শুক্রবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

ত্রিনিদাদের পুজা এবং কানাডা অভিবাসি এক বাঙালির জীবন উপাখ্যান [ চলার পথের গল্প # ৫ ]




ব্লগে লেখালেখির সূত্রে টরেন্টো প্রবাসি ‘পাগলা বাবা’র সাথে পরিচয় হয় আমার গত বছর নেটে। সেই সূত্রে ২-মাস আগে বাংলাদেশে এলে আমার বাসায় অবস্থান করে ‘পাগলাবাবা’। অনেক গল্প, অনেক কথা, অনেক হাসি-কান্নার অভিজ্ঞতা আর জীবন সংগ্রামের এক নাটকিয় কাহিনি শোনায় আমার প্রিয় বন্ধু ‘পাগালাবাবা’। কেমন করে প্রায় ১-বছর ধরে নানা অবৈধ পথে আমেরিকা ঢুকতে না পেরে, কিভাবে ঢুকলেন ক্যানাডাতে প্রায় ২৫-বছর আগে - তারই এক নাটকিয়, বিস্ময়কর, হৃদয়ঘন, আবেগ আপ্লুত, আর কৌতুহল উদ্দিপক জীবনময়তার অনবদ্য কথকতা আজকের লেখা। সে এখন আমার খুব প্রিয় বন্ধু! তাকে এয়ারপোর্টে বিদায় জানাতে যেতে হয় আমাকে অফিস ছেড়ে হলেও!

ঐ বন্ধুর অন্য একটা “রায়’ পদবির নাম থাকলেও, তাকে আমি ‘পাগলাবাবা’ বলে সম্বোধন করি, সেও তা পছন্দ করে খু্বই। ছাত্রাবস্থা থেকেই পাগলাবাবার ইচ্ছে, যে কোন ভাবে আমেরিকা যাবে সে বৈধ কিংবা অবৈধ পথে। খুঁজতে থাকে নানা ফাঁক ফোঁকড়। একজনের কাছে জানতে পারে ‘বাহামা’ থেকে ৩১-কিলোমিটার সমুদ্র-পথ যুক্তরাষ্ট্রের ‘মায়ামি’র। ঐ পথটুকু স্পিড বোটে পাড় হওয়া তেমন জটিল কাজ নয়, সাঁতার জানা এ বাঙালি পাগলাবাবার কাছে। কিন্তু বাহামা যাবে কিভাবে? নানা বইপুস্তক আর তথ্য উপাত্ত ঘেটে (তখন ফেসবুক ছিলনা) বের করে যে, বাংলাদেশের নাগরিকদের ‘বাহামা’ যেতে কোন ভিসা লাগেনা, কেবল রিটার্ন টিকেট আর পর্যাপ্ত ডলার শো’করলেই বাহামা এয়ারপোর্টে ৬-মাসের ভিসা দেয় বাংলাদেশিদের। আরো জানলো যে, বাহামা হচ্ছে একটা পর্যটন প্রধান দেশ, প্রতি বছর কয়েক লাখ মানুষ বাহামা বেড়াতে যায় পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে।

প্লান মোতাবেক ঢাকা-লন্ডন-বাহামা রিটার্ন টিকেট কেটে বিমানবন্দরে যথাসময়ে হাজির হলো পাগলাবাবা। সাথে নিল ডলার, বাংলাদেশের অনেক ডাকটিকেট, আর ২/৫/১০/২০ টাকার বাংলাদেশি অনেক নতুন নোট। কারণটা হচ্ছে, বাহামার পর্যটকদের কাছ ডাকটিকেট ও বাংলাদেশি কমদামি নোট বিক্রি করা। চমৎকার বুদ্ধি পাগলাবাবার কিন্তু বুদ্ধি মার খেল ঢাকা বিমানবন্দরে। সব ঠিক থাকা সত্বেও তাকে ছাড়লো না বিমানবন্দর ইমিগ্রেশন। কারণ দেখালো, তার মত পাগলাবাবার বাহামা ঘুরতে যাওয়া অযৌক্তিক, এটা অবৈধ পথে আমেরিকা যাওয়ার বাহানা মাত্র, অত্রএব ‘রিটার্ন টু ব্যাক হোম’।

কিন্তু দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, হার না মানা, যুদ্ধবাজ ‘পাগলাবাবা’ এবার ট্রাভেলে গিয়ে অন্য রকম করলো টিকেট। কোলকাতা-বোম্বে-লন্ডন-বাহামা, আর সাথে ঢাকা-কোলকাতার ১টা আলাদা টিকেট। এবার বাহামার কথা গোপন করে চলে গেল কোলকাতা। সেখান থেকে পরদিন প্লান মোতাবেক সোজা ২-দিনের দীর্ঘ আর ক্লান্তিকর পথ জার্নি শেষ করলো বাহামার ‘নাসাউ’ বিমানবন্দরে। কিছুই তেমন জানতে চাইলো না কেবল ডলার আছে কিনা এবং ক’দিন থাকতে চান বাহামা? ব্যাস ভিসা! বাহামার ভিসা!!

একটা কমদামি ছোট মোটেলে উঠলো পাগলাবাবা। রাতে থাকে সেখানে, আর দিনে খোঁজ করে মায়ামি যাত্রার পথ ঘাট, রুট। ১-মাসের মধ্যেই দালাল পেয়ে যায় ১০০০ ডলারে যাত্রার, যারা রাতে মায়ামি উপকূলে নামিয়ে দেবে তাকে ও অন্যদের। অনেক পর্যটকের কাছে বাংলাদেশি ডাকটিকেট ও মুদ্রা এক ডলার করে বিক্রি করে প্রায় ৩০০০ ডলার আয় করে পাগলাবাবা। একদিন সত্যিই ২-ইঞ্জিনচালিত “টার্বো-ক্যাটে” রাত ১-টায় ‘নাসাউ’ ছাড়ে পাগলাবাবারা ২৪-জন। এ বিজন জলসমুদ্রে সে একাই বাঙালি, আর সব অন্যান্য দেশের বিশেষত আফ্রিকান। প্রচণ্ড গতির ‘টার্বোজেট’ জলমালাকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে বর্ণিত সময়ের আগেই পৌঁছে মার্কিন জলসীমায়। মায়ামির ১০/১৫ কিলোমিটারের কাছাকাছি পৌঁছতেই মার্কিন রণতরী থেকে গোলা নিক্ষেপ করে টার্বোজেটের দিকে। হায় বিপদ ! মার্কিন রণতরীর চোখে পড়ে গেছে টার্বো। সব বাতি নিভিয়ে কিয়ামতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে মুহূর্তে জেট ঘুরিয়ে দেয় অথৈ নীল সমুদ্রে, সোজা দক্ষিণে কিউবা-ক্যারিবিয়ানের দিকে। অন্ধকার প্রবল স্রোত, ঢেউ আর প্রচণ্ড জলকেলিতে টার্বো গিয়ে ওঠে জনমানবহীন ‘বিমিনি’ দ্বীপে। সারারাত অন্ধকার বালুরাশিতে বসে থাকে ২৪-জনের পাগলাবাবার দল শেষ বিচারের প্রতিক্ষায় যেন !

সূর্যালোকে টার্বো-মাঝিরা আবার সবাইকে নিয়ে যাত্রা করে মূল বাহামার দিকে। ১০০০-ডলারের সারারাতের যাত্রা শেষে দুপুরে অভুক্ত ২৪-স্বাপ্নিক আমেরিকাবাসী ক্লান্তি, শ্রান্তি আর একরাশ বিষণ্নতাকে সাথী করে নাসাউর রাস্তায় ঘুরতে থাকে পথহীন পথিকের মত! পাগলাবাবার হৃদয়ে বাজে ক্লান্ত করুণ ঘুঘুর ডাক।

১০/১২ দিন পর হঠাৎ সৈকতে এক বাঙালি ললনার দিকে চোখ পড়ে পাগলাবাবার। কথা হলে বুঝতে পারে সে ‘ত্রিনিদাদ ও টোবাগো’র নাগরিক। তার পূর্বপুরুষ ভারতের ভুপালের। অল্প হিন্দিও জানে মেয়েটি কিন্তু ভারতীয় এথেনিক বিধায় চেহারা বাঙালি ললনার মতই। তার সাথে বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করে পাগলাবাবা, সুন্দর চেহারাখানি এখানে প্লাস পয়েন্টের ভূমিকা পালন করে দারুণ। একদিন মায়ামি যাত্রার সব কথা খুলে বলে ত্রিনিদাদ-কন্যা ফিউচার বন্ধু ‘পুজা রত্নাকর’-কে। কেন যেন মায়া কিংবা প্রেম হয় পাগলাবাবার প্রতি পুজার। সে তাকে তার সাথে ত্রিনিদাদ যেতে বলে এবং ওখানের পাসপোর্টে যুক্তরাষ্ট্র ঢোকা সহজতর বিধায়, তাকে ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর পাসপোর্ট করে দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। পাগলাবাবা যেন রাজ্য আর রাজকন্যা হাতে পায় এক লটারিতেই। অতএব সানন্দে পুজার সহগামি হয় ঢাকার পাগলা!

পুজার হাতে ধরে ত্রিনিদাদের ‘পিয়ারকো’ বিমানবন্দরে নেমে সোজা চলে যায় পুজার গ্রামের বাড়ি ‘সিপারিয়ায়’, যেখানের অধিকাংশ মানুষই কথা বলে হিন্দি আর ভুপালিতে, যারা ভারত থেকে গিয়েছিল ঐ অঞ্চলে পরিজায়ি পাখির মত অনেক বছর আগে। আখ ক্ষেতের পাশে দরিদ্র পুজাদের কাঠের পাটাতন ঘরে লবনাক্ত সমুদ্রের উথাল বাতাসে আনন্দে দিন কাটে পাগলা বাবার। পুজার পরামর্শে পাগলাবাবা তার বাংলাদেশি পরিচয় গোপন করে কোলকাতার বাঙালি হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেয়, যাতে পুজার বাবা সহায়তা করে পাসপোর্টে করতে। ৩-মাসের মাথায় পরিচয়ের সব কাগজপত্র পুজাই ঠিক করে একদিন ‘পোর্ট অব স্পেনে’র পাসপোর্ট অফিস হাজির হয় পাগলাবাবাকে নিয়ে। এর মাঝে হিন্দিতে কথা শিখিয়ে দেয় পাগলাবাবাকে। পুজা পাসপোর্ট অফিসে পাগলাবাবাকে তার ‘স্পাউস’ হিসেবে পরিচয় দেয় ভারত থেকে আসা ‘নবাগত ফিঁয়াসে’ হিসেবে। ৫-দিনের মাথায় পুজা নিয়ে আসে তার “মানবিক স্পাউসের” নতুন দেশের পাসপোর্ট বিনা স্বার্থে, কেবল হয়তো মন কিংবা হৃদয়জনিত কারণে। হায়রে হৃদয় তুই কি বাণিজ্য শিখলি না, এমন কেন হলি?

পাসপোর্ট পেয়ে উতলা পাগলাবাবা পাড়ি জমাতে উদগ্রিব থাকে যুক্তরাষ্ট্রে। ফসলি মাঠের বিদীর্ণ সামুদ্রিক বাতাসে নিজ চোখের চিকচিকে জল চেপে পুজা পাগলাবাবাকে যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তে ক্যানাডা যেতে পরামর্শ দেয়। একদিন ক্যানাডিয়ান এয়ারে বিদায় জানাতে পুজা আসে ত্রিনিদাদের ‘পিয়ারকো’ এয়ারপোর্টে। বোর্ডিংসহ সব নিজেই ঠিক করে দিয়ে, বিদায়ক্ষণে ত্রিনিদাদ-কন্যা আকস্মিক বাঙালি গ্রাম্য নদী-তীরবর্তী কিশোরিতে রূপান্তরিত হয়ে পিয়ারকো বন্দরের বাতাসকে ক্লেদাক্ত করে রিণরিণে কান্নায়। শ্রাবণের অঝোর জলধারায় পাগলাবাবা বুঝতে পারেনা সে কি সিপারিয়ার আখ ক্ষেতের ঝিরঝিরে ছায়ায় ফিরে গিয়ে পুজার হাত ধরবে? নাকি দেশে ফেলে আসা চিন্তিত স্বজনদের মুখে হাসি দেখবে? ঢাকায় প্রায় বছরব্যাপী চিন্তিত স্বজনের মুখ চেয়ে পুজার হাত ছেড়ে ইমিগ্রেশনে এগিয়ে যায় পাগলাবাবা। একটিবারও ফিরে তাকায়না পেছনে এক মুহূর্তের জন্যেও, হয়তো অফ্রিয়াসের সাইরেনের বাঁশির মত পুজা তাকে আটকে দেবে এ ত্রিনিদাদে। হায় হৃদয় ! হায় প্রেম ! তুই কেন এলে বিশ্বে?

বোয়িং ৭৪৭-এ৩ সুপরিসর জ্যাম্বোজেটে কিছুই মুখে দিতে পারেনা পাগলাবাবা। পুজা বিমানের সর্বত্র তাকে ছিন্নভিন্ন আর রক্তাক্ত করতেই থাকে। চালক, ক্রু আর বিমানবালা হয়ে পুজা বিমানকে লণ্ডভণ্ড করতে থাকে ক্রমাগত ক্যারিবিয়ান সামুদ্রিক ঝড় হয়ে। হঠাৎ বুক ফেটে প্রচণ্ড শব্দে তা প্রকাশিত হয় পাগলাবাবার হৃদয় জুড়ে! পাশের সিটে বসা বিদেশি সহযাত্রী বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করে, “Any thing wrong”? অনেকটা ধাক্কা দিয়ে ককপিট থেকে পুজাকে পিয়ারকোতে ফেলে এক সময় টরোন্টোতে নামে ব্যোমযান। নানা প্রশ্নের পর পুলসিরাত পার হয় পাগলাবাবা। নানা সংগ্রাম, ঘাত-প্রতিঘাত, জেল-জীবন আর দু:খের সাথে লড়াই করতে করতে প্রায় ৪-বছর চলে যায় ওন্টারিও আর টরেন্টোতে। অবশেষে একদিন পেয়ে যান কানাডার পাসপোর্ট। এক সময় স্ত্রী আর সন্তানকে নিয়ে যান সেখানে জীবন বাস্তবতায়। ছেলেটি এখন বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে ভাল বেতনে জব করে টরোন্টোতে, আর মেয়েটি পড়ে পাবলিক স্কুলের গ্রেড-টেনে। আমিও হয়তো একদিন দেখতে যাব তার টরেন্টোর সংসার, পাগলাবাবার এমনই ইচ্ছে আমাকে নেয়ার।

সময়ের পেন্ডুলামে ২৫-বছর কাটানোর পর এ লেখকের সাথে এ গল্প যখন বলছিলো ‘পাগলাবাবা’ তার ঢাকার ফ্লাটে, তখন পুজা আর তার সিপারিয়া গাঁয়ের স্মৃতিতে এ পৌঢ় বয়সেও অঝোরে কাঁদলো ‘পাগলাবাবা’। জানিনা এক অচেনা বন্ধু ‘পাগলাবাবা’ আর তার ত্রিনিদাদ বন্ধু ‘পুজা’র জন্যে এ লেখকের চোখও কেন আংশিক ভিজে উঠেছিল সেদিন? এ কথা কি জানে এ মহাবিশ্বের পুজা, সিপারিয়া গাঁ, আর ত্রিনিদাদের মানুষ? পুজা কি এখনো বাস করে পাগলাবাবার স্মৃতি নিয়ে সিপারিয়া গাঁয়ে? এখনো কি সেখানের সামুদ্রিক বাতাস পুজা আর পাগলাবাবার ম্মৃতিগুলোকে উড়িয়ে নিয়ে ঘুরতে থাকে সিপারিয়া গাঁ আর ক্যারিবিয় সাগরে? এ বাতাস কি ছুঁয়ে যায় টরেন্টোর পাগলবাবাকে আর সিপারিয়ার পুজাকে?

[সত্য ঘটনা অবলম্বনে লিখিত]


পর্ব : ২ (লেখক যখন ত্রিনিদাদে পুঁজার খোঁজে)

টরেন্টোর "পাগলাবাবা" এবং ঢাকার "পাগলাবন্ধু" অবশেষে পুজার বাড়িতে

গত বছর পুজা আর পাগলাবাবার ঘটনাটি জানার পর আমার অনেক ফেসবুক বন্ধুর মত আমারো মননেও হাতুড়ি পেটাতে থাকে পুজার খোঁজ নেয়ার বিষয়টি। অনেক বন্ধু আমাকে এ ব্যাপারে তাগিদ দেয়। টরেন্টো থেকে টেলিফোন করলেই পাগলাবাবাকে জ্বালাতে থাকি আমি, কখন পুজার খোঁজে ত্রিনিদাদ যাব?

অবশেষে প্রোগ্রাম হয় ২০ অক্টোবর আমি বাহামা পৌঁছবো এবং টরোন্টো থেকে পাগলাবাবাও। গ্রোগ্রাম ঠিক রাখতে ১৯ তারিখ তাইপে থেকে চায়না এয়ারে (তাইওয়ান এয়ার) "হাওয়াই" ট্রানজিট হয়ে বাহামার নাসাউ (Lynden Pindling International Airport) পৌঁছি ২০ তারিখ দুপুরে। প্রায় ৪-ঘন্টা আগে পৌঁছে পাগলাবাবা আগেই হোটেল ঠিক করে আবার আমার জন্যে এয়ারপোর্ট অপেক্ষা করতে থাকে। সারাদিন বাহামা কাটিয়ে পরদিন সকাল ৭-টায় ডেলটা এয়ারে দুজনে উঠে বসি পোর্ট অব স্পেনের উদ্দেশ্যে। ক্যারিবিয়ান সাগরের উপর দিয়ে ডেল্টার এ৩০০ বিশালকার এয়ারবাসে উড়তে থাকলেও্, আড়াই ঘন্টার ১৫০০ কিমির এ এয়ারজার্নিতে এক চাপা অথচ বিস্ময়কর অযাচিত ঘটনাক্রমের অপেক্ষায় আমার মন টিপটিপ করতে থাকে সারা পথেই। যে কোন বিমান জার্নির চেয়ে এ ভ্রমণ আমার কাছে কেমন যেন কষ্টকর মনে হয়।

সাড়ে ১০টার ভেতরেই আমরা দু'বন্ধু Port of Spain এ পৌঁছে Trinidad এর Piarco International Airport থেকে বের হয়ে বাসে উঠলাম Avocat শহরের। সেখানে থেকে টেক্সিতে Siparia গাঁ (যা এখন বেশ উন্নত শহর) পৌঁছলাম বিকেল ৪-টার ভেতরই। একটা মাঝারি মানের হোটেলে পৌছে দিল টেক্সিওয়ালা। লাগেজপত্র রেখে, দুজনে বের হলাম পুজার খোঁজে। কিন্তু দুপুরের লাঞ্চ না করাতে ক্ষুধা আর ক্লান্তি আমাদের আঁকড়ে ধরলো। তাই পুজার বাড়ি যাওয়ার আগে একটা খাবার দোকানে ঢুকলাম আমরা লাঞ্চ সারতে।



পর্ব : ৩ (লেখক যখন ত্রিনিদাদে পুজার বাড়িতে)


প্রায় ২৫/২৬ বছর বিরতির পর আমরা যে সিপারিয়ায় পৌঁছলাম, তা দেখে পুজার বাড়ি চিনতে পারলো না পাগলাবাবা। কারণ পুজাদের বাড়ির পাশের ফসলের মাঠ আর ক্ষেত এখন আর নেই, সেখানে গড়ে উঠেছে নানাবিধ পাকা বাড়ি, সড়ক আর বাণিজ্যিক নানাবিধ ছোটখাটো কারখানা। অনেক খো্ঁজাখুজির পর এক ভারতীয় বংশজাত "ওয়াইন ব্যবসায়ি" (আসলে ওয়াাইন খেকো) পাওয়া গেল সিপারিয়া শহরে, যে চেনে পুজা ও তার বাবা প্রভাকর রত্নাকরকে। বিস্তারিত বলার পর সে ওয়াইন পানরত অবস্থায় যা বললেন তার অর্থ হচ্ছে, অর্থকষ্টে প্রায় ২০-বছর আগে পুজার বাবা তার এ বাড়িটি বিক্রি করে দেয় এক সাইকেল উৎপাদনকারীকে। পাশে অন্য একটি বাড়িতে ভাড়া থাকতো তারপর। এভাবে কাটিয়ে বছর পনের আগে সে মারা গেলে পুজাসহ তার পুরো পরিবার চলে যায় দক্ষিণের "মরুগা" শহরে। সেখানে বসবাস অনেক ভারতীয়র। পুজার ছোটভাইর একটা ফোন নম্বর দেয় আমাদের নেশার ঘোরে। অচেনা দেশের অচেনা ছোট শহর সিপারিয়ায় রাত ১১টায় একটা ফোন নম্বর নিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম দুজনে বিষণ্ন মনে। এসেই রুম থেকে ফোন লাগালাম ঐ নাম্বারে, রিং হলেও কেউ ফোন ধরলো না সারারাত।

২২ অক্টোবর সকালে রিং করলেও ফোন ধরলো না কেউ। ৯টায় ঘুম থেকে উঠালাম ওয়াইন ব্যবসায়ি সুখিনকে। রাতের অনেক কথা মনে না থাকাতে পুনরায় সব কাহিনি বলতে হলো তাকে। আমাদের দেয়া ফোন নম্বর চেক করে নতুন নম্বর বের করলো সে, ফোন লাগাল এবার নিজেই। এবার সত্যিই পেয়ে গেল পুজার ভাই Daniel রত্নাকরকে। জানা গেল সে এখন কাজ করে "বোনাসি" সৈকত শহরে। ঠিকানা নিয়ে বোনাসির বাসে তুলে দিল নিজেই। প্রায় ৩-ঘণ্টা পর বোনাসিতে দেখা মিললো পুজার ভাই ড্যানিয়েলের।

চেহারা আর গায়ের তামাটে রং দেখে পাগলাবাবা সনাক্ত করলো পুজার ভাইকে। পরে জানা গেলো একেই পুজার কোলে দেখে গিয়েছিল পাগলাবাবা। প্রথমেই আমাদের আসার কারণ জানতে চাইলো পুজার ভাই গভীর আগ্রহে। রাস্তায় দাঁড়িয়েই সব কথা বললাম দুজনে হিন্দি আর মিশ্র ইংরেজিতে। জানতে চাইলাম পুজার খবর। ইতস্তত করে বললো তার খোঁজ পাওয়া যাবে না। অনেক অনুরোধ করলাম তাকে, বাংলাদেশ থেকে কয়েক হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে পুজার খোঁজে গিয়েছি, এমন সব আকুতিতে তার মন গললো অবশেষে কিছুটা। হঠাৎ বললো তাকে দেখতে হলে ইন্ডিয়া যেতে হবে।

দু'জনেই বিস্ময়ের সাথে জানতে চাইলাম - ইন্ডিয়া কেন? ড্যানিয়েল প্রায় ঘন্টা ধরে যে কাহিনি বললো, তার মর্মার্থ হচ্ছে, পুজা এখানে একটা দোকানে কাজ করতো। বিয়ে করেনি কখনো। নানাবিধ মানসিক যন্ত্রণায় ভুগতো সে। বাবা মারা যাওয়ার পর নানাবিধ সমস্যা সৃষ্টি হয় তাদের পরিবারে। অবশেষে পুজার এক বোন ও পুজা ভুপালে তাদের নিজ শহরে চলে যায় নিজেদের ইচ্ছেতেই। ভুৃপালের "রানগারা" এলাকার একটা বাড়িির অষ্পষ্ট ঠিকানা বলতে পারলেও, কোন ফোন নম্বর বা ইমেইল নম্বর দিতে পারলো না ড্যানিয়েল। তার সাথে তার দুবোনের আর দেখা হয়নি ২০০৫ সালের পর। ঐ সনেই তারা ভুপালে চলে যায়। তবে তাদের অন্য প্রতিবেশিরা তাদের ভুপালের "রানগারা" এলাকায় দেখে এসেেছে এমন কথা নিশ্চিত করে ড্যানিয়েল। আমরা কি "রানগারা" যাবো এমন কথা জানতে চাইলো সে আমাদের কাছে।

আকস্মিক আকাশ কালো করে "বোনাসি" শহরে প্রবল বাতাস আর বৃষ্টি নামে। পিচ্ছিল ঘনান্ধকার পথে একবুক হতাশা আর ক্লেদাক্ততা নিয়ে রিণরিণে পায়ে আমি আার পাগলাবাবা হোটেলের দিকে এগুতে থাকি। সৈকতে আছড়ে পড়া ঢেউ বেদনাময় ক্যারিবিয় সাগরের গভীর থেকে ছুটে আসে আমাদের দু'জনের বুকে। এক নিঃসীম বেগের অজানা হাওয়া দিগন্ত বিস্তৃত করে শো শো রবে ডাকতেই থাকে ক্রমাগত। ঝড়ো বাতাস আর প্রবল বৃষ্টি দেখে ড্যানিয়েল আমাদের ডাকতে থাকে, যেন এর মাঝে আমরা না যাই।


কিন্ত আমি আর পাগলাবাবা থামিনা। ঝড়ো বাতাসের এ প্রবল শব্দ পুজার করুণ আর্তি আর আহাজারি হয়ে আমাদের পথ দেখাতে থাকে সামনে। আমার মনে হয় ভুপালের ভাঙ্গা ন্যুব্জ যে ঘরে শুয়ে আছে পুজা, সেখানেই আমরা হেঁটে যেতে পারবো। ক্যরিবির প্রবল ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, আর সমুদ্র বাঁধা কেউই আমাদের থামাতে পারবে না, পুজার অজানা ইতিহাস আমাদের পথ দেখিয়ে নেবে ভুৃপালের "রানগারা" পর্যন্ত। 




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন