শুক্রবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

অতলান্তিকে সেন্টিয়াগো, ম্যানোলিন আর আমার মৃত্যুর গল্প ! ৪ পর্বের গল্পটির পর্ব # ২ [ চলার পথের গল্প # ১২ ]




[হেমিংওয়ের নোবেল পুরস্কার বিজয়ি The Old Man & The Sea'র প্রধান চরিত্র সেন্টিয়াগোর রূপকে গল্পটি লিখিত]
:
সেন্টিয়াগোর সমুদ্র সংলাগ তৃণছাওয়া কাঠের বাড়িতে দরজা নাড়তেই এগিয়ে এলো ১২/১৩ বছরের এক কিশোর। পরিচয় দিলো নাম তার 'ম্যানোলিন'। ম্যানোলিনকে পেয়ে টলটলা জলায়িত জীবনের সকরুণ গান খুশিতে রূপান্তরিত হয় আমার বসন্তের বাতাসে। এই হচ্ছ সেই কিশোর ম্যানোলিন, যে কিনা সব সময় থাকে সেন্টিয়াগোর কাছাকাছি। নিজের ঘর থেকে রুটি, পনির, মদ আর চুরুট নিয়ে সেন্টিয়াগোকে ধরিয়ে দিতো, আর হারপুণ পরীক্ষা করতো মার্লিন শিকারের হারপুণ। 
:
আমি সুদুর ঢাকা থেকে এসেছি বুড়ো সেন্টিয়াগোকে দেখতে এবং ম্যানোলিনকেও জানি, এ কথা শুনে যেন মনোবিকলিত জীবনের গান গেয়ে ওঠে কিশোর। চুলের শুকনো বরফ ঝেড়ে আমায় টেনে নেয় ওক কাঠের ঘাসের কুঁড়েতে। আগুন জ্বালিয়ে দুজনের শরীরে ওম দেয়, আমার আর নিজেরও। ঘরের অদুরে প্রবেশদ্বারে বিশালাকার মার্লিনের কঙ্কাল দাঁড়িয়ে আছে, যা এ বাড়ির প্রবেশদ্বারে তীরে রক্ষিত। ম্যানোলিন আনন্দের অনিদ্রাকুসুম জ্বালিয়ে বলে, 'ঐ সেই মার্লিনটার কঙ্কাল, যা শিকার করেছিল সেন্টিয়াগো একাকি চুরাশি দিনের সপ্তপদি জীবনবোধের প্রচেষ্টায়। জান তুমি এ শিকার কাহিনি? ওর কথা শুনে আমার ভূমি মনে প্রেমের লীনতা হাসে, বলি তাইতো এলাম ম্যানোলিন ভাললাগা সময়ের রূপরেখা এঁকে এঁকে!
:
বিকেলের সূর্য ঢলে পড়ার আগেই আমি সেন্টিয়াগোর সাথে দেখা করতে চাই জানালে, অপরূপ জৈবিক শিল্পক্রীড়া প্রদর্শনে ম্যানোলিন বলে, 'সে এখন সমুদ্রতীরের চোলাই মদের আড্ডায়। সেখানে চুর এখন মদের নেশায়। তুমি যাবে ওখানে'? আমি মাথা নেড়ে সম্মতি দিলে, আচ্ছন্নতায় ডোবা স্মৃতির গান গাইতে গাইতে ম্যানোলিন নিয়ে চলে আমায় বড় বড় পাথর ঘেরা বৃক্ষময় ওক কাঠ বাড়িতে। যেখানে আরো জনা দশেক বুড়োর সাথে মদ গিলছে বুড়ো সেন্টিয়াগো। ঊষর ভূমণ্ডলে জলের তৃষ্ণার মতো আমি সেন্টিয়াগোর দিকে তাকিয়ে থাকি অনিমেষ। ম্যানোলিন পরিচয় করায় সেন্টিয়াগোর সাথে আমার। বলে, 'তাকে দেখতেই এসেছি হাজার যোজন দুরের বাংলাদেশ থেকে'। শুনে উঠে দাঁড়ায় বৈভবের মৌনতায় ছায়া প্রাণময়তায় ভরা সেন্টিয়াগো, হাত বাড়ায় বুকে টেনে নেয়ার জন্য কিন্তু নেশার ঘোরে কালি মাখে যেন মানবজমিনের হৃদে। এক শিহরণপূর্ব আনন্দ আর দুখাতুর অনিন্দ্য অবয়বে আমি সেন্টিয়াগোকে জড়িয়ে ধরি। এদেশে নারীরা পুরুষকে জড়িয়ে ধরে, পুরুষেরা পুরুষকে নয়। তাই কামাতুর হিংসায় জ্বলা মিচকে পতিতারা বাঁকা চোখে শিষ দেয় আর চোখ মারে আমার দিকে। স্বল্পবসনা দেহজ নারীরা ডাকে চোখের ইশারায়। যদিও ওদের চপল রূপভারে ক্ষয়িষ্ণু জীবন এখন এ সমুদ্র তট বন্দরে। 
:
বোধের গভীরের কষ্টদের চেপে রেখে সেন্টিয়াগো হাসে আটলান্টিক বাতাসের শীতলতার নীলাভ পাথারের মত। এক সময় নিঃসঙ্গতার ক্রুশে ঝুলতে ঝুলতে আমার আর ম্যানোলিনের কাধে হাত রেখে সেন্টিয়াগো হাঁটতে থাকে, দুখাক্রান্ত ঘুমন্ত সমাজ, আর ঘরবাড়ি দুপায়ে মারিয়ে। পথশেষে ঘরে পৌছতেই যেন বারান্দায় শুয়ে থাকা কষ্টেরা উঠে দাঁড়ায় সেন্টিয়াগোকে ঘিরে! এক বোহেমিয়ান সামুদ্রিক জীবন থেকে ফিরে এসে দেখে তার স্ত্রী মেরি চলে গেছে করুণতার দুর্লঙ্ঘ নিয়তি মাঝে। এরপরো সমুদ্র ছাড়েনি সেন্টিয়াগো। নতুন স্ত্রী মার্থাকে ঘরে ফেলে দিনরাত হারপুণ হাতে তিমি আর মার্লিন শিকারি দ্রোহি সেন্টিয়াগো ঘুরে বেড়োতো অতলান্তিকের অতল জলে। এক দুপুরে ফিরে মার্থাহীন কষ্টভরা সমস্ত বিকেল কাটালো জীবনের অন্তিম আর্তনাদে কেঁদে-কেঁদে। স্ত্রী হারিয়ে এ যেন বৃষ্টিস্নাত এক মরীচিকা প্রেম সমুদ্রের প্রতি। ক্লেদাক্ত কষ্টের আকাশে ভাসিয়ে এক সময় প্রেমিকা পাওলিনও হারিয়ে যায় চোলাই মদের আড্ডায়। সবশেষে সেক্সপার্টনার হার্ডলিকে হারানোর পর অপ্রাপ্তির দাসেরা ইতিউতি ঘোরে সেন্টিয়াগোর জীবনে। কষ্টেরা জাল ফেলে আলোময় আঁধারঘন তার জীবন নদীতে। তাই চার-নারী হারিয়ে আটলান্টিকের গভীর নীল জলে রক্ত আদিমতার নেশা জাগিয়ে ঘুরে বেড়ায় একাকি সারাদিন সারাক্ষণ বুনো গাঙচিল হয়ে। এই সেই সেন্টিয়াগো, বুড়ো মার্লিনের মৃত হাড়ের বিভাজিত করুণতায় যে কাঁদে অহর্নিশ! 


 লেখাটি ফেসবুকে দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যান প্লিজ !


:

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন