রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

মেঘেদের মাঝে অতন্দ্রিলার মা, আমার আর আমাদের মা-দের ভালবাসার গল্প [ কাব্যিক গল্পমালা : ৫১ ]



সরকারি একটা সর্ট প্রশিক্ষণে বৃটেন যাচ্ছিলাম আমিরাত বিমানে। পাশের সিটের ভদ্রমহিলাকে বাঙালি বলে মনে হলো আমার। কিন্তু তিনি নিজে কোন কথা না বলাতে, আগ বাড়িয়ে আমিও আর কথা বললাম না তার সাথে। ঢাকা থেকে দুবাই পর্যন্ত যে যার সিটে বসে টিভি স্কিন দেখতে থাকলাম দু'জনে। ঘটনাক্রমে দু'জনেই বৃটেন যাত্রী হওয়াতে দুবাই বিমানবন্দরে ৬ ঘন্টার ট্রানজিটে অসহনীয় সময় কাটাতে দুজনে ট্রানজিট লাউঞ্জে পরিচিত হলাম নিজেদের গরজেই। চল্লিষোর্ধ নারী পরিচয় দিলেন ভার্জিনিয়া থাকেন তিনি, বাংলাদেশে বাড়ি কিন্তু এখন ওখানের সিটিজেন। ১ সন্তানের মা তিনি, স্পাউস থাকেন সাথে তার । সন্তান বড় হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। শুনে খুশী লাগলো আমার মনে মনে বললাম, একজন সুখী নারী হবেন তিনি অবশ্যই। 
:
বিমর্ষ করুণতায় হাসলেন অতন্দ্রিলা নামের মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের এ মেয়েটি। আমার বাবাও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এ তথ্যে অল্প সময়েই বন্ধুত্ব হয়ে গেল অতন্দ্রিলার সাথে। হাসিমুখে খুব কাছে এসে বসলো অতন্দ্রিলা। বাবা মার কথা জানতে চাইলে হঠাৎ ক্লেদাক্ত হলো অতন্দ্রিলার চোখমুখ। কথার মাঝে বাকরুদ্ধ হলো তার। আমি কিছুটা বিস্মিত হয়ে থামালাম তাকে। হাসির জোক বলে হালকা করার চেষ্টা করলাম পরিবেশ কিন্তু অতন্দ্রিলার ব্যথাতুর করুণ কণ্ঠ আর উঠলো না। আমি বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলাম তার এ করুণতার কথা। অতন্দ্রিলার জীবনের যে গল্প আমায় বলে গেল প্রায় ৫-ঘন্টা দুবাই এয়ারপোর্টে তা যেমন গৌরবের তেমনি করুণকায় স্নাত!
:
মানিকগঞ্জের সুবর্ণ গাঁয়ে ছিল তাদের বাড়ি। ৪-ভাইবোনের সংসার তাদের। বাবা চাকুরি করতেন আর মা ছিলেন গৃহিনী। ২-ভাই চলে গেছে মুুক্তিযুদ্ধে তখন। অতন্দ্রিলার বয়স তখন ৫ বছর মাত্র। ১১ জুন ৭১ রাজাকারদের সহযোগিতায় পাক সেনারা আক্রমন করলো এদের বাড়ি। মা ছিলেন পুকুর ঘাটে। টের পেয়ে ২ মেয়ে + অন্য এক আত্মীয়ের মেয়েসহ আশ্রয় নিলেন পাশের বেতঝোপের মাঝে। কিন্তু মানুষের নড়াচড়া দেখে ব্রাশ ফায়ার করলো রাজাকার আর পাক আর্মিরা। যুদ্ধে বিমুখ মার বুকে লাগলো গুলি। ঝোপের মাঝেই লুটিয়ে পড়লো মা। অবোধ্য ৫ বছরের অতন্দ্রিলা চেষ্টা করলো মার বুকের গুলি অপসারণের। কম বয়সি মেয়েদের পাশে কাতরানো গুলিবিদ্ধ মাকে দেখে হায়েনারা চলে গেল। ছোট ৩ অবোধ মেয়ে মায়ের মুখে দিল শেষ বিদায়ের পানি। প্রাণভয়ে পালালো তারা মাকে ওভাবে ফেলেই।
:
হায়েনারা চলে গেলে সাহসি পরশিরা ঝোপ থেকে নিয়ে এলো মার লাশ। রাতে অবোধ দুবোন মৃত মাকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লো তার পাশেই। তারপর ন'মাস ছুৃটে চলার এক অনন্ত কাহিনি, বেঁচে থাকার অদম্য তাড়নায় অতন্দ্রিলা, তার বোন আর বাবা পদ্মাার এপার থেকে ওপার পর্যন্ত ছুটে চলেছেন নিরন্তর, যুদ্ধশেষে ভাইরা ফিরেছেন পোড়ো ভিটায় মা শূন্য ঘরে। এটুকু বলার পর আর কথা বলতে পারলো না অতন্দ্রিলা নামের টেক্সাসি বাঙালি নারী। 
:
একাত্তরে অতন্দ্রিলার মার মৃত্যুদৃশ্য জগতের সকল সুন্দরের ধারণা বাদ দিয়ে, মনের অন্ত:পুরে বিষাদের সুর বাজাতে থাকে আমার। তখন বিশ্বের ঝকমকে রঙিন সাজে সজ্জিত দুবাই বিমানবন্দরকে এক ধুলোময় গোলকের জালে আতঙ্কের আঁচল রূপে দেখি আমি। ঘোষক বার বার আরবি আর ইংরেজিতে ডাকতে থাকে লন্ডন ফ্লাইটের শেষ যাত্রী হিসেবে আমাদের দু'জনের নাম কিন্তু অতন্দ্রিলার কান্নার রিণরিণে শব্দ তখনো থামেনা। ঘোষণার শব্দমালারা মনের অন্তর্বাস ছুঁয়ে হৃদয় গহীনে আঘাত করতে থাকে অনবরত। অতন্দ্রিলা আর আমার মননে তখন এক বিষাদের নৃত্যনাট্য ঝরে পড়ে ক্রমাগত। আমি অতন্দ্রিলার হাত ধরে তাকে নিয়ে বোর্ডিং ব্রিজের দিকে এগুতে চাই। বেদনাই যেন একমাত্র নৈ:শব্দ সাথি হয়ে অতন্দ্রিলাকে আঁকড়ে ধরে। এতো বছর পরও জীবনের নিরর্থকতা প্রেমহীনতায় পরিণত হয় অতন্দ্রিলার কাছে। 
:
এক সময় শেষ যাত্রী হিসেবে অতন্দ্রিলা আর আমি বিমানে পাশাপাশি বসি। প্রপেলারের প্রচণ্ড তীব্র ঘুর্ণনে সব শোকগাঁথা গচ্ছিত রেখে অতন্দ্রিলাকে সান্ত্বনা দেয়ার মিথ্যে চেষ্টা করি আমি বিদগ্ধ জনের মত। বিমান আকাশে উড়তে থাকে ক্রমাগত, নীচে ভাসমান সাদা আর গোলাপী মেঘের মাঝে আমি সুষ্পষ্ট দেখতে পাই অতন্দ্রিলার মাকে। যিনি ককপিটের ফোঁকর দিয়ে দেখতে চা্ইছেন তার মেয়েকে, যে মৃত্যুর সময় তার মুখে দিয়েছিল প্রশান্তির পানি। যতক্ষণ পর্যন্ত হিথরোতে বিমান না নামলো, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি মেঘমালা থেকে চোখ সরালাম না, যে মেঘের মাঝে সাঁতরে বেড়াচ্ছে অতন্দ্রিলার মা, আমার মা, আরো কতো সন্তানের মা'রা। যারা তাদের সন্তানদের আকাশে খুঁজে ফিরছে অহরহ, তারা উড়ন্ত বিমান দেখলেই মেঘের মাঝ থেকে উড়তে উড়তে খুঁজতে থাকে তাদের সন্তানদের, যেন আশির্বাদ দিতে পারে মৃতপরবর্তী এক অবোধ্য জীবন থেকে, কেবল সুসন্তানের জন্যে! কিন্তু সব সন্তানরা কি এমন মা'দের কাছে যেতে পারে? 
:
সাদা গোলাপি সপ্তবর্ণা মেঘের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ আমি মৃত হুমায়ুন আজাদকে দেখতে পাই সুষ্পষ্টরূপে, যিনি মেঘের ভেলায় ভেসে বেড়ানো মাদের শোনাচ্ছেন তাঁর "আমাদের মা" কবিতাটি, যার রেশ এখনো বিমানে উঠলেই আমি শুনি-
:
"আমাদের মাকে আমরা বলতাম তুমি, বাবাকে আপনি।
আমাদের মা গরিব প্রজার মত দাঁড়াতো বাবার সামনে,
কথা বলতে গিয়ে কখনোই কথা শেষ ক’রে উঠতে পারতোনা।
আমাদের মাকে বাবার সামনে এমন তুচ্ছ দেখাতো যে
মাকে আপনি বলার কথা আমাদের কোনোদিন মনেই হয়নি।
আমাদের মা আমাদের থেকে বড় ছিলো, কিন্তু ছিলো আমাদের সমান।
আমাদের মা ছিলো আমাদের শ্রেনীর, আমাদের বর্ণের, আমাদের গোত্রের।
বাবা ছিলেন অনেকটা আল্লার মতো, তার জ্যোতি দেখলে আমরা সেজদা দিতাম
বাবা ছিলেন অনেকটা সিংহের মতো, তার গর্জনে আমরা কাঁপতে থাকতাম
বাবা ছিলেন অনেকটা আড়িয়াল বিলের প্রচন্ড চিলের মতো, তার ছায়া দেখলেই
মুরগির বাচ্চার মতো আমরা মায়ের ডানার নিচে লুকিয়ে পড়তাম।

ছায়া সরে গেলে আবার বের হয়ে আকাশ দেখতাম।
আমাদের মা ছিলো অশ্রুবিন্দু-দিনরাত টলমল করতো
আমাদের মা ছিলো বনফুলের পাপড়ি;-সারাদিন ঝরে ঝরে পড়তো,
আমাদের মা ছিলো ধানখেত-সোনা হয়ে দিকে দিকে বিছিয়ে থাকতো।
আমাদের মা ছিলো দুধভাত-তিন বেলা আমাদের পাতে ঘন হয়ে থাকতো।
আমাদের মা ছিলো ছোট্ট পুকুর-আমরা তাতে দিনরাত সাঁতার কাটতাম।
আমাদের মার কোনো ব্যক্তিগত জীবন ছিলো কিনা আমরা জানি না।
আমাদের মাকে আমি কখনো বাবার বাহুতে দেখি নি।

আমি জানি না মাকে জড়িয়ে ধরে বাবা কখনো চুমু খেয়েছেন কি না
চুমু খেলে মার ঠোঁট ওরকম শুকনো থাকতো না।
আমরা ছোট ছিলাম, কিন্তু বছর বছর আমরা বড় হতে থাকি,
আমাদের মা বড় ছিলো, কিন্তু বছর বছর মা ছোটো হতে থাকে।
ষষ্ঠ শ্রেনীতে পড়ার সময়ও আমি ভয় পেয়ে মাকে জড়িয়ে ধরতাম।
সপ্তম শ্রেনীতে ওঠার পর ভয় পেয়ে মা একদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে।
আমাদের মা দিন দিন ছোটো হতে থাকে
আমাদের মা দিন দিন ভয় পেতে থাকে।

আমাদের মা আর বনফুলের পাপড়ি নয়, সারাদিন ঝরে ঝরে পড়েনা
আমাদের মা আর ধানখেত নয়, সোনা হয়ে বিছিয়ে থাকে না
আমাদের মা আর দুধভাত নয়, আমরা আর দুধভাত পছন্দ করিনা
আমাদের মা আর ছোট্ট পুকুর নয়, পুকুরে সাঁতার কাটতে আমরা কবে ভুলে গেছি।
কিন্তু আমাদের মা আজো অশ্রুবিন্দু, গ্রাম থেকে নগর পর্যন্ত
আমাদের মা আজো টলমল করে"।

[লেখাটি অতন্দ্রিলার মাসহ পৃথিবীর সকল মায়েদের জন্যে উৎসর্গকৃত]



লেখাটি ফেসবুকে দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যান প্লিজ



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন