রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

একটা অচেনা কুকুর ও অনামিকার মৃত্যু যন্ত্রণার দহন কাব্য [ চলার পথের সত্যি ঘটনার গল্পসিরিজ : ২৮ ]


:
কদিন আগে শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের কাছেই গাড়িচাপা পড়েছিল একটা পথের কুকুর। মারাত্মক আহত হয়ে সড়কদ্বীপে পড়েছিল প্রায় ঘন্টাখানেক। মৃত্যুর আগে রাস্তার মাঝে তার কাতরাণো দেখে গাড়ি থেকে নামলো অনামিকা। ড্রাইভারের সহায়তায় বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের ফুটপাতে নিয়ে পাশের দোকান থেকে দৌঁড়ে লিকুইড দুধ এনে মুখে দিলো কুকুরটির। রক্তাক্ত কুকুরটির সব দুধ মুখ বেয়ে মাটিতে পড়ে গেলেও, ঠান্ডা দুধের পরশে একবার চোখ তুলে তাকালো ঔৎসুক মানুষের দিকে। ভিড় জমে গেলো মুহূর্তে এক আধুনিক ঝকমকে তরুণির ফুটপাথে আহত কুকুর সেবা দেখে। ট্রাফিক পুলিশ কুকুরসহ সরে যেতে বললো অনামিকাকে ফুটপাথ ছেড়ে। এবার গাড়িতে তুলে কুকুরসহ অনামিকা হাজির হলো ঢাকার গুলিস্তানের প্রধান ভ্যাটেরেনারি হাসপাতালে।
:
অনামিকার আকুতিতে আর সামাজিক মর্যাদায় দুজন ডাক্তার পরিক্ষা শেষে বললো, খুবই যখম হয়েছে কুকুরটি। সরকারি কাগজে হাই এন্টিবায়োটিক ইনজেকশন লিখে দিলো প্রেকক্রিপশনে। ১০ মিটার দুরের পাশের ফার্মেসি থেকে বর্ণিত ঔষধ কিনে পুশ করে কুকুরসহ বাড়ি ফিরলো অনামিকা। পশুপ্রেমিক অনামিকার ৫-টি কুকুরের সাথে আহত কুকুরটির স্থান হলো তার 'ডগ হাউজে'। কিন্তু কদিনের চিকিৎসায় বসতে পারলেও, উঠে দাঁড়ালেই কাঁপতে থাকলো দুখাতুর মেয়ে কুকুরটি। চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে এর মাঝে অন্ধ হলো কুকুরটি, তাই কিছু দেখতো না সে। খুব সামান্যই খাবার খেতে পারতো অনামিকার এ রাস্তার কুকুর। ঐ হাসপাতালে আবার যোগাযোগ করলে কুকুরের অবস্থা দেখে আশাহত কথা শোনালেন সরকারি ডাক্তারগণ। হাল ছাড়লো না অনামিকা। এর মাঝে কুকুরটির যৌনাঙ্গ দিয়ে ব্লিডিং শুরু হয়েছে অব্যাহত ধারায়। তার পরিচিত একমাত্র মিসরিয় বিদেশী ডাক্তারকে নিয়ে এলেন বাসাতেই অনামিকা কুকুর চিকিৎসায়। জীবন বৈরিতার সাথে দ্বৈরথ দিগন্তে কাঁদতে থাকে অনামিকা ঘাসফুলের মত এ কুকুর যন্ত্রণায়।
:
সব দেখে মিসরিয় ডাক্তার বললেন, আহত হয়ে তার শরীরের ভেতর মারাত্মক যন্ত্রণা হচ্ছে। হাই এন্টিবায়োটিকের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে অভ্যন্তরিণ রক্তক্ষরণ হচ্ছে কুকুরটির। এখন জরুরি ভিত্তিতে রক্ত দিতে হবে তাকে। কিন্তু বাংলাদেশে যেখানে সব সময় মানুষের সেইম গ্রুপের রক্তই পাওয়া যায়না, সেখানে কুকুরের রক্ত পাবে কোথায় সে? অনামিকার গৃহপালিত ৫-কুকুরের সবার রক্ত পরিক্ষা করালো সে কিন্তু বিদেশি ঐসব কুকুরের সাথে রাস্তার কুকুরের রক্ত ম্যাচ করলোনা একটিরও। পরিচিত স্বজন যাদের কুকুর আছে, তাদের কজনকে ফোন করলো রক্তের জন্যে। অনেকে হাঁ-হুঁ করলেও রাস্তার কুকুরের জন্যে রক্তের কথা শুনে বিরক্তি প্রকাশ করলো বেশ কজন। বিরক্তির গান শোনালো কেউ কেউ।
:
অসহায় অনামিকা বিদেশি ডাক্তারের কাছে গেলো শেষ পরামর্শের জন্যে। সুহৃদয় ডাক্তার বললেন, এ কুকুরটির যন্ত্রণা লাঘবে তার হার্ট ব্লক করে তাকে মৃত্যু দিতে হবে। এ ছাড়া কুকুর বিদ্বেষী বাংলাদেশে আর কোন উপায় নেই এ কুকুরটির যন্ত্রণা লাঘবের।
:
ডাক্তারের এ কথায় ব্যর্থ দ্বৈরথে নাচে কষ্টের টিয়া পাখির ঝাক অনামিকার মনে। শিকারি বাঘের সামনে মৃত হরিণীর শুকনো রক্তের মত অনামিকা মাথা নেড়ে শায় দেয় ডাক্তারের কথায়। অবশেষে নিটোল সময়ের ব্যর্থ কৃষ্ণগহ্বরে মাথা রেখে অনামিকার সামনেই হার্ট ব্লক করার ইঞ্জেকশন পুশ করে ডাক্তার। শুকনো চোখে কাঁপতে থাকা অন্তক্ষরণের কুকুরটির নির্জিবতা বাঁশপাতা হয়ে উড়তে থাকে যেন। সপ্তরঙা দু:খাতুর কালাতিপাতের যন্ত্রণাকাতর জীবন ছাড়ার আগে, অনামিকার দিকে ভেজাচোখে তাকায় কুকুরটি। পৃথিবীর সমস্ত যন্ত্রণা আর ক্লেদ কুকুরটির চোখে-মুখে, হাত-পায়ে ভর করে দু:খ ঘোড়াদের কষ্টের হ্রেষাধ্বনি তুলে কুকুরটি নির্জিব হয় তখন। এ রাস্তার কুকুরটির জন্যে প্রাগৈতিহাসিক আদিম কষ্টরা সন্তর্পণে একাকার করে অনামিকার হৃদয়মন। ঘনকালো অচল জলধির কষ্টের মত অনামিকা চেয়ে থাকে নামহীন গোত্রহীন মৃত কুকুরটির দিকে। নিমজ্জমান প্রেমিকের ভালবাসার চিঠির ভাঁজ খোলার গন্ধের মত অনামিকা এক অঘোর গন্ধ শুকতে থাকে কুকুরটির চারপাশে। অনামিকা আর মৃত কুকুরের পাশ দিয়ে কুয়াশার কোল চিরে দু:খরা ছুটে যায় মহাকাশ দিগন্তে !



লেখাটি ফেসবুকে দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যান প্লিজ


https://www.facebook.com/photo.php?fbid=1699093766991439&set=a.1381466915420794.1073741828.100006724954459&type=1&theater&notif_t=like

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন