফিরতে পারতাম না। একাত্তরে আমার মা বাচিয়েছিলেন দত্তদের পুরো পরিবারকে। তাদের বড় মেয়েরা রাতে ঘুমাতো আমাদের মাচায়। সে দত্তদের ‘নাতি-পুতিরা’ কোলকাতায় এখন এতোই ‘বাণিজ্যিক’ যে, ধর্মতলা বা সল্টলেকের কোন বিশেষ স্থানে ‘জলপানহীন’ দেখা করে বাপ-দাদার আত্মীয়দের সাথে ‘সামাজিকতা’ সম্পন্ন করে তারা।

আজকের বাঙালির লোভ আর সপ্তপদী কর্মকান্ডে তাদের পূর্ববর্তী আতিথেয়তা, পরোপকার ইত্যাদি আস্তে আস্তে আমাদের থেকে বিদায় নিচ্ছে ক্রমশ। আগে যেখানে গ্রামের একজন সাধারণ মানুষ পারাপারের অপেক্ষাধীন কাউকে কেবল মানবিক মূল্যবোধের কারণে নিজ নৌকা ঘুরিয়ে পার করে দিতেন নদী, আজ সেখানে খালি গাড়ী নিয়ে গেলেও কাউকে ফ্রি ‘লিফট্’ দিতে চাননা সহসা কেউ। পত্রিকার পাতা কিংবা টিভি চ্যানেল খুললেই দেখা যায়, সম্পদ-অর্থ কিংবা নানাবিধ স্বার্থে স্ত্রী খুন করছে স্বামীকে, ভাই হত্যা করছে বোন কিংবা ছেলে হত্যা করছে পিতাকে [এবং ঐশি হত্যা করছে মা+বাবাকে একত্রে]।

আমাদের আদালতগুলোর অধিকাংশ মামলা-মোকদ্দমাও বর্তমানে জায়গা-জমি সংক্রান্ত অর্থ আত্মীয় কেন্দ্রিক। অর্থাৎ এটি বোধহয় এখন আর কাউকে বলে দিতে হবে না যে, আমাদের এ ভোগবাদী সমাজে এখন মা-বাবা, ভাই-বোন, দাদা-দাদী, নানা-নানী ইত্যাদির বন্ধন ক্রমশই ঋজু থেকে ঋজুতর হচ্ছে। এমনই এক ক্ষয়িষ্ণু সময়ে এদেশেরই দুই ভাই-বোন দেখিয়েছে আমাদেরকে তাদের ‘ঈর্ষণীয় ভালবাসা আর আত্মত্যাগে’র উদাহরণ। চলুন সত্য এ কাহিনীটি শুনি।

ভাইটির সঙ্গে এ লেখকের পরিচয় বাড়িওয়ালা-ভাড়াটিয়াসূত্রে। প্রায় ২৫-বছর আগে লেখকের ২০০-টাকা ভাড়ার একটি ছোট্ট ঘরে ভাইটি ওঠে তার স্ত্রী-সস্তান আর একমাত্র বিধবা বোন আর ভাগ্নিকে নিয়ে। সংসার খরচ চালানোর জন্য ভাইটি ঢাকা চলে যায় একটি প্রাইভেট ল্যাবে কাজ করার জন্যে। মাসে মাসে ভাড়া আর সংসার খরচের টাকা পাঠাতো বাড়িওয়ালা মানে লেখকের নামে। চেষ্টা করে বোনকে বিয়ে দিতে। কিন্তু বোন আর বিয়ে না করে টুক-টাক কাজ করে ভাইর সংসারের জন্যে। স্কুলে পাঠানোর চেষ্টা করা হয় বোনের মেয়েটিকে। কিন্তু বোঝা যায় মেয়েটি অনেকটাই প্রতিবন্ধী। ভাই আর বোন সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করে প্রতিবন্ধী মেয়েটিকে মানুষ করার জন্যে। কিন্তু মেয়েটির শরীরে দেখা দেয় ‘লিভার ক্যান্সোরে’র মত কঠিন রোগ। বোন আর ভাই মিলে তাকে রক্ষার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করে অনেকদিন। কিন্তু প্রায় ২৮-বছর কষ্ট পেয়ে বছর তিনেক আগে মেয়েটি মানে ভাগ্নি মারা যায় অত্যন্ত মর্মান্তিকভাবে। এর মধ্যে ভাই ঢাকার প্রাইভেট কোম্পানীর চাকুরী খুইয়ে, নিজ শহরে ফিরে এসে স্বল্প বেতনে স্থানীয় মাছ আরতে ‘হিসাব রাখার চাকুরী’ শুরু করে। নিজেও আক্রান্ত হয় পায়ের কঠিন ব্যথায়। স্বল্প ভাড়ার খোঁজে ৬/৭-মাস পর পর বাসা বদল করতে থাকে, এভাবে চলে জীবনের ঘানি অনেক দিন।

এ লেখক তথা ‘পুরাতন বাড়িওয়ালা’ ভুলে যায় তার ২৫-বছর আগের এক গরিব ২০০ টাকার ভাড়াটের কথা, যার সঙ্গে স্ত্রী সস্তান ছাড়াও ছিল এক বিধবা বোন। কিন্তু কিছুদিন আগে নিজ শহরে হঠাৎ বহুমানুষের জটলা আর ৭৪-বছরের বর্ণিত ভাইটির ‘বুকফাটা আহাজারী’ দেখে লেখক থমকে দাঁড়ায়। সিনেমার গল্পের মত প্রায় ৪৮ বছর ভাইর সংসারে সপ্তপদী সংগ্রাম আর কষ্টে কাটিয়ে, ৬৮-বছর বয়সী মারা যাওয়া বোনটির জন্যেই ভাইটির এ বুকফাটা আহাজারী।

যারা জানতো এ ভাই-বোনের দুঃখ, সংগ্রাম আর ভালবাসার গল্প, তারাও কেঁদেছে ভাইটির সঙ্গে, কেঁদেছে প্রতিবেশী ও পথচারীরা, কি এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় কেঁদেছে এ লেখকও অঝোড়ে শিশুর মত। এ জন্যে কেঁদেছে যে, অভাব, দৈন্যতা আর কষ্টে ভরা একটি সংসারে দীর্ঘদিন একটি ভাই পরম যত্নে আগলে রেখেছে তার বিধবা বোন আর প্রতিবন্ধী বোনের মেয়েকে, ভাগাভাগি করেছে কষ্ট আর আনন্দ বেদনাকে! আর দিয়েছে তার হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা। যা এ সমাজে একদিন হয়তো সবার মাঝে সহজাত ছিল কিন্তু এখন এর শুধু অভাবই নয় দুষ্প্রাপ্যও বটে।

এ দেশের অনেক স্বচ্ছল পরিবারের মা-বাবারাই এখন ‘নচিকেতা’র গানের মত ‘বৃদ্ধাশ্রম’ খুঁজছে। আমরা কি বর্ণিত এ ভাইবোনের সত্য গল্প শুনে আমাদের হারিয়ে যাওয়া ভালবাসা ফিরিয়ে আনতে পারিনা? অসহায় মা-বাবা-বোনদেরকে আগলে রাখতে পারিনা সুখ আর কষ্টের ভাগী করে? এ জন্যেই এ দেশের সকল ব্লগার তথা পাঠকের জন্যে স্বল্প শিক্ষিত অভাবী কিন্তু হৃদয়ে বিত্তবান দুই ভাই-বোনের এ সত্য কথন ছেড়ে দিলাম আলোর পাখি হিসেবে। যেন পাখিটা উড়ে বসে কারো না কারো হৃদয় কাননে! ক্লেদান্ত ভোগবাদি ২০১৪'র বাংলাদেশের হৃদ আকাশে সে পাখি কি উড়বে! ডানা ঝাপড়ে পরে যাবে কি? না নীল দিগন্তে ছুঁয়ে বাসা বাধঁবে হৃদ আকাশে!

শুক্রবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

রূপকল্প ১৫ আগস্ট '৭৫ : আহত বঙ্গবন্ধু বেঁচে উঠলে যা ঘটতো বাংলাদেশে : ৫৭

রূপকল্প ১৫ আগস্ট '৭৫ : আহত বঙ্গবন্ধু বেঁচে উঠলে যা ঘটতো বাংলাদেশে
:
১৬.৮.১৯৭৫ : ঘাতকের আঘাতে আহত বঙ্গবন্ধু চিকিৎসাধিন ঢাকার পিজি হাসপাতালে। চিকিৎসা করছেন বাংলাদেশ, সোভিয়েত আর ভারতিয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ। এর পরের রূপকল্প--

এ যেন আকাশ মন্ডল আর শ্যামল পৃথিবীর অচেনা বনফুলের এক চমকপ্রদ অশ্রু নদীর হৃদয় বিদারক কাব্যগাঁথা। এর পরতে পরতে বর্ণিত হয়েছে বিশ্বের এক মহান নেতা মৃত্যুর গহিন গহবর থেকে কিভাবে বেড়িয়ে এসে তার জাতিকে দাঁড় করিয়েছিলেন ২০১৫ সনে নক্ষত্রের মাঝে এক অন্যন্য উচ্চতায়! এ যেন তারই প্রাণের কালস্রোতে ভেসে যাওয়া এক অমিয় মহাকাব্য!
:
সারারাত ২০-সদস্যের ত্রি-দেশীয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক টিম অক্লান্তভাবে অব্যাহত রাখলেন তাদের ধারাবাহিক অপারেশন কার্যধারা। ১৬ আগস্ট পচাত্তর সকাল ১১-টায় একটানা ১৪-ঘন্টার অপারেশন শেষে তারা পর্যবেক্ষণে রাখলেন বাঙালি জাতির অন্ধকার ধূলোয় ম্রিয়মান পিতার ক্ষিয়মাণ হৃদক্রিয়া আর শারীরিক ছন্দষ্পন্দনকে। বাইরে অন্ধকারে সারারাত কুয়াশার তিমির নিঙড়ায়ে জেগে থাকা লক্ষ মানুষকে তাৎক্ষণিক খবর জানানোর জন্যে পিজির রাস্তায় লাগানো হলো 'কলরেডি'র সব এপ্লিফায়ার-গুলো। মাইকে কে-একজন কিছু না ভেবেই বললো, ‘আপনারা সবাই বঙ্গবন্ধুর জীবনের জন্যে প্রার্থনা করুন’ তিনি বেঁচে উঠবেন!
:
মহাকালের বজ্রের মতো পূর্বাহ্নের ধূসর সজলতাকে ভেঙেচুড়ে বিকীর্ণ পদতলে মুহূর্তে খালি হয়ে গেল ঢাকার রাজপথগুলো, মনে হলো হৃদয়ের নীরব বেদনার গন্ধে কে যেন তাদের নির্দেশনা দিয়েছে করণীয় সম্পর্কে।
মুসলমানরা দৌঁড়ে গেল মসজিদে মসজিদে বিকেলের সূর্যস্নাত আবছা অন্ধকারেও। ধর্মকর্মে আপাত উদাসীন, নামাজ আসক্তি-বর্জিত অজ্ঞেয় আর বস্তুবাদি তরুণও দু’হাত উঠালো হৃদয়ের পরাবাস্তবতায়। বায়তুল মুকাররমের খিলান উপচে আশ-পাশের রাস্তায় মুনাজাত ধরলো লক্ষ মুসলমানের হাত অনন্ত স্রষ্টার পানে, কাঁদলো অশ্রু নদীর ঢেউয়ে। চোখের জলে স্নাত হলো তাদের হৃদয় অনন্ত বিষণ্ণতায় সময়ের মহানায়কের কল্যাণে। কেউবা সিজদায় কান্নায় ভেঙে পড়লো অপরাহ্নের চৈত্রের ক্লান্ত ঘুঘুর করুণ ডাকের মতো।
:
সনাতন ধর্মী হিন্দুরা রক্ষাকর্তা শিবের অর্চনা শুরু করলো মন্দিরে মন্দিরে ধূপ-ধুনা জ্বালিয়ে বেলপাতা-রুদ্রাক্ষ সহযোগে ত্রিশূল স্পর্শে। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য আর শূদ্রেরা একত্রে হোম, পিণ্ডদান আর মহাযজ্ঞে অনাবিষ্কৃত সড়কের মন্দিরগুলোও উজ্জ্বলতর করলো। কায়মনবাক্যে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলো হোমাগ্নির যজ্ঞীয় বেদীতে। দূর্গেশনাশিনী দেবী দূর্গা আর কল্যাণের দেবী লক্ষ্মীর পূজা করলো যজ্ঞকুণ্ডে। শিশুরা চকলেট খাওয়ার জন্যে লুকিয়ে রাখা টাকায় ভেট কিনে উৎসর্গ করলো মন্দিরে। বঙ্গবন্ধুর প্রাণ ভিক্ষা চাইলো শিব-ব্রহ্মা আর বিষ্ণুর কাছে সমবেত করুণ সুরে।
:
বৌদ্ধরা বিহারগুলোতে ভগবান বুদ্ধের পাদপ্রান্তে নত হয়ে পবিত্র জল আর তেল উৎসর্গ করলো বঙ্গবন্ধু স্মরণে। চন্দনকাঠ পুড়িয়ে বুদ্ধমূর্তিকে স্মরণ করে মনোবাঞ্ছা জানালো পরম সৌরভে। মহামন্ত্র চক্রে হাত লাগানো হীনযানী-মহাযানী আর পুক্কুস পৌরাণিক বুদ্ধরাও বঙ্গবন্ধুর জীবন ও মঙ্গলাকাঙ্খায়। মঠগুলোকে গেরুয়া পোশাকের ন্যাড়ামুণ্ড তরুণ পুরোহিতরা ত্রিপটক পাঠ, ঘন্টাধ্বনি, মালাজপ, পবিত্রজল, তৈলসিক্ততা, মোমবাতি প্রজ্জ্বলনে মুখরিত করলো।
:
দিনটি অ-রোববার হলেও খ্রীস্টানরা উন্মুক্ত করলো গীর্জার বিশাল দরজাগুলো। ক্যাথলিক, প্রোটেস্ট্যান্ট, ইস্টার্ন অর্থোডকস, লুথেরান, আনাব্যাপটিষ্ট, ক্যালভিনিস্ট, এ্যাংলিকানিজম, প্রেসবাইটেরিয়ান, মেথডিজম সবাই সমবেত হলো যার যার চার্চে। পাদ্রী, ফাদার, সিস্টার আর ব্রাদার-রা গলায় ক্রুশ ঝুলিয়ে সমবেত পাঠ করলো ৪০০ খ্রীস্টাব্দের হিব্রু বাইবেলের ভালগিট থেকে। ক্যাথেড্রালে বিশপগণ সাক্রামেন্ট করালেন প্রীষ্ট, ডীকন, সাবডীকন, একোলাইট, রিডার, এক্সরকিস্ট আর ডোর কিপার সহযোগে স্রষ্টার করুণা চেয়ে। ঈশ্বর, যিশু ও মেরির কাছে সানুনয় আকুতি জানালো বঙ্গবন্ধুর জীবনদানের। খ্রীস্টান তরুণীরা করুণ অর্কেস্ট্রায় গাইলো যিশুর পুনরুত্থান দিবসের পবিত্র বিলাপের শোক সঙ্গীত।
:
গৃহিনীরা চোখের জলে ভাসালো বুক; কেউবা মানত করলো ‘জানের বদলে জানে’র নৈবেদ্য। রাতের গহিনে অষ্পষ্ট যাত্রা পথের রেখায় লঞ্চ, বাস, ট্রেনে হাহাকার করে যাত্রীরা খুঁজলো সম্পর্কের সুঁই-সুতো বঙ্গবন্ধুর সাথে। মাঝির কান্নায় ঝড়ে পড়লো তার সোনারং ঘাম আর হাতের রক্তদানার বৈঠা, পরিবারগুলো উৎসবাদি স্থগিত করলো বুকের প্রত্ন গুহায় জমে থাকা কষ্টে, মাজারে মাজারে চললো দোয়া-শিরণি আর বেদনার গহিনের তবারক বিতরণ। গাজন গানের আসর ছেড়ে ভূমিপুত্র কিষাণ-কিষাণীরা কাঁদলো অঝোরে বৃক্ষকষের কুপি জ্বালিয়ে জীর্ণ কুটীরে কুটীরে।
:
সবাই স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করলো নিজ নিজ রীতিতে একটি জীবনের জন্যে ইট কনক্রিটের পাথুরে শহরে, আর হিজল তমালের শুকনো ঘাস পাতাদের বনে! জন্মান্ধ নক্ষত্রপুঞ্জের মতো শাহবাগ মোড়ে একজন গেয়ে উঠলো, ‘ও বঙ্গবন্ধু! আমি বেঁচে থাকলেও, তোমার মৃত্যু মানেই আমি মৃত’!

সোমবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

ফেসবুক বন্ধু নিত্যহরির অসুস্থ্যতা এবং তার স্ত্রীর জীবন দহনের গান [চলার পথের গল্পমালা] # ৫৬



ফেসবুকে প্রবাসি Nitya Hari Mondal-'র সাথে পরিচয় হয় আমার গতবছর এ দিনেই। আমার মতই এক অন্ধকার দ্বীপের বাসিন্দা বন্ধু নিত্যহরি। ভোলা জেলার এ হাসিখুশি মানুষটি আমায় ক্লিক করেছিল আলজিরিয়া থেকে। সেখানে ভাল পদে জব করে সে। আমার ধর্মমুক্ত, মুক্তচিন্তনের মানবতাবাদি লেখার ভক্ত হয়েছিল নিত্যহরি। নভেম্বর'১৪-তে ছুটিতে দেশে এলে দেখা করতে চায় আমার সাথে। শত ব্যস্ততাকে পায়ে ঠেলে নিত্যহরি আর আমি শাহবাগের ছবির হাঁটের পাশে বসি অন্তরঙ্গ নিবিড়তায়। আলজিরিয়া থেকে তাজা খেজুর, আর একটা সেন্ট এনেছে আমার জন্যে প্রথম পরিচিত বন্ধু নিত্যহরি। দুজনে ফুসকা খা্ই ছবিরহাঁটের ফুটপাথে। নিমন্ত্রণ করি তাকে বাসায় বৌদিসহ বেড়াতে। কথা দিলেও সপ্তপদি ব্যস্ততায় চলে যায় সে আলজিরিয়া আমার নিমন্ত্রণ গ্রহণ না করেই।
:
মাস তিনেক আগে হঠাৎ একদিন কল দিলো ঢাকা থেকে। বিস্মিত করে জানায় কি একটা অসুখ নিয়ে দেশে ফিরেছে সে। চিকিৎসা বিষয়ক পরামর্শ চায় আমার কাছে। অনেক স্বজনকে ভারতে চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ্য করেছি আমি। নিজেরও "হাত কাম ঘাড় কাম বুক" ব্যথা হলে, বাংলাদেশের নানাবিধ বিশেষজ্ঞগণের পরামর্শেও যখন ব্যথা বাড়তেই থাকে, তখন পরামর্শ নিলাম কোলকাতার পিয়ারলেসের একজন নিউরোলজিস্টের। সব শুনে ঢাকার এক্সরে ইত্যাদি দেখে বললেন, এটা "কম্পিউটার সিনড্রোম"। যারা বেশিক্ষণ কাজ করে পিসি বা ল্যাপটপে তাদের হয় এটা। একটানা বেশিক্ষণ পিসিতে কাজ না করতে, ১-ঘন্টা পর পর উঠে একটু হাঁটতে, আর ঘাড়+হাতের কিছু ব্যয়াম শিখিয়ে বিনা ওষুধে বিদেয় দিলেন কোলকাতার নিউরোলজিস্ট। বিস্ময়করভাবে মাস খানেকের মধ্যে পুরো হাত, ঘাড় আর বুকের ব্যথা চলে গেল আমার। ঐ ডাক্তার কি জাদুকর পিসি সরকারের বংশধর ছিল নাকি?
:
তাই বন্ধু নিত্যহরিকেও বললাম, "কোলকাতা যান, সম্ভবত কম খরচে ভাল ট্রিটমেন্ট পাবেন"। এরপর সেও আর যোগাযোগ করেনি, আমি নানাবিধ ব্যস্ততায় আর খোঁজ নেইনি ঐ ফেসবুক বন্ধুর। মনে করেছিলাম, আগের মতই হয়তো আবার চলে গেছে আলজিরিয়া কর্মস্থলে সুস্থ হয়ে।
:
গতকাল ফেসবুকবন্ধু মাহফুজ কি প্রসঙ্গে যেন বললো নিত্যহরির অসুস্থ্যতার কথা। ক্যান্সার জাতিয় রোগের কথাও বললো সে। অনেক দিন খোঁজ না নেয়া বন্ধুর জন্য মন উতলা হলো তাৎক্ষণিকভাবে আমার। ফোন দিলাম রাতেই নিত্যহরিকে। জানলাম, অনেক দুরে থাকে সে, বুড়িগঙ্গার ওপারে কেরাণিগঞ্জে একটা ছোট ফ্লাট কিনেছিল, সেখানেই এখন দিন কাটে তার ফেসববুকহীন জীবন।


আজ অফিসে একটু ঢু মেরেই নিজে ড্রাইভ করে 'বসিলা ব্রিজ' পার হয়ে হাজির হলাম বন্ধু নিত্যহরির বাড়ি। ১-বছর আগের আর আজকের নিত্যহরিকে দেখে নিজের অজান্তেই আঁতকে উঠলাম আমি। জটিল ক্যান্সারে আক্রান্ত সে। ভারতে যাওয়ার মেডিকেল ভিসার জন্যে পাসপোর্ট জমা করেছিল ভিসা সেন্টারে। কাগজপত্রের নানাবিধ অপ্রতুলতার কথা বলে ভিসা ছাড়া পাসপোর্ট ফেরত দিলো দুতাবাস। এবার আলজিরিয়ান ডাক্তার, ওখানের দাপ্তরিক কাগজপত্র, ভারতের টাটা ক্যান্সার হাসপাতালের এ্যাপয়েন্টমেন্ট, ঢাকার ডাক্তারের সব মূল কাগজপত্রসহ পুনরায় জমা দিল ভিসা সেন্টারে। ৩ দিন পর পাসপোর্ট ফেরত পেল ভিসা ছাড়া। সে কারণ জানতে চাইল ভিসা না দেয়ার, আর ফেরত চাইলো তার মুল কাগজপত্র। কিন্তু ভিসা সেন্টারের লোকজন কোন সহায়তাই্ করলো না তাকে। বিদায় দিলো নিষ্ঠুরভাবে। একজন হিন্দু নামধারীকে চিকিৎসা ভিসা দিলোনা ভারত কি এক অবোধ্য কারণে, তা মাথায় ঢুকলো না আমার। এটা কি আলজিরিয়ান ভিসা থাকার কারণে? তার জমাকৃত মূল কাগজগুলোও দরকার তার খুব, তাও ফেরত পাচ্ছেনা ভারতীয় দূতাবাস থেকে মারাত্মক অসুস্থ্য বন্ধু নিত্যহরি।
:
অবশেষে ঢাকাতেই মাথায় একটি অপারেশন, আর ক্যামোথেরাপি করালো প্রাইভেট হাসপাতালে। বিদেশ থেকে সঞ্চিত ১০-লাখ টাকার সবই শেষ হয়ে গেল বন্ধু নিত্যহরির। দুসন্তান তার। এক ছেলে আর এক মেয়ে। দুজনেই ৯ম শ্রেণিতে পড়ে ঢাকাতে। কেনা ছোট ফ্লাটটির অর্ধেকেরও বেশি টাকা অপরিশোধিত। নিত্যহরির বউ গান শিখেছিল বিয়ের আগে। সখে গান গাইতো অনেক অনুষ্ঠানে, এমনকি বাংলাদেশ বেতারেও। আজ অশ্রুসজলতায় গাইলো "আমার এ জীবনের সেই শুভদিন ফিরে আ্সবে কবে? সুন্দর পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হবে"।


বিদায় নিতে মন চাইছিল না আমার। জুকারবার্গের ফেসবুক মায়াফ্যাক্টরিতে বাঁধা পড়েছিল আমার মন। আমার জীবনের অন্তর্বর্তী গল্পগুলো আর শেয়ার করা হয়নি নিত্যহরির সাথে। সে এখন আর ফেসবুকে ঢোকেনা, সম্ভবত ঢুকতে পারেনা। আইডিটি ৯ম শ্রেণি পড়ুয়া ছেলেটি চালায় এখন। দরজা খুলে সিড়িতে নামি আমি। নিত্যহরির রুগ্ন অগ্নিকুণ্ডের কিনারে কষ্টের পরজীবী প্রজাপতিরা ওড়াউড়ি করে। মায়ের টাকায় সদ্য কেনা গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে হাতে রেখে ক্ষণজীবী মানুষের যাপিত জীবনের গার্হস্থ্যবেলায় হারিয়ে যাই আমি। আর প্রশ্ন করি এক অচেনা অদেখা কাল্পনিক ঈশ্বরকে, যে ধ্রুপদী সময়ের কাছে বাঁধা মানবিক সম্পর্কগুলো পদদলিত করে নিত্যহরিকে নিয়ে যায় প্রকৃতির লোহিততন্ত্রের তীব্র দাহনদ্বারে। তখন প্রাগৈতিহাসিক চিরন্তন জগদ্দল দু:খরা গাড়ির পেছনের সিটে বসে আমার সাথে যাত্রী হয়ে। আমাদের ভালবাসর প্রাচীন বসতভিটায় হাঁটি আমি একাকি দু:খদের সাথে। এক ফণাধরা ক্লান্ত গোক্ষুর এক ফালি কষ্টের নদী হয়ে আমার দম আটকে ধরে তখন। 
:
ছবি পরিচিত :
১) ১-বছর আগের দেখা বন্ধু নিত্যহরি;
২) আজকের অসুস্থ্য বন্ধু নিত্যহরি;
৩) জীবন দহনের গান গাইছেন নিত্যহরির স্ত্রী।



লেখাটি ফেসবুকে দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যান প্লিজ

রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

কৈশোরের স্বপ্নিক আকাশ-ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে এক বন্ধুর মৃত্যু [চলার পথের গল্পমালা] # ৫৫



সাভার ক্যান্টনমেন্টের দেয়াল সংলগ্ন আলির বস্তিতে থেকে পাশের সরকারি প্রাইমারিতে পড়ে মাসুম, রিয়াদ আর দুর্জয়। একসাথে স্কুলে যাওয়ার পথে কিশোর ৩-বন্ধুর লোভ ছিল ক্যান্টনমেন্টের দেয়াল সংলগ্ন কাঠবাদামের গাছটির দিকে। প্রচুর কাঠবাদাম পেকে পরে থাকতো গাছের নিচে মাটিতে। ঐ বাদাম কেটে শ্বাস বের করে খেতো ওরা ওদের দরিদ্র বস্তির জীবনে। কিন্তু বাদাম সংগ্রহে যেতে হতো দেয়াল টপকে মিলিটারি এরিয়ার ভেতরে। বেশ কবার আর্মিরা রাইফেল উঁচিয়ে তাড়া করেছিল ওদের। শাসিয়েছিল লাল চোখ তুলে। বলেছিল শাস্ত্রী আবার ভেতরে ডুকলে গুলি করবে ওদের। কৈশোর চপলতায় মুখ ভ্যাংচে দৌঁড়ে পালিয়েছিল ১০/১১ বছরের ফাইভে পড়া ৩-কিশোর বন্ধু। যেন আ্নন্দ প্রমোদ তীর্থের আকাশময় সুখস্বপ্নভরা জীবন ওদের।
:
কর্নেল ফারুকের কক্ষটি ছিল বাদাম গাছটি সংলগ্ন। বস্তির দুরন্ত এ ৩-বালকের প্রায় প্রত্যহ দেয়াল টপকে বাদাম সংগ্রহে বিরক্ত ছিল সে রীতিমত। মেজর সাকিলসহ অধিনস্তদের ডেকে বেশ কবার বলেছিল, 'ঐ শিশুরা যেন আর না ঢোকে মিলিটারি এরিয়ায়। হতে পারে তারা কোন চর, বাদাম সংগ্রহের ছলে ডুকছে মিলিটারি এরিয়ায়া'। অফিসারের কড়া নির্দেশে গার্ডরা সবাই নজর রাখতো বাদাম গাছ আর ঐ ৩-শিশুর চুরি করে বাদাম নেয়ার দিকে।
:
স্কুল ছুটির পর ফেরার পথে ৩-বন্ধুর চোখ গেলো বাদাম গাছের তলায় পরে থাকা হাজারো বাদামের দিকে। দুর্জয় বললো, চলো বাদাম নেই, ঘরে গিয়ে কেটে খাবো। আগের দিনের মিলিটারির তাড়া খেয়ে মাসুম আর রিয়াদ ভয়ে এগুতে চাইলো না। কিন্তু সাহসি দুর্জয় বললো, 'তোমরা দেয়ালের এদিকে থাকো। আমি টপকে ২-মিনিটে বাদাম নিয়ে আসছি। তারপর ৩-জনে মজা করে খাবো'। এক লাফে কৈশোর চপলতায় দুর্জয় দেয়াল টপকে কুড়োতে থাকলো পাকা কাঁচা শুকনো কাঠবাদাম। ৩-মিনিটের মাথায় হাফপ্যা্ন্ট আর স্কুল ড্রেসের পকেট ভরে লাফিয়ে উঠলো দেয়ালে ফেরার জন্যে। কিন্তু দেয়ালে দাঁড়ানো মাত্র একটা গুলি লাগলো দুর্জয়ের বুকে। মুহূর্তে হৃদপিণ্ড ভেদ করে বেড়িলে গেল গুলিটা। অন্ধকারের আলোবিদ্বেষী প্রাণ নৌকোর মাঝির মত দুর্জয় দুহাতভর্তি বাদামসহ পরে গেলো ক্যান্টনমেন্টের ভেতরেই বাদাম গাছতলায়। চিৎকার আর রক্ত দেখে ভয়ে দৌঁড়ে পালালো তার দুবন্ধু মাসুম আর রিয়াদ বস্তির দিকে।
:
মিলিটারির নিজস্ব তদন্ত রিপোর্টে বলা হলো, গুলিটি ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে নয়, বাইরে থেকে এসেছে। তাই এ মৃত্যুর জন্য আর্মিগণ দায়ী নন কোনক্রমেই। তা ছাড়া সদ্য অবসরে যাওয়া কর্নেল ফারুক, মেজর সাকিল পুলিশকে জানালো, ৩-টি ছেলেই বস্তির ছিল বিধায় তারা অসভ্য, শিষ্ঠাচার বহির্ভুত ছিল। বাদাম নিতে এসে তারা হাই র‌্যাংকের আর্মি অফিসারদের মুখ ভ্যাংচাতো, যা রীতিমত অবমাননাকর ছিল সবার তাদের কাছে। ওদের বারবার সতর্ক করার পরও, তারা এ চুরি থেকে বিরত হয়নি, তাই পুরো ক্যান্টনমেন্টই বিরক্ত ছিল এ তিন বস্তির ছেলের উপর।
:
পুলিশকে তদন্তের জন্যে মিলিটারি এলাকায় প্রবেশে অস্বীকৃতি জানালো ক্যান্টনমেন্ট কর্তৃপক্ষ। তারা পুলিশকে বললো, এ ঘটনার তদন্ত তারা করেছে, তাতে প্রমাণিত হয়েছে গুলিটা বাইরে থেকে করা হয়েছিল। তাই পুলিশ যেন এ ব্যাপারে আর নাক না গলায়। বিশেষ করে আর্মিদের ব্যাপারে। মৃত ছেলেটি সিভিল, পুলিশও সিভিল, গুলিটিও এসেছিল সিভিল কারো থেকে, তাই ব্যাপারটি যেন এখানেই শেষ করা হয়। সিভিল ঝামেলা পছন্দ করেনা হাই আর্মি অফিসিয়ালরা।
:
অবশেষে নিবিড় তদন্তের জন্যে কেসটি প্রেরিত হয় পুলিশের বিশেষ তদন্তশাখা "সিআইডির" কাছে। সিআইডি ইন্সপেক্টর নাবিলের হাতে পড়লো বিষয়টি তদন্তের ভার। ইন্সপেক্টর নাবিলকেও কর্নেল-মেজর পর্যায়ের অফিসারগণ বাঁধা দিলো ক্যান্টনমেন্ট প্রবেশে। নাবিল উচ্চপর্যায় থেকে অনুমতি সংগ্রহ করলেন, যেন তদন্তের স্বার্থে প্রবেশাধিকার পান সে ভেতরে যেতে। ২-সহযোগিসহ সিআইডি ইন্সপেক্টর নাবিল ভেতরে ঢুকতে পারলেও, কোন সহযোগিতাই করলো না মিলিটারি সদস্যবৃন্দ। বিশেষ বুদ্ধিমত্বায় ইন্সপেক্টর নাবিল প্রথমেই খুঁজে পেলেন দুর্জয়ের বুক থেকে বের হয়ে দেয়ালে ইটের ফাঁকে গেঁথে থাকা রক্তলাগা গুলিটি। নিজ অফিসে এসে পরীক্ষা করে দেখলো PSS silent pistol এর 7.62×42mm necked round SP-4 বোরের বুলেট এটি। খোঁজ নিয়ে জানলেন, বাংলাদেশে আর্মিতে কোনদিন PSS silent pistol কেনা হয়নি বা কেউ ব্যবহার করেনা এটি। তদন্তে হতাশা এলো ইন্সপেক্টর নাবিলের মনে। আবার গেলেন খুনের স্পটে। মেপে দেখলেন মাত্র ৫০ মিটার রেঞ্জ এ পিস্তলটির। কদিন আগে অবসরে যাওয়া মেজর রশিদের প্রায় ২০ মিটার দুরের রুম থেকে গুলি করলেই বক্ষভেদ করে গুলিটি দেয়ালে গেঁথে থাকতে পারে। বাইরে থেকে গুলিটি এলে কখনো এটি ক্যান্টনমেন্টের ভেতরের দেয়ালে ঢোকার কথা নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ অস্ত্রটি কোনো আর্মি অফিসার কখনো ব্যবহার করেনি বাংলাদেশে।
:
ইন্সপেক্টর নাবিলের হঠাৎ মনে হলো আর্মিদের কারো ব্যক্তিগত লাইসেন্স করা পিস্তল থাকতে পারে। তাই আবার প্রবল উৎসাহ নিয়ে পুনরায় গেলেন তিনি ক্যান্টনমেন্টে। দেখতে চাইলেন ব্যক্তিগত লাইসেন্সকরা অস্ত্রের তালিকা ও অফিসারদের নাম। প্রথমে অস্বীকার করলেও, শেষে বিরক্তভরে ব্যক্তি-অস্ত্রের তালিকাটি দেখালো নবনিযুক্ত কর্নেল ওমর। কিন্তু সেখানে কারো নামেই PSS silent pistol পাওয়া গেল না। কিন্তু দমলো না বস্তির নিহত শিশু দুর্জয়ের হত্যাকারীকে খুঁজে বের করতে দৃঢ়চেতা ইন্সপেক্টর নাবিল। এ ঘটনায় অনিদ্রিত হিমেল রাত কাটে ইন্সপেক্টর নাবিলের বেদনার নীল জলে প্রতিক্ষণে প্রতিনিয়ত!
:
২-সহযোগিকে খুঁজতে পাঠালো দেশের সব থানাগুলোতে বিশেষ করে ক্যান্টনমেন্ট আছে এমন এলাকার থানাগুলোতে PSS silent pistol এর লাইসেন্স কারো নামে ইস্যু করা হয়েছে কিনা তা দেখতে। টাঙ্গাইলের ঘাটাইল থানায় পাওয়া গেল এক সুদুরপ্রসারি স্পষ্টতর স্বচ্ছ সূত্র। ১০-বছর আগে ঘাটাইল সেনানিবাসে কর্মরত থাকাকালীন মেজর ফারুক একটা PSS silent pistol এর লাইসেন্স করার জন্যে দরখাস্ত দিয়েছিলেন ঘাটাইল থানায় কিন্তু বদলী হয়ে যাওয়ার কারণে লাইসেন্স আবেদনটি ওভাবেই পরে থাকে ওখানে। দরখাস্ত ফরমটিতে স্বাক্ষর করা ছিল ঐ সময়ের মেজর ফারুকের যিনি বর্তমানে কর্নেল ফারুক সাভারের।



ইন্সপেক্টর নাবিল এবার ক্যান্টনমেন্ট অভ্যন্তরে সিনিয়র অফিসার্স বাঙলোতে কথা বলতে চান অবসরে যাওয়া কর্নেল ফারুকের সাথে। কিন্তু কর্মরত অফিসারগণ এটাকে আর্মি অফিসারদের প্রতি চরম অবমাননাকর বলে প্রত্যাখ্যান করেন ইন্সপেক্টর নাবিলকে। জিজ্ঞাসাবাদে বাঁধা দিলে তিনি ওয়ারেন্ট ইস্যু করাতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলে, তাকে যেতে দেয়া হলো কর্নেল ফারুকের বাঙলোতে। অন্য ৪-জন অফিসার ও বেশ কজন সৈনিকের উপস্থিতিতে ইন্সপেক্টর নাবিল ঐ পিস্তলের কথা জানতে চাইলো কর্নেল ফারুকের কাছে। সার্চ করলো তার পুরো ঘর। কর্নেল তার প্রতি এমন সন্দেহকে 'অপমান' বললেন এবং ইন্সপেক্টর নাবিলকে ভয় দেখালেন তার পদমর্যাদা, যুদ্ধের অভিজ্ঞতা, সততা, দক্ষতা, রাষ্ট্রপতি পদক প্রাপ্তির কথা স্মরণ করিয়ে। এমনকি উচ্চপর্যায়ে তার প্রভাবের কথাও বলতে ভুললেন না তিনি। ইন্সপেক্টর নাবিল ১০ বছর আগের ঘাটাইল সেনানিবাসে থাকাকালীন PSS silent pistol এর জন্য তার দরখাস্তফরম দেখালেন। কিন্তু ওটাকে ইন্সপেক্টর নাবিলের বানানো রাস্তার কাগজ বললেন কর্নেল ফারুক দৃঢ়তার সাথে। এবার নাবিল বের করলেন দরখাস্ত ফরমে কর্নেল ফারুকের নিজ হাতের স্বাক্ষর এবং সিআইডি কর্তৃক ঐ স্বাক্ষরের নিরীক্ষাপত্র।
:
পরদিন সিআইডি অফিসে সকাল ১০-টায় উপস্থিত করতে বললেল কর্নেল ফারুককে কর্মরত মেজরকে। অন্যথায় ওয়ারেন্ট নিয়ে গ্রেফতার করতে আসবেন এ কথাও বলতে ভুললেন না দৃঢ়চেতা ইন্সপেক্টর নাবিল। পুরো ঘটনা আর ইন্সপেক্টর নাবিলের দৃঢ়তা আর সংগৃহীত প্রমাণাদিতে বিস্মিত হলো উপস্থিত সব সেনা সদস্যরা। মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো সবাই বোধ আর লজ্জায়। সারারাত নির্ঘুম কাটলো কর্নেলের। রাত দুটোর দিকে ফোন করে ইন্সপেক্টর নাবিলকে বললেন, হ্যা খুব বিরক্ত ছিলাম ঐ ৩-টা বস্তির ছেলের প্রতি আমি। তাই আমিই হত্যা করেছি বস্তির ছেলে দুর্জয়কে। ৩-জনকেই হত্যা করতাম আমি, যদি ঐদিন ৩-জন ঢুকতো ভেতরে। কিন্তু ঘটনাক্রেম ১টা ঘুকেছিল মাত্র। ইন্সপেক্টর নাবিলের প্রশ্নের জবাবে প্রবল উত্তেজনায় তখনই বলে ফেললো সে, পাশের পানির কুপটিতে ছুঁড়ে ফেলেছে সে হত্যায় ব্যবহৃত পিস্তলটি রাগে তখনই।
:
খুব ভোরেই সিআইডির লোক নামিয়ে কুপে খুঁজে পাওয়া গেল PSS silent pistol টি। ঠান্ডা মাথায় হত্যাকারী হিসেবে কর্নেলে ফারুককে গ্রেফতার করে চার্জসিট দেয়া হলো তার নামে। বিচারে আমৃত্যু কারাদন্ড হয় কর্নেলের। সিজ করা হয় মিলিটারি পদমর্যাদা আর সুবিধাদি।
:
ভালবাসার আগুনে জ্বলা মোম হয়ে গলতে গলতে ঐ পথেই প্রতিদিন স্কুলে যায় মাসুম আর রিয়াদ। কষ্টকর ভুলের সাগরে জন্মানো বাদাম গাছের দিকে তাকায় তারা ক্ষীয়মান কালক্ষণে। বৃষ্টিভেজা পথের দোআঁশ মাটির ঘ্রাণে দুর্জয়ের গন্ধ পায় দুবন্ধু। সারাদিন চলহীন বিকল জীবনের ইস্টিশানে হাঁটে ওরা, আর খুঁজে মরে কাউন বনের ঘাস ফড়িংরূপি দুজর্য়কে। স্কুল পথের বাদাম বৃক্ষটি শান্তির মহিমান্বিত ছায়া হয়ে হাতছানিতে ডাকে ওদের। বোধহীন ভাললাগার কষ্টেরা নেচে চলে দুবন্ধুর জীবনে। বাদামগাছটির দিকে তাকালেই পুতে রাখা ব্যথার ছায়ামূর্তিরা উঠে দাঁড়ায় মৃত্যু দেয়ালে। এক সময় মৃত দুর্জয়ের ভালবাসার ঘ্রাণ প্রেমহীনতার নষ্ট ন্যাফথ্যালিনের মত লাগে ওদের নাকে। শিশিরভেজা ঘাসেদের ঘুমরাতে গলাটিপে দু:খের বীজ বুনতে বুনতে ওরা আক্ষরিক স্বপ্নের মিলিটারি হয়। বন্ধুত্বের অহম ভুলে ভালবাসাহীনতার বুকে ঝাপ দেয় ওরা। বড় হয়ে দুবন্ধু সেনাবাহিনিতে যোগদান করবে ওদের জলজ দিঘিতে বাইতে থাকে এমন কল্পনায় নাও। প্রতিনিয়ত স্কুলে যাওয়ার পথে জল ধোঁয়া নদীর কলতানে ওরা দেখে বন্ধু দুর্জনকে জড়িয়ে আছে বাদাম গাছটি। মৃত দুর্জয়ের ভালবাসায় ওরা পাটখড়ির পচা ঘ্রাণে কখনো আমোদিত হয়, কখনো ঢেঁকিছাটা চালের সুবাসিত বাতাসে ভাসে ওদের মন।
:
প্রবল বৃষ্টিতে পাতার চেয়ে বেশি বাদামে ভরে থাকে গাছটা ফলবতী নারীর মতন। ত্রস্ত চোখে ঈশ্বরের বাদাম সৃষ্টিতত্ত্বে তাকায় ওরা। শঙ্খ লাগা সাপ দেখার মত দৌঁড়ে পালায় দুবন্ধু পকেটে থাকা মৃত বন্ধুর প্রেমপত্র ছিঁড়ে। প্রত্নঘোরের মধ্যে ধূলোবাড়ি মাটিতে জন্মশোধের ঋণ শুধতে দাঁড়িয়ে থাকে গাছটি।


[ঘটনাটি ঘটেছিল ভারতে। ইন্ডিয়া ফাইট ব্যাকে (সাবধান ইন্ডিয়া) দেখানো হয়েছিল ঘটনাটি। যার ছায়া অবলম্বনে বাংলাদেশের রূপকে গল্পটি লিখিত]




যেভাবে খুঁজে পাই পাগলাবাবাকে এ প্রকৃতি আর মানুষের মাঝে [চলার পথের গল্পমালা] # ৫৪

কলেজ জীবনে চট্টগ্রাম কলেজে পড়তাম, প্রায়ই যেতাম পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে। দাপ্তরিক সেমিনারে গতমাসে চট্টগ্রাম গিয়ে বিকেলে প্লান করি পতেঙ্গা সৈকতে যাবো অনেকদিন পর। নদী আর সমুদ্রের প্রতি প্রচণ্ড টান আমার, মনে হয় তীরে দাঁড়ালেই বুড়ো সেন্টিয়াগোকে দেখতে পাবো হারপুন হাতে কিংবা নৌকোয় বাঁধা তিমিসহ। অনেক বছর যাবত আমার মননে সমুদ্র আর সেন্টিয়াগো গাঁথা কেন যেন ! সেন্টিয়াগো পুরুষ এবং আমি সমকামি না হয়েও, তার সাথে অনেক দিনের প্রেম আমার। ইহকাল ত্যাগ না করলে হয়তো দেখা করতাম এ পুরুষ প্রেমিকের সাথে তার বরফ ঢাকা ওক গাছের ভেঙে পড়া বাড়িতে গিয়ে!

পড়ন্ত বিকেলে একাই প্রস্তুতি নিয়ে কাঠগড়ের পথে হাঁটছি পতেঙ্গার দিকে। একা হাঁটার পথে ১৪/১৫ বছরের এক ছেলের সাথে দেখা, সেও যাচ্ছে ঐ দিকেই নাচতে নাচতে। যেচে আলাপে জানতে চাইলাম, ‘কি নাম তোমার বাবা’? “পাগলাবাবা” হেসে জবাব দিল সে। উত্তর শুনে কিছুটা বিরক্ত আর বিস্মিত হয়ে বললাম, ‘তুমি ভদ্র ঘরের ছেলে বলেই আমার ধারণা, অন্তত জামাকাপড়, চেহারায় তাই মনে হচ্ছে, তো বয়স্ক এ অপরিচিত ব্যক্তির সাথে ‘ফান’ করা কি খাটে তোমার? কিসে পড় তুমি’? বিষ্ময়কর ভাবে সে বললো, ‘তার নাম পাগলাবাবা-ই’ এবং সে ‘ফান’ করেনি। এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। সে তার সঠিক নামই বলেছে। হাঁটতে হাঁটতে গল্প জমে যায় পাগলাবাবার সাথে।

তার কণ্ঠ ও মুখের কমনীয়তায় নারীত্ব লক্ষ্য করলে সে জানায়, আসলে সে মেয়ে। পোশাকে চিন্তনে নারী-পুরুষের বৈষম্য মানেনা সে। আধুনিক পশ্চিমা বিজ্ঞানসম্মত পোশাক, প্রকৃতির মাঝে বিচরণ, হাঁটাহাঁটি, সব কাজ করতে দারুণ পছন্দ তার! প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চায় সে। আসলে নারীবাদি পাগলাবাবা, তাই হয়তো নামটি এমন। তসলিমা নাসরিনের দারুণ ভক্ত এ পাগলাবাবা। কুসংস্কারমুক্ত, বাংলাদেশে বিশ্বাসী আর নারী স্বাধিনতায়!

এ বয়সে আমি নারীবাদ, পুরুষবাদ, জেন্ডার, সেক্স এসব টার্ম বুঝতামই না হয়তো ভাল করে। তার চিন্তন দক্ষতা ও কথোপকথনে বিস্মিত হই। জানলাম পাগলাবাবা নামধারী মেয়েটি কেবল নারীবাদীই নয়, মারাত্মক দেশপ্রেমিক তথা মুক্তিযু্দ্ধপন্থী। কিছুক্ষণ আলাপে তার বুদ্ধির ঝলকে চমকিত আর মোহিত হই আমি।

একটা বিষয়ে জানতে চাইলাম তার কাছে, পতেঙ্গার একদম শেষ সিমায় (মানে যেখানে কর্ণফুলি শেষ) একাত্তরে শহীদ সোভিয়েত সৈনিকদের যে “স্মৃতিসৌধ” আছে তা সে দেখেছে কিনা? সে জানালো এ বিষয়ে কিছুই জানেনা সে, আর ঐ শেষ পয়েন্টে এখন নৌবাহিনীর লোকেরা সাধারণ পাবলিককে যেতেও দেয়না, নিরাপত্তার জন্যে আটকে দিয়েছে দেয়াল করে। তবে তার বহুল পরিচিত এলাকা বিধায়, সে জানে ভাঙা ওয়ালের ফাঁক দিয়ে কিভাবে ওখানে যেতে হয়, তারা বন্ধুরা দল বেঁধে অনেকবার সেখানে গিয়েছে কিন্তু না জানার কারণে ঐ ধরণের স্মৃতিস্তম্ভ তাদের চোখে পড়েনি কখনো।

এবারো তার বুদ্ধিমত্তায় শিহরিত হলাম। সত্যিই সে আমায় একটা বিশেষ ভাঙা দেয়ালের পথ দিয়ে কাঙ্খিত পয়েন্টে নিয়ে গেল। ভদ্র পোশাকের কারণে কেউ আমাদের কিছু জানতে চাইলো না বা আটকালো না পথ। কিন্তু নানা খোঁজাখুঁজির পরও আমার ইতোপূর্বে দেখা মৃত সোভিয়েত সৈনিকদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিশৌধটি খুঁজে পেলাম না আমরা। হয়তো কোন কারণে ভেঙে ফেলা হয়েছে কিংবা অন্য কোন কারণে আমরা তার সঠিক লোকেশন খুঁজে পাইনি এবার। অবৈধ অনুপ্রবেশকারি হিসেবে তাড়াতাড়ি ফিরে এলাম বাইরে একাত্তরের যুদ্ধশেষে বঙ্গোপসাগরকে নিরাপদ জলপথ হিসেবে মাইন সুইপ করতে গিয়ে বিস্ফোরণে নিহত ৮-সোভিয়েত সৈনিকের স্মরণে নির্মিত মিনার না দেখেই। পাগলাবাবা আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলো বিস্ফোরণের ঘটনাটি। পাকিস্তানিরা চূড়ান্ত আত্মসমর্পণের আগে আমাদের চট্টগ্রামে বন্দরকে অনিরাপদ করার জন্য অসংখ্য ভাসমান মাইন ছড়িয়ে দেয় বঙ্গোপসাগরে, যাতে দেশটির পোর্টে কোন জাহাজ ঢুকতে না পারে। ১৬-ডিসেম্বরের পর বাংলাদেশের অনুরোধে ক’টি সোভিয়েত যুদ্ধজাহাজ বঙ্গোপসাগরকে মাইনমুক্ত করতে গিয়ে বিস্ফোরণে একটি জাহাজ ডুবে গেলে, ৮-নৌ সেনা নিহত হয় সাগরেই। ৭২-সনে কোন এক পত্রিকায় [নাম না জানা] প্রকাশিত একটি পেপার কাটিং কেটে রেখেছিল আমার মৃত মুক্তিযোদ্ধা বাবা, যাতে তাদের নামগুলো ছিল নিম্নরূপ : [১] Aleksandar Ustanov [Александр], [২] Demyan Andripov [Демьян], [৩] Dimitri Feodor [Димитрий], [৪] Gerasim Istonov [Герасим], [৫] Gennady Lyov [Геннадий], [৬] Lavrenti Yuriy [Лаврентий], [৭] Igor Vladimir [Игорь] এবং [৮] Fyodor Irinei [Фёдор] সম্ভবত তাদের স্মৃতিতেই মূলত পতেঙ্গা কর্নারে এ স্মৃতিশৌধটি নির্মিত হয়েছিল ১৯৭২-সনে।

দেখলাম মৃত ভিনদেশি এ সৈনিকদের আত্মত্যাগের কথা শুনে চোখে জল চিকচিক করছে পাগলাবাবার, যাদের জন্ম হয়েছিল প্রাক্তন সোভিয়েতের স্তেপ তৃণভূমি, সাইবেরিয় তুন্দ্রা অঞ্চলে কিংবা ভলগা, কিয়েভ, তুরা, ইস্কটস্ক, লেনা, আমুর, উড়াল বা অন্য কোন নদী তীরে ছিল যাদের গাঁ, আর এরাই জীবন দিয়ে গেল অপরিচিত এক জাতির মুক্তির সংগ্রামে। জানিনা তাদের মৃতদেহ আর পাওয়া গিয়েছিল কিনা কিংবা ফেরত গিয়েছিল কিনা প্রাক্তন সোভিয়েত রাশিয়ায় তাদের তমস্ক, নভোসিভিরস্ক, ভরখয়ানস্ক, সিস্ত্রা বা ভেতলুগা গাঁয়ে। এ সৈনিকদের মায়েরা কি জানে তাদের সন্তানেরা লীন হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের অথৈ সমুদ্রে? এখনো কি তারা প্রতিক্ষা করছে তাদের প্রিয় সন্তান ভ্লাদিমির, ফিউদর, ইগর, আলেকসন্দর, দেমিয়ান, দিমিত্রি, গেরাসিম আর গেন্নাদি লিওভের জন্যে? বাঙালিরা কি এ ঋণ শোধ করেছিল কখনো তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতায়?

পঞ্চমুখী স্মৃতিকাতরতা আর কথকতায় পাগলাবাবার সাথে সারা বিকেল আর সন্ধ্যা কাটলো আমার আনন্দ আর বর্ণিত স্মৃতির কষ্টের নিগড়ে। নানাবিধ আধুনিক চিন্তনে, বুদ্ধির প্রখরতায়, দেশপ্রেমের ঝলকানিতে, আর প্রকৃতি প্রেমে একদিনেই নিবিড় ঘন বন্ধুত্ব হলো অসম বয়সি দু’প্রান্তের ২-মানুষের।

অবশেষে ফিরে এলাম নিজ কর্মস্থল ঢাকায়। নানা কর্মব্যস্ততার মাঝেও পাগলাবাবার সাথে প্রায় যোগাযোগ হয় নেটে। প্রগতি আর নারী মুক্তির বিষয়ে নানাবিধ পোস্ট ছাড়ে পাগলা বাবা প্রতিনিয়ত। হঠাৎ বিস্মিত করে একদিন জানায় আমাকে- পরিবার, সমাজ আর শহর থেকে পালাতে চায় সে, চায় স্বাধিনতা। ঘেরাটোপের জীবন ভাল লাগেনা তার। সে কোন জনমাবনহীন দ্বীপে গিয়ে বসবাস করতে চায় সে একাকি কিংবা কাউকেসহ! প্রকৃতির মাঝে ঘুরে বেড়াতে চায়; মাছ ধরে, গাছে চড়ে, শিকার করে প্রকৃতির অনুসঙ্গ হয়ে বাঁচতে চায় সে। রাতে ঘাসের বিছানায়, তারার আলোয় ঘুমোতে চায় পাগলাবাবা। ছুঁয়ে দেখতে চায় অন্ধকার আকাশে স্বাতী, উত্তরাষাঢ়া, অশ্বিনী, ভরণী, কৃত্তিকা, রোহিণী, আর্দ্রা, পুনর্বসু, পুষ্যা, অশ্লেষা, পূর্বফাল্গুনী, উত্তরফাল্গুনী, চিত্রা, বিশাখা, অনুরাধা, পূর্বাষাঢ়া, শ্রবণা, শতভিষা, উত্তরভাদ্রপদ আর রেবতী নক্ষত্রের অনন্তে ছুটে চলা আর আলোক বিচ্ছুরণের চিত্রায়ণ। আমি যেন তাকে সহযোগিতা করি এমন কোন দ্বীপের সন্ধান দিয়ে কিংবা সহযাত্রি হয়ে তার!

১৪-বছরের পাগলাবাবাকে সান্ত্বনা দেই আমি, এটা এখন বাস্তবসম্মত নয় বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে। কোন দ্বীপই এ অঞ্চলে নেই এখন জনমানবহীন। গিজগিজে ঠাসা নিঝুম দ্বীপ, চরকুকড়িমুকড়ি, ফাতরারচর, চরমন্তাজ, চরআলেকজান্ডার, ঢালচর সবই। দু’য়েকটি যা নতুন চর জেগেছে বঙ্গোপসাগরে, তা যেমন জলদস্যুদের আড্ডাখানা, তেমনি জীবন ধারণের অনুপযোগি এখনো। বরং তুমি চলে যেত পার বাংলাদেশ ছেড়ে ডারউইনের ‘গালাপাগোস’ দ্বীপে! নানা প্রাণিদের সাথে মিলেমিশে থাকবে ওখানে পরম প্রশান্তিতে।

তার চেয়ে বরং প্লান করতে পারো পৃথিবীর ছোট ছোট দ্বীপরাষ্ট্রগুলোকে ঘুরে দেখার। ঘুরে দেখতে পারো - সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, সামোয়া, তিমুর লিসতি, টগো, টুকালু, ত্রিনিদাদ এন্ড টোবাগো, তুর্ক ও কইকস দ্বীপপুঞ্জ, এন্টিগুয়া, বারবুদা, অরুবা, বাহামাজ, বারবাডোজ, কেপভার্দে, কেম্যান দ্বীপপুঞ্জ, ক্রিসমাস দ্বীপপুঞ্জ, টোঙ্গা, ককোস দ্বীপপুঞ্জ, কুক আইল্যান্ড, ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ, গুয়াম, কিরিবাতি দ্বীপপুঞ্জ, ম্যাকাও, মাদাগাস্কার, নাউরু, পালাউ, পাপুয়া নিউগিনি, পলিনেশিয়ান দ্বীপমালা, সেন্ট হেলেনা, সেন্ট লুসিয়া, কিটস এন্ড নেভিস, গ্রেনাডা, সেন্ট ভিনসেন্ট এন্ড গ্রিনাডিনস, সেন্ট মেরিনো, সোয়াতম এন্ড প্রিসিপ দ্বীপপুঞ্জ, তুভালু, ভেনাতু, ওয়ালিস ও ফরচুনা আর ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জ। তাকে খুলে বলি পলিনেশিয়ায় আমার ‘টোঙ্গা’ দ্বীপ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা, ঘুরে বেড়ানো আর আনন্দের কথা!

এতো দ্বীপমালার নাম শুনে ১৪-বছরের প্রজাপতি মনা পাগলাবাবার মন নেচে ওঠে নতুন সব দ্বীপরাষ্ট্র ঘুরে দেখার, গুগলে সার্চ দিয়ে এসব দ্বীপের অবস্থান জেনে পুলকিত আর রোমাঞ্চিত হয় সে। যেন সে আজই যেতে চায় তাসমানিয়া, হাইতি কিংবা ভেনাতু আইল্যান্ডে। এখন প্রত্যহ পাগলাবাবার তাগাদা শুনে গভীর রাতে ঘুমোতে যাই আমি, আর সকালে ঘুম ভাঙে তার ডাকে কখন যাবো তাকেসহ বর্ণিত সব দ্বীপমালায়? যেখানে সে টুকালু দ্বীপের আদি বাসিন্দাদের ট্রাডিশনাল ‘হাইতা’ পোশাক পড়ে নেচে বেড়াবে তাদের প্রাগৈতিহাসিক দেবি “উতাপিকাতুর” কাঠের মূর্তির সামনে? পুরণ হবে কি পাগলাবাবার এ স্বপ্ন-কথন কখনো? পারবে কি সে পলিনেশিয়া, ক্যারিবিয়ান, প্যাসিফিক, প্রশান্ত আর ভারত মহাসাগরিয় হাজারো ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্রে বসবাসকারি সপ্তপদি মানুষ আর তার সমাজকে দেখার স্বপ্ন পুরণ করতে? হয়তো পারবে হয়তো পারবে না, ভবিষ্যতই পাগলবাবার পথ বলে দেবে, কোথায় যাবে সে তার অজানা পথের সন্ধানে! ছুঁতে পারবে কিনা কোনদিন অনন্ত বিশ্বের মহাজাগতিক নক্ষত্রপুঞ্জকে !



লেখাটি ফেসবুকে দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যান প্লিজ