রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

৯-জন হিন্দু যুবতি মেয়ে ও আমার মায়ের গল্প : পর্ব # ৫ [ চলার পথের সত্যি ঘটনার গল্পসিরিজ : ২৪ ]







আমাদের ৯-জনকে নিয়ে যখন আনন্দ ভাগের কাড়াকাড়ি, তখন মাসিমা অবস্থা বুঝে দুজন করে ৪ নৌকোতে ভাগ করে ৮-জনকে দিয়ে দিলেন। আমার পা ভাঙা বলে, তিনি আর আমি রইলাম একটা ছোট জেলে ডিঙিতে। জেলে নৌকোতে নারীদের কখনো উঠতে দিতো না জেলেরা 'অপয়া' বলে। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বরের ঐ দিনে সব জেলে নৌকো উন্মু্ক্ত করলো তাদের 'অর্ঘ্য' আমাদের মত 'অপয়া' নারীদের জন্যে। এমনকি মুসল্লি মাঝিরা টুপি মাথায় দিয়ে হিন্দু নারীদের দেখলে যারা আগে "আসতাগফিরুল্লা" বলতো, তারাও আমাদের টেনে তুলতে চাইলো তাদের নৌকোয় দাড়ি টুপির কথা ভুলে এক অপার আনন্দে। মাসিমা ঘোষণা করেছিলেন, আজকের এ নৌকো বাইচে প্রথম হওয়া নৌকোকে তিনি দিয়ে দেবেন তার বাবার বাড়ি থেকে আনা প্রিয় "লাল গাইটা"। এবং এ ঘোষণা ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়ে লক্ষ্মির চরের বাতাস কাঁপিয়ে মেঘনার তীব্র ঘুর্ণন উপেক্ষা করে ৪-ছিপ নৌকো 'জয়বাঙলা' ধ্বনি তুলে এগিয়ে চললো ঝড়ো গতিতে "লাল গাই" এর টানে। 
:
আমাদের বিস্মিত আর বিমোহিত করে আনন্দে জলে ঝাপ দেয়া ১০-দক্ষ মাঝি মূহূর্তে লাফিয়ে উঠলো মাসিমা আর আমাকে বহনকারী ছোট্ট জেলে ডিঙিতে। ছোট ৩ মাঝির ডিঙি বিধায় কেবল তিনটি বৈঠাই ছিল ঐ নৌকোতে। কিন্তু প্রবল আনন্দ তাড়নায় তারা বৈঠা ছাড়াই নৌকোয় পাটাতন হিসেবে বিছানো বাঁশের :"চালি" হাতে প্রবল জয়বাংলা ধ্বনিতে বাইতে থাকলো নৌকো। এক বিস্ময়কর জলকেলিতে মেঘনার জলাবর্ত যেন খিলখিলিয় হেসে উঠলো এবার। পৃথিবীর সব জলদেবতারা লিখান করে আমাদের এ জেলে নৌকোর সপক্ষে দাঁড়ালো দৃঢ়চিত্তে। চোখের পলকে দক্ষ মাঝিদের ৪ ছিপ নৌকো পেছনে ফেলে মাসিমা আর আমার ছোট্ট জেলে ডিঙি এগিয়ে যায় সব নৌকো, বিপরীত স্রোত আর জলঘুর্ণনকে পাশ কাটিয়ে। এ দৃশ্যে অবাক বিস্ময়ে সব নৌকোর মাঝিরা তাদের হাতের বৈঠা ওপর তুলে জয়বাঙলা জয়ধ্বনি দেয়। কে যেন তাদের হাতে ঝটকা দিয়ে ওপরে তুলে ধরে দুহাত। বাওয়া বন্ধ করে তারা শরীরের সব শক্তি একাকার করে কেবল ধ্বনি দেয় 'জয় বাঙলা' আর জয় আমাদের 'রাবেয়া বুবু'। ৪ ছিপ নৌকোর মাল্লারা তাদের এ পরাজয়কেও জয় হিসেবে উপভোগ করে এক চমকপ্রদ পরমানন্দের ঐকতানে। 
:
এসব কথা বলতে বলতে গোচরণের এ ঝিরঝরি বাতাসে সুরেন্দ্র, স্বর্ণা আর মৃত্তিকার মা পুরণো শ্যাওলামাখা পুকুরঘাটের কষ্টের মত নেতিয়ে পরে। এমন সৎ কথনের শিহরণে সুরেন্দ্র, স্বর্ণা আর মৃত্তিকার চোখ জলে আর্দ্র হয়। মাসিমার এ আনন্দ অথচ কষ্টের কথায় আমি প্রাকমৃত জ্বলতে থাকা নক্ষত্রের মত আনন্দে পুড়তে থাকি। আমার ধুলোগ্রামে আনন্দ আর দু:খরা এখনো কিভাবে হাসে আর কাঁদে আমার মৃত মার জন্যে তা চিন্তনে হৃদয় মাঝে লুকিয়া থাকা ঘামেরা আমার কপালে উঠে আসে। বুকের কষ্টেরা হুহু করে বাইরে বেরুতে চায় চোখের জল হয়ে। শান্ত স্নিগ্ধ গোচরণের এ ছোট্ট ঘরে মহাকালের এ পাঁচ অসহার নারী পুরুষ এক আনন্দের তুষার ঢাকা তুঁষের আগুনে পুড়তে থাকি ক্রমাগত। ভালবাসার কষ্টকর আয়োজনের সব খাবার কেউই আর ষ্পর্শ করতে পারিনা আমরা। মাসিমার নীলাভ চোখ রক্তাভ হয়ে রক্তনীল চোখের চলে। কষ্ট কমাতে আমি বাইরে পাতাবিহীন মৃত লাল রক্ত পলাশ বৃক্ষের দিকে তাকিয়ে থাকি নিবিড়তায়!



লেখাটি ফেসবুকে দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যান প্লিজ

https://www.facebook.com/logicalbengali/posts/1696429943924488?comment_id=1696625373904945&notif_t=feed_comment

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন