রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

৯-জন হিন্দু যুবতি মেয়ে ও আমার মায়ের গল্প : পর্ব # ৭ [ চলার পথের সত্যি ঘটনার গল্পসিরিজ : ২৬ ] শেষপর্ব





বিগত জীবনের চলমান ছোটছোট গল্পকথার শেষ বিকেলে মাসিমা তার কৈশোরিক মেঠোপথের প্রেমজ মধুরতার ৮ বান্ধবির ঠিকানা খুঁজে বের করে ধূসর ছেঁড়া ডায়েরির পাতা থেকে। নিলাঞ্জনা নামের '৯-ঘোষ-নারীর' একজনের সাথে মোবাইলে যোগাযোগও হয়ে যায় ঘটনাক্রমে তাৎক্ষণিকভাবেই। মাসিমা মোবাইলে নিলাঞ্জনাকে বোঝালেন দীর্ঘক্ষণ ধরে ৪৩-বছর পুরণো তাদের দ্বীপগ্রামের বেেঁচে থাকার স্বর্ণো্জ্জ্বল জীবনের ক্ষীয়মানতার কথা; আমার মৃত মায়ের সাথে ঐ সময়ের নদীভাঙার অঘোর পাললিক শব্দময়তার কথা; দশটি হৃদয়ে নিবিড়তার আল্পনা আঁকার প্রতিচ্ছবির কথা; ফলবতী নারীর অন্ধকারের মাঝে ন'মাসের অদৃশ্যমান ভালবাসার কথা; ঘনান্ধকার মাচায় ৮-মাস আর, হোগলার দ্বীপে ১-মাসের সহবাসের হারানো স্মৃতির কথা। অনুতাপে ক্ষয়িষ্ণু দিগন্তে হারানো হাঁসের মত মাসিমা নিলাঞ্জলার সাথে কথা কয় অনেকক্ষণ এবং শেষ বেলাতে নয় নারীর পারিজাত দেবি রাবেয়া মাসিমার পুত্রের উপস্থিতির কথা বলে পৌরাণিক সম্রাজ্ঞির মত সুতীব্র ভালবাসার অহঙবোধে। এবং কথা না কয়ে পারিনা আমি, আমার অদেখা, আমারই গাঁ থেকে পরিজায়ি পাখি হয়ে কোলকাতা চলে আসা নিলাঞ্জনা মাসির সাথে। 
:
জীবন ছবির অজস্র স্বর্ণালি অধ্যায় উল্টে নিলাঞ্জনা আমার কাছে জানতে চায় আমাদের গাঁ, মানুষ, নারী, নদী, ঘাট, নৌকো, বিল, ধানক্ষেত আর 'লক্ষির চরের' কথা। আ্মাকে দেখে আমার মার ঘ্রাণ শুকতে চায় মুশির্দাবাদের বেলডাঙায় বসতি গড়া আমার দ্বীপগ্রামের একাত্তরের পূণ্যবতি নারী নিলাঞ্জনা। নিলাঞ্জনা ভালবাসা শিল্পের অনুপম রূপকথার মত আমার মায়ের স্মৃতি হাতড়াতে থাকে। সেলফোনে তার নেশাতুর কথায় আমি বুঁদ হয়ে মাতাল মৃত্যুর পরাবাস্তবতায় ফ্রিজ হয়ে থাকি। মার প্রতি তার শ্রদ্ধার্ঘ মহাজাগতিক কাব্যকথার মত শোনায় আমার কানে। দু:খকথার নির্ধারিত শস্য আর বল্কল পরে আমি কান পেতে নিলাঞ্জনার কথিত আর ভাষান্তরিত শব্দগুলো বোঝার চেষ্টা করি। কিন্তু রাবেয়া মাসিমার প্রতি ভালবাসার কৃতার্থতার ভাষান্তরের জটিলতায় আমি নির্বাক হয়ে থাকি অবোধ বালকের মত। কেবল মাথা ঝুকিয়ে নৈশব্দে সাগরতলে হাঙরমাছের আত্মহত্যার মতো বলি, 'হ্যা আসবো মাসিমা আপনার বাড়িতে'।
:
সুরেন্দ্র, স্বর্ণা, মৃত্তিকা আর তার মা মালতি দেবীর ভালবাসার রিখটার স্কেল যখন দশোধিক মাত্রা অতিক্রম করলো, তখন তাদের অনুরোধ করলাম আমার সাথে নিলাঞ্জনা মাসির বেলডাঙার বাড়ি যেতে, যেখানে একটা বালিকা বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ সে এখন। পরদিন রোববার থাকাতে সিদ্ধান্ত নিলাম ট্রেনে বেলডাঙা যাবো আমরা, মালতি দেবীর বান্ধবি আর আমাদের মাসিমা নিলাঞ্জনার বাড়ি। আবার মাসিমা টেলিফোন করলো নিলাঞ্জনাকে তার বাড়ির লোকেশন, সুবিধাদি ইত্যাদি জানার জন্যে। আমাদের মোট পাঁচ অতিথির থাকার বিষয়টাও কনফার্ম করতে বললেন, যাদের মধ্যে একজন আবার মোহাম্মদ নামধারী। কিন্তু আমার মায়ের প্রতি মালতি দেবীর মতই নিলাঞ্জনা মাসির ভালবাসা এতোটা সুঢৌল ছিল যে, কুহেলি ধ্রুপদী নৃত্যের মুদ্রার মত নাম-ধর্ম সেখানে হার মানলো মানুষ আর মানবতার কাছে।
:
পরদিন খুব ভোরেই আমরা লালগোলা এক্সপ্রেসে উঠলাম মুর্শিদাবাদের বেলডাঙা যেতে। একাত্তর এবং পরবর্তী ঘাত প্রতিঘাতের বর্ণময় জীবনের প্রাণহীনতার হাঁটাপথ বেয়ে মালতি মাসিমা, তার তিন সন্তান আর আমি উড়ে চললাম বেলডাঙার দিকে। যেখানের হৃদয়-দিঘিতে খেলা করছে আমাদের অদেখা প্রেমগন্ধী ফুল, যার নাম হোগলা পাতা বনের ঘোষনারী 'নিলাঞ্জনা'। তার স্বামি সংসার আর একাত্তর এবং ফেলে আসা ধীবর দ্বীপের এক বোঝা কষ্টের স্মৃতি। বিনুনি পথ ভেঙেভেঙে এক্সপ্রেস লালগোলা এগুতে থাকে বেলডাঙার দিকে। 
:
মাকে হারানোর পর আমার একাকি জীবনের দু:খাতুর নির্মাণের অলেখা খাতায় মার ভালবাসায় স্নাত ৯-নারীর নাম লিখতে পারছি আমি, এমন শুদ্ধবাদীতার মুখোশ পরে চলন্ত ট্রেনের দরজায় দাঁড়াই। ৯-নারীর ৯-মাসের নির্বাসিত জীবনের মত ৯-মাস মাতৃজঠরে ছিলাম আ্মি। ঐ মাতৃজঠরকে কেন যেন 'লক্ষির চর' মনে হয় আমার। ভ্রণাবস্থায় কষ্টকর মৈথুনে মার ভালবাসার সব রক্ত চুষে ভুমিষ্ঠ হয়েছি এ বিশ্বে, তাই মার হারিয়ে যাওয়ার পরও বৈশ্বিক ব্যথাতুর নীলের শত দংশনেও মানবতা সমুজ্জ্বল থাকে আমার। ট্রেন যতই এগুতে থাকে কাংখিত স্টেশনের দিকে, আমার মার স্মৃতি ততই আঁকড়ে ধরে আমায় শেষ বিকেলের ভেঙেপরা খুঁটির মত। একাত্তরের আমার এমন মাকে হন্তারক মৃত্যুরা ছিনিয়ে নেয়ার পরও চলন্ত লালগোলা এক্সপ্রেসের চলমান মানুষ আর প্রকৃতি দেখে আমার মন হয়, মৃত্যুর চেয়ে বড় মিথ্যে আর নেই জগতে; আসলে প্রতিটি মৃত্যু থেকে জন্ম নেয় এক নির্ভেজাল নক্ষত্রের রাত। যে রাতে আমাদের মাকে আমরা খুঁজে মরি বাংলাদেশের লক্ষির চর কিংবা ভারতের গোচরণ থেকে বেলডাঙার নীলাভ আকাশ তারায়!
:







লেখাটি ফেসবুকে দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যান প্লিজ


https://www.facebook.com/logicalbengali/posts/1697144413853041?comment_id=1697147610519388&offset=0&total_comments=1&notif_t=feed_comment

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন