বুধবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

আঁচলের তলে বেড়ে ওঠা এক অকর্মণ্য সন্তানের (অ)কবিতা # ৬১



আঁচলের তলে বেড়ে ওঠা এক অকর্মণ্য সন্তানের (অ)কবিতা
:
আমার জীবনের বিবিধ প্রপঞ্চগুলো আলোকিত ঘনকের আকারে মা-ই সপ্তরঙা বানিয়েছেন। এটা কি বিস্ময়কর নয় যে, জীবনের প্রায় আধেক বেলা পশ্চিম দিগন্তে হেলে পরার পরও, মা'র আঁচলতলে বেঁচে থাকি আমি? জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই মার আঁচলে আবিস্কার করি নিজেকে প্রতিনিয়ত। কেবল স্কুলে বাজারে ঘুমোতে গেলেই আঁচল ছাড়তাম হয়তো্বা। স্নানও করতাম মার সা্থে তার আঁচল ধরে, এ জন্যে মার খেয়েছি বেশ কবার ভাইবোনের হাতে। ভার্সিটিতে পড়ার কালেও মা আর আমার প্রেমময়তা জেগে থাকতো সুদূর কদলীবনে হিরণ্ময় হরিণের মতো। নদীতীরের শিশিরাশ্রু বালুপথে মার আঁচলতলে পরজীবী প্রজাপতি হয়ে ওড়াউড়ি করতাম আমি প্রতিক্ষণে কতকাল কতদিন! এখন ধ্রুপদী সময়ের সিঁথিতে সিঁদুর হয়ে মা জেগে থাকে আমার হাতে তাঁর ছিন্ন আঁচলটি দিয়ে। বিশ্বের সর্বত্র আমি মার দেহজ ফুলের গন্ধ খুঁজে মরি পুরণো ক্ষয়িষ্ণু আঁচলটি ধরে-ধরে। কোলকাতার একুরিয়ামে স্বর্ণাভ বর্ণালী মাছের কেলিতে মায়ের আঁচলটি ভাসতে থাকে যখন, তখন দেহজ মেঘের বৃষ্টিরা জলজ চোখে নাচে সোনারঙ জলে ডু্ব দিয়ে দিয়ে। 
:
যাপিত জীবনের গার্হস্থ্যবেলায় যখন ঘুরতে যাই দক্ষিণ ভারতের Thrivananthapuram, তখন মাকে দেখি সৈকত বালুতে ওড়াতে তার অরঙ প্রজাপতি আঁচল, যা ধরে আছি আমি। সি-বিচ ছেড়ে সারিবদ্ধ কুয়াশাভরা পাতকুয়োয় দেখি মার আঁচলে সমুদ্র বাতাস নাচছে। অনামিকার যোধপুরের নগ্ন রেলক্রসিংয়ে মাকে দেখি জংশন মাস্টার হয়ে মৃত্তিকার ঘুমফুল মথিত করতে, মাটিতে আঁচল লুটিয়ে। আমার জীবন পথের পুরণো বিপর্যস্ত বাড়ির বুড়ো কঙ্কালের স্বপ্নবোনা রাতগুলো চিত্রনাট্য হয়ে উড়ে বেড়ায় মার আঁচলতলে। অপ্রতিভাবান আমি নিজ ব্যর্থতায় সহযোদ্ধা পেয়েছি মাকে সব রক্ষণাত্মক কিংবা আক্রমনাত্মক জীবন যুদ্ধে। ঈশ্বর ত্যাগি আমি মার আঁচল ত্যাগিনি কখনো, ধরে রাখি সর্বক্ষণ। তাই হয়তো তার আঁচলের গন্ধে এদেশ ছাড়তে পারিনি আমি বৈশ্বিক সব ভোগবাদি তাড়নায়ও। ফিরে আসি নিউজিল্যান্ড অস্ট্রেলিয়া ফ্রান্স কিংবা বুটেন ঘুরে এ হানাহানিপূর্ণ মননের কাঙালের দেশে। আর জীবনকে বাজি রেখে আঁচলের কথা ক্রমাগত লিখে যাই বোধহীন মৃত মানুষের মত। মা তোমার আঁচলটি কি মিশে গেছে মাটির সাথে, যে মাটি ছুঁয়ে যায় আমার ভাঙা মন প্রতিনিয়ত! অনেক দিন গত হওয়া মৃত মায়ের কাছে গেলে এখনো অবিকল তার রিণরিণে বাগ্বিধি শুনতে পাই, মৃত ধূসর ম্রিয়মান আঁচলতলে। 
:
বিষ্ণুদে, অমীয়চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ আর জীবনান্দের কবিতায় যখন খুঁজে মরি কলাকৈবল্যবাদ আর পাশ্চাত্য অনুসঙ্গের সব রূপসুষমা, তখন মার আঁচল প্রণোদনা দেয় আমায় বকফুল, ঘাসফুল, হিজলবন কিংবা ধূসর শালিকের উড়ে যাওয়া দিঘির টলটলে জলে। বোদলেয়ারের কাব্যনারীরা মার আঁচল হয়ে দাঁড়ায় হৃদপিন্ড বরাবর আমার! অ্যালেন গিন্সবার্গের কথায় মৌসুমী ভৌমিক যখন গাইতে থাকেন "শত শত চোখ আকাশটা দেখে, শত শত শত মানুষের দল, যশোর রোডের দুধারে বসত বাঁশের ছাউনি কাদামাটি জল" তখন হাজারো নাক্ষত্রিক ছুটে চলা মানুষের মাঝে মাঁয়ের আঁচল ধরা দেখি নিজেকে। আজ মায়ের মৃত্যুর দিনে আমার জীবন প্রান্তিকের হিসেবের খাতা ভরে ক্রমাগত লিখতেই থাকি লাল-নীল অক্ষরে মা-মাগো! 
:
পুনশ্চ !
:
[ কবিতা পোস্ট করিনা বলে অনেক ফেসবুক বন্ধুরা অনুযোগ করে আমায়। তাই মৃতদিবসে মাকে নিয়ে লিখলাম এ কবিতা। কিন্তু এটা কি কবিতা হলো, হলো কি গদ্য? হয়তো মাথামুণ্ডু কিছু্‌ই হয়নি। আসলে মায়ের আঁচলতলে মানুষ আমি। তাই আমায় দিয়ে কোন কিছু লেখা হবেনা কখনো কোনকালে। যতদিন ঐ আঁচল ধরে থাকবো আমি। হ্যা মা বেঁচে থাকলে নির্ভয়ে থাকতাম আমি পৃথিবীতে, লিখতাম শানিত ইস্পাতের মত। এমন কবিতা লিখতে পারতাম মার প্রণোদনায়, যা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিতো, ধ্বসে পড়তো সকল ধর্মান্ধ কবিতা, আর তাদের ধার্মিকতার মহাকাব্যগুলো। কারণ মা ছায়াময় বটবৃক্ষ হয়ে আগলে রাখতো আমায় এ জঙ্গীদের মাঝে, যেমন জঠরে রেখেছিল ন'মাস। মার বিকল্প আঁচল ধরতে পারি এ নারীর সন্ধান কেন পাইনি আমি আজো এ বিশ্বে? তাই কি আমি এমন অকর্মণ্য একটা মৃতমানুষ? যে পৃথিবী কাঁপানো কোন কবিতা লিখতে পারেনি আজো? ] 
:
গানের লিংক : 
মৌসুমী ভৌমিকের "শত শত চোখ আকাশটা দেখে, শত শত শত মানুষের দল, যশোর রোডের দুধারে বসত বাঁশের ছাউনি কাদামাটি জল"






https://www.facebook.com/logicalbengali/posts/1705969866303829





1 টি মন্তব্য: