রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

৯-জন হিন্দু যুবতি মেয়ে ও আমার মায়ের গল্প : পর্ব # ৪ [ চলার পথের সত্যি ঘটনার গল্পসিরিজ : ২৩ ]



ঘন বনের ব্যথাতুর কুহকগুলোকে ঝেড়ে ফেলে মৃত্তিকার মা পুন. শুরু করে-

মাসিমার বাবার বাড়ি বেশ ধনী ছিল। তোমাদেরও অনেক জমি আর গরু মহিষ ছিল। তাই আমাদের কারণে তোমাদের ঘর পুড়লেও কোন কিছুতেই তেমন সমস্যা হয়নি। রাখালেরা রাতের অন্ধকারে চাল-ডাল নিয়ে আসতো গ্রাম থেকে। আমরা মাচান ঘরের এক কোনে উঁচু মাটির টিলা তৈরি করে সেখানে রান্না করার চুলো তথা রান্নাঘরের মত বানিয়েছিলাম। কেউ মাছ কুটতো, কেউ ভাত রান্না করতো, কেউ যেত রাখালের সাথে দুধ দোহাতে। রাখালেরা যখন দুধ টানতো ওলান থেকে, তখন মহিষের বাচ্চাকে ধরে রাখতে হতো, যাতে দুধ দোয়াতে পারে নির্বিঘ্নে। 
:
এসব কাজই করতাম আমরা দিনের বেলা। রাতে কখনো প্রদীপ জ্বালাতাম না বিশেষ জরুরি ছাড়া। কেরোসিনের প্রদীপ ছিল আমাদের টংঘরে। রাতে আলো দেখলে নদীর জেলে নৌকার জেলেরা কখনো আসতে পারে টংঘরে কোন কাজে বা আগুন ধার নিতে কিংবা নদীতে চলমান পাকিস্তানি সেনাদের গানবোটগুলোর নজর পরতে পারে এ ভয়ে অন্ধকারেই থাকতাম আমরা। তবে আলো না থাকা চরে আসলে এক রকমের আলোময়তা থাকে, যাতে কাছাকাছি সব কিছুই দেখা যায়। তাই তেমন অসুবিধে হতোনা আমাদের। ৫/৬ দিন পর মাসিমা একটা ছো্ট্ট রেডিও জোগার করে আমাদের জন্যে। ব্যাটারি চালিত ঐ রেডিওতে 'বিবিসি', 'কোলকাতা স্টেশন' আর 'স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র' শুনতাম আমরা রাতে। মাসিমার কঠোর নির্দেশ আর জানাজানির ভয়ে আমাদের মা বাবাও কখনো চরে আসতো না আমাদের কাছে। কেবল গোপনে সংবাদ নিতো রাখাল আর মাসিমার কাছে থেকে। মাঝে মধ্যে ছোটখাটো জিনিস, যেমব ডাব, পাকা পেঁপেঁ, লাউ পাঠিয়ে দিতো আমাদের পরিবার থেকে, যা রাতে গোপনে নিয়ে আসতেো রাখালেরা। মাসিমার বাবার বাড়িতে আমাদের সব জিনিস জমা করতো আমাদের মা বাবারা। রাতের কোন এক সময় ঐ বাড়ির মজুর তা নৌকোতে তুললে রাখালরা তা নিয়ে আসতো চরে, আমরা সবাই গিয়ে হাতাহাতি করে তা টংঘরে আনতাম। 
:
কথার ফাঁকে মৃত্তিকা জানতে চায় মায়ের কাছে। মা রাখালরা কি মুসলমান ছিল নাকি হিন্দু? সুরেন্দ্র জিজ্ঞেস করে আমার কাছে, দাদা ঐ রাখালরা কি বেঁচে আছে এখনো?
:
মাসিমার মুখ এবার উজ্জ্বলতর হয়, বলে হ্যা ওদের নামও মনে আছে আমার। একজন ছিল কিছুটা বয়সি নাম ছিটু খাঁ। অপর দুজন ছিল একদম কম বয়েসি ছেলে নাম ছিল ধলু আর শহিদ। তুমি কি চেন তাদের বাবা? বলি, এ নামে বেশ কজন মানুষ আছে আমাদের গাঁয়ে। ঠিক বলতে পারিনা কোন জন? আমি খোঁজ নিয়ে জানাবো মাসিমা এর পর এলে। প্রায় ৪৩ বছর পরও মাসিমার মুখে ফেলে আসা গাঁয়ের ৩ মুসলিম রাখালের নাম শুনে আমার মৃন্ময়ি যৌবনময়তার ভাললাগারা লাফিয়ে ওঠে এবার। বলি এমন জ্বলজ্বলে স্মৃতি কিভাবে এখনো কাজ করছে মাসিমা? 
:
হৃদয়ের শুকিয়ে যাওয়া পুরণো ঘাসকে জল দিয়ে সতেজ করে মাসিমা হেসে বলে, চরে কোনো টয়লেট ছিলনা। তাই টংঘর থেকে বেশ দুরে ঘন হোগলা পাতার বনে যেতাম আমরা। তবে আরো অনেকদিন এ চরে থাকতে হতে পারে এ বিবেচনায় আমরা মাটি কেটে গ্রাম থেকে কাঠ এনে গ্রাম্য ১টা টয়লেট বানানো যখন প্রায় শেষ করেছিলাম, তখনই খবর আসে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কথা মানে আমাদের চর জীবনের ইতিটানার কথা।
:
১৬ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় টংঘর থেকে বের হয়ে আমরা বিস্মিত হই সবাই। রেডিওতে স্বাধীনতার সংবাদ শুনে, মাসিমা খুব ভোরে রাখালদের নিয়ে গাঁয়ে ফিরে, প্রায় একশ মাঝিকে জড়ো করে ৪-ছিপ নৌকো নিয়ে আমাদের নিতে এসেছেন চরে এবার প্রকাশ্যে। চার ছিপ নৌকোতেই মাঝির আসনে বসা আমাদের বুড়ো মা বাবারা, আর গাঁয়ের পাশের মুসলিম তরুণেরা। অনেক মুক্তিযোদ্ধারাও এসেছে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে সে নৌকোতে। পাশের অসংখ্য ছোট জেলে ডিঙিও বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে ভিড়েছে এ হোগলা পাতার চরে। এ যেন অনেকটা বধু বরণের মত, ন কন্যার বরণ এক সাথে। নদীর ঘাটে পা রাখার আগেই সব নৌকো থেকে "জয়বাঙলা" ধ্বনি দিলো সবাই এক অমোঘ অর্ক্রেস্ট্রায়। আমরা দৌঁড় দিলাম সবাই এক সাথে নদীর তীরে। আমার ভাঙা পা তখনো ভালো হয়নি, খুড়িয়ে হাটি আমি তখনো। কিন্তু দৌঁড়ে সবার আগেই চলে এলাম ঘাটে কি এক অনন্য উন্মাদনায়। কারো সাহায্য ছাড়াই নৌকোতে উঠতে চাইলাম। ৪ নৌকোর সবাই চাইছিল আমরা ৯ জনেই যেন তাদের নৌকোতেই উঠি। মাঝিরা আনন্দে কেউ জলে লাফিয়ে পড়লো, কেউবা টেনে তুললো আমাদের তাদের নৌকোয়। পুরো বাংলাদেশের স্বাধিনতা যেন তখন ঐ অখ্যাত হোগলা পাতার লক্ষ্মির চরেই সমাগত তখন।
:

লেখাটি ফেসবুকে দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যান প্লিজ

https://www.facebook.com/photo.php?fbid=1696380437262772&set=a.1381466915420794.1073741828.100006724954459&type=1&theater&notif_t=photo_comment

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন