রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

৯-জন হিন্দু যুবতি মেয়ে ও আমার মায়ের গল্প : পর্ব # ১ [ চলার পথের সত্যি ঘটনার গল্পসিরিজ : ২০ ]



৭ পর্বের লেখার পর্ব # ০১


বাংলাদেশ তথা পুর্ববঙ্গীয় বাঙালিরা বলে, কোলকাতার মানুষরা নাকি খুব কিপটে। বিশেষ করে অতিথিদের নাকি তারা ফুটপাতে মাটির ভাড়ে ৩-টাকার চা খাইয়েই বিদেয় দেয়। বাড়িতে খুব একটা যেতে বলে না বাংলাদেশিদের মত। এমন ধারণা নিয়েই বেশ ক'বার কোলকাতা ভ্রমণ করেছি আমি। কিন্তু গত ডিসেম্বরে যখন 'ডালহৌসি' মোড়ে দেখা হলো সুরেন্দ্রের সাথে, তখন তার কিছুই করলো না কোলকাতায় জন্ম নেয়া সুরেন্দ্র। অনেকটা জোর করে তার নিজ অফিসে নিয়ে গেল পরম যত্নে। নিজের চেয়ারটায় বসতে দিলো আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে, আর লাঞ্চ করালো অভিজাত রেস্তোরা থেকে বিশেষ যত্নে আনা খাবার। লাঞ্চের পর বাড়িতে মার সাথে কথা বলালো আমায় সেলফোনে। কোনক্রমেই সুরেন্দ্রের মা মালতি দেবীর অনুরোধ না ফেলতে পেরে, বিকেলে হোটেল ছেড়ে সঙ্গী হলাম সুরেন্দ্রর বাড়ির দিকে ট্রেনে। শিয়ালদা এসে আমাদের সাথে যোগ দিলো সুরেন্দ্রোর বোন স্বর্ণা আর মৃত্তিকা। দুজনেই কোলকাতা ডেইলি আসা যাওয়া করে বাড়ি থেকে। একজন জব করে মৌলালি একটা অফিসে, অন্যজন পড়ালেখা করে যাদবপুর ভার্সিটিতে। প্রচন্ড ঠেলাঠেলির মাঝে আমরা ৪-জনে ট্রেনে চাপলাম মালতি দেবির বাড়িতে যেতে।
:
সন্ধ্যার প্রাক্কালে "গোচরণ" স্টেশনে পৌছলো আমাদের লোকাল ট্রেন। স্টেশনের কাজেই সুরেন্দ্র স্বর্ণা মৃত্তিকাদের বাড়ি। খবর জেনে ওর মা দরজা খুলে দাঁড়িয়ে রইলো আমাদের জন্যে। দু'মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম আমরা হেঁটেই ওদের আধা গাঁ আধা শহুরে বাড়িতে। বয়স্ক মা প্রণাম করলেন আমায় দুহাত এক করে। লজ্জা লাগলো আমার থুব। মুসলিম পরিবারের সন্তান আমি, তাই প্রণাম বা মাথা নত করে মানুষকে সম্মান করা শিখিনি ইসলামি রীতি বহির্ভুত বলে। বললাম, "মাসিমা আমিতো আপনার ছেলের বয়সি, আমাকে এমন করে প্রণাম করাতে লজ্জিত হচ্ছি আমি"। কাছে ডেকে পরম যত্নে বসালেন আমায়। জানতে চাইলেন কবে এলাম কোথায় উঠলাম এসব নানাবিধ বিষয়াদি। কোলকাতার এ হিন্দু পরিবারের এমন আন্তরিকতায় মুগ্ধ হলাম আমি। যদিও জানতাম এক সময় আমার গাঁয়ে ছিল তাদের বসতি। স্বাধীনতার পর চলে এসেছিল তারা ভারতে। তাদের বসত বাড়ি জমি বিক্রি দিয়ে এসেছিল আমাদের পরিবারের কাছেই। কিন্তু কথিত 'কৃপণ' কোলকাতাবাসির এতো অান্তরিকাতায় বিস্মিত করলো আমায়।
:
নানা কথা প্রসঙ্গে জানতে চাইলো আমার মায়ের কথা। মা গত হয়েছেন ৭-বছর আগে। শুনে শ্বাশত বেদনার কাব্যকথার মত ডুকরে কেঁদে উঠলেন মাসিমা। আমি আর তার ৩ সন্তান, ৪-জনেই বেশ বিস্মিত হলাম মালতি রানী দাস নামীয় পঞ্চাশোর্ধ অন্য ধর্মের এ নারীর বিমর্ষ কান্না দেখে। কান্নার রেশ থামিয়ে চোখ মুছে ৩ সন্তানকেই বললেন, তোরা প্রণাম কর ওনার মাকে, তার ঋণ কো্নদিন শোধ করতে পারবো না আমি আর আমার পরিবার। সন্তানরা করজোরে প্রণাম করলো আমার মৃত মার উদ্দেশ্যে তার মায়ের নির্দেশে দুর্বোধ্য আর জটিল অপরাধির মত।
:
মাসিমা বলে চললেন ঘাস ফুলের অনাগত এক কাব্যিক রূপকথা যেন। একাত্তর সনে তোমার মার জন্যেই বেঁচে গিয়েছিলাম আমরা, না হলে হয়তো ধর্ষিতা হয়ে মারা যেতাম তখনই। তোমার মা-ই আমাকেসহ আমাদের গাঁয়ের ৯-হিন্দু মেয়েকে ৯-মাস লুকিয়ে রেখেছিল তোমাদের ঘরে। তোমাদের বাড়ির আশেপাশে ১৪/১৫-টা হিন্দু পরিবার ছিল। যেসব ঘরে ৯-টা যুবতি মেয়ে ছিল, যাদেরকে পাকিস্তানি ক্যাম্পে দেয়ার জন্যে রাজাকাররা বেশ কবার আমাদের দ্বীপগ্রামে আসে গানবোট নিয়ে। কিন্তু তোমার মার বুদ্ধিমত্তায় একজনকেও ধরতে পারেনি রাজাকাররা। হিন্দু ছেলেরা প্রায় সবাই পালিয়ে গিয়েছিল ভারতে, বুড়ো আর বয়স্ক নারীরাই কেবল বাড়িতে থাকতো রাতের বেলাতে। 


লেখাটি ফেসবুকে দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যান প্লিজ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন