রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

শরৎচন্দ্রের মহেশ (গফুর আর আমিনার গল্প) গল্পের শেষ পর্ব : গল্প # ৫২


আমার লেখা মহেশ (গফুর আর আমিনার গল্প) গল্পের শেষ পর্ব
:
শরৎচন্দ্রের মহেশ (গফুর আর আমিনার গল্প অবলম্বনে রচিত)
:
মূল গল্পের শেষাংশ : 

অনেক রাত্রে গফুর মেয়েকে তুলিয়া কহিল, আমিনা, চল্‌ আমরা যাই—
সে দাওয়ায় ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল, চোখ মুছিয়া উঠিয়া বসিয়া কহিল, কোথায় বাবা?
গফুর কহিল, ফুলবেড়ের চটকলে কাজ করতে।

মেয়ে আশ্চর্য হইয়া চাহিয়া রহিল। ইতিপূর্বে অনেক দুঃখেও পিতা তাহার কলে কাজ করিতে রাজী হয় নাই,—সেখানে ধর্ম থাকে না, মেয়েদের ইজ্জত-আব্রু থাকে না, এ কথা সে বহুবার শুনিয়াছে।

গফুর কহিল, দেরি করিস নে মা, চল্‌, অনেক পথ হাঁটতে হবে।

আমিনা জল খাইবার ঘটি ও পিতার ভাত খাইবার পিতলের থালাটি সঙ্গে লইতেছিল, গফুর নিষেধ করিল, ও-সব থাক্‌ মা, ওতে আমার মহেশের প্রাচিত্তির হবে।

অন্ধকার গভীর নিশীথে সে মেয়ের হাত ধরিয়া বাহির হইল। এ গ্রামে আত্মীয় কেহ তাহার ছিল না, কাহাকেও বলিবার কিছু নাই। আঙ্গিনা পার হইয়া পথের ধারে সেই বাবলাতলায় আসিয়া সে থমকিয়া দাঁড়াইয়া সহসা হুহু করিয়া কাঁদিয়া উঠিল। নক্ষত্রখচিত কালো আকাশে মুখ তুলিয়া বলিল, আল্লা ! আমাকে যত খুশি সাজা দিয়ো, কিন্তু মহেশ আমার তেষ্টা নিয়ে মরেচে। তার চ’রে খাবার এতটুকু জমি কেউ রাখেনি। যে তোমার দেওয়া মাঠের ঘাস, তোমার দেওয়া তেষ্টার জল তাকে খেতে দেয়নি, তার কসুর তুমি যেন কখনো মাপ ক’রো না।

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------

কোলকাতার ইস্টার্ন বাইপাসের রাস্তায় অনেক মানুষের জটলা দেখে থমকে দাঁড়ালাম। এক বুড়ো মরে পরে আছে পিয়ারলেস হাসপাতালের সামনের ফুটপাথে, আর তার ২০/২২ বছরের মেয়ের কান্নায় ক্লেদাক্ত হচ্ছে পথচারির হৃদয়। মেয়েটি তার মৃত বাবার জন্য ভগবানের কাছে আকুতি না জানিয়ে, আল্লাহর নামে কান্নাকাটি করাতে অনেক উচুঁ ও মাঝারি জাতের হিন্দুরা “ইজ্জত” বাঁচিয়ে কেটে পড়লো ওখান থেকে। আমি একজন বিদেশি ছাড়াও কোলকাতার অভাগি ২ নারীও দেখছিলাম মেয়েটির কান্না। বিলাপের ভাষা পূর্ববঙ্গীয় তথা ‘বঙাল’ ভাষা হওয়াতে ২/১-জন পথচারী মেয়েটিকে জেরা শুরু কর‍লো যে, সে বাংলাদেশি অবৈধ মুসলিম কিনা? অতি উৎসাহি কেউ কেউ পুলিশে খবর দিতে বললো।
:
এক পর্যায়ে জানলাম মেয়েটির নাম আমিনা। বুকের মাঝে কেমন যেন ছ্যাৎ করে উঠলো আমার। বললাম, তোমার মৃত বাবার নাম কি? বললো, গফুর মিয়া? আরে বলো কি? তুমিই কি সেই আমিনা আর গফুর। যাকে নিয়ে শরৎচন্দ্র তার মহেষ গল্পটি লিখেছিল?
:
শোকার্ততার মাঝেও হ্যা সূচক মাথা নাড়লো আমিনা। জানতে চাইলাম, তুমি এখানে কেন এলে? তোমরা তো বাংলাদেশের কাশিপুর গ্রামে ছিলে। ফুলবেড়ের চটকলে কাজ করতে যাওয়ার কথা ছিল তোমার বাবার। তো কোলকাতা এলে কিভাবে?
:
বুকভাঙা শোক বুকে চেপে ক্লেদাক্ত মেয়িটি যা বললো তার মর্মার্থ হচ্ছে, তারা বাংলাদেশেই ছিল। কাশিপুর গাঁ থেকে রাতের অন্ধকারে ফুলবেড়ের চটকলে কাজ করতে গিয়েছিল তারা। কিন্তু গফুর বয়স্ক আর অসুস্থ্য থাকাতে ৩-দিনের বেশি কাজ করতে পারেনি সেখানে। 
:
তারপর অনেক কষ্ট আর সংগ্রামের সাগর পাড়ি দিয়ে এক সময় ঢাকা পৌঁছে তারা। গফুর ছোটখাটো কাজ করে সংসার চালানোর চেষ্টা করে। বিএনপি বস্তিতে অনেকদিন থাকার পর, আমিনার বাড়ন্ত শরীরের দিকে চোখ পড়ে বস্তির লোকজনের। একসময় দালালেরা সীমান্তের ওপারে মানে কোলকাতায় সুন্দর জীবনের কথা বলে আমিনা আর গফুরকে পার করায় দুর্গম কাটাতারের বর্ডার। গফুরকে অন্যঘরে আটকে রেখে ১৫/১৬ বছরের আমিনাকে দালাল চক্র ধর্ষণ করে ক্রমাগত এপার আর ওপার বাংলায়। এক সময় ওদের থেকে ছাড়া পেয়ে নানা মানুষ আর স্থান ঘেটে কণ্টকের পথ ঘুরে কোলকাতা পৌঁছুতে তাদের কেটে যায় দু’বছর। বাংলাদেশে যেমন যায়গা মেলেনি হতদরিদ্র হওয়ার কারণে, এখানে সুবিধা হচ্ছেনা মুসলিম হওয়াতে। নাম শুনেই অনেকেই আমিনাকে ঘরে কাজ দিতে বা গফুরকে ক্ষেতে কাজ দিতে অনিহা দেখায়।
:
১ বছর থেকে কোলকাতা রুবি হাসপাতালের কাছে একটা ঝুপড়িতে থাকতো গফুর আমিনা। ২/৩ দিন থেকে গফুর মারাত্মক অসুস্থ্য হলে ভোররাতে পিয়ারলেসে ভর্তির আগেই পথে মারা যায় বাংলাদেশের কাশিপুর গাঁয়ের গফুর জোলা ।
:
স্কুল পাঠ্যে গফুর আমিনা আর মহেষের গল্প পড়ে এক সময় তাদের জন্য খুব মায়া হতো আমার। মনে পড়তো, আহারে ওদের পেলে আমাদের সচ্ছল পরিবারে আজীবন রেখে দিতাম সুখে। আমিনাকে পড়াতাম বাড়ির কাছের কোন স্কুলে। কিশোরি সেই কল্পনার আমিনা এখন পোড় খাওয়া বিধ্বস্ত শরীরের ২২ বছরের দুখী তরুণির প্রতিচ্ছবি, সম্ভবত শিক্ষা বিপণনের এ যুগেও আমিনার ভাগ্যে জোটেনি কোন স্কুল।
:
চিরদুখি এ মেয়েটির এ দুসময়ে কিভাবে তাকে সাহায্য করবো ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কারণ কোলকাতাতে অনেকবার গেলেও, মৃতের শেষ কৃত্যানুষ্ঠান সম্পর্কে ধারণা ছিলনা আমার। পিয়ারলেসের সামনের পরিচিত মন্ডল হাউসের লোকজনের সাহায্যে গফুরকে মুসলিম গোরস্থানে দাফনের ব্যব্স্থা করতে পারি এক অপরিচিত শহরে। গফুর আমিনার কথা শুনে অনেকেই সহযোগিতার কথা বলে। কেউ কেউ আমিনাকে সাথে নিতে চায় পুনর্বাসনের জন্যে। কিন্তু নানা তিক্ত অভিজ্ঞতায় আমিনা মানুষের প্রতি বিশ্বাস এমনভাবে হারিয়েছে যে, কোনভাবেই তাকে আর কারো কাছে দিতে পারলাম না। অবশেষে সিদ্ধান্ত নেই বাংলাদেশে নিয়ে আসবো তাকে।
:
কোলকাতার উপ-দূতাবাসে একদিন হাজির হলাম আমিনাকে নিয়ে। নানাভাবে বোঝানোর পরও আমিনার বাংলাদেশি কোন কাগজপত্র না থাকাতে, কোনভাবেই তার পাসপোর্ট দিতে রাজি হলোনা বাংলাদেশ দূতাবাস। নিজের প্রভাব খাটিয়েও কোন পোসপোর্ট পেলাম না আমিনার। অবশেষে অনেকটা জেদ চাপলো, যে কোনভাবেই হোক আমিনাকে নিয়ে আসবোই বাংলাদেশে। খুঁজে বের করবো তার কাশিপুর গ্রাম।
:
একদিন বাঘা-যতিন স্টেশন থেকে ট্রেনে চাপলাম শিয়ালদা হয়ে বনগাঁ বর্ডারে আসবো, যাতে বেনাপোল দিয়ে ঢুকতে পারি বাংলাদেশে। আমি পাসপোর্ট ভিসাধারি বৈধ বাংলাদেশি নাগরিক। আমিনা বৈধ হয়েও এখন অবৈধ হিসেবে আমার সহযাত্রি।
:
শিয়ালদা থেকে ধাবমান সর্পিল ট্রেনটি যান্ত্রিক হাহাকার তুলে বনগাঁর দিকে এগুতে থাকে দুপুরের পড়ন্ত লালচে রোদ ভেঙেচুড়ে। ভয়ার্ত আমিনার দিকে তাকিয়ে সমাজ আর সংসার কর্তৃক তার হন্তারক পিতার দৃশ্যটি ভেসে উঠে আমার চোখে। এ বিষাদের নৃত্যনাট্য একটা বুকফাটা যন্ত্রণা হয়ে অস্থির করে চলমান ক্ষয়িষ্ণু সময়কে। মনের অন্ত:পুরে জমে থাকা বেদনার জল লিন হয়ে আমার চোখকে আর্দ্র করে গফুর, আমিনা আর মহেষের জন্যে। ইচ্ছে করে ধর্মান্ধ ফতোয়াবাজ তর্করত্ন আর জমিদার শিবচরণ বাবুদের খুঁজে এনে এ বনগাঁ লোকালের নিচে ঠেলে দেই। পিষে মারি ওদের, যাতে ওরা আর উৎখাত করতে না পারে আমিনা আর গফুরদের বাস্তুভিটে থেকে কোনদিন! 
:
হঠাৎ মৃত্যুর মত হিসহিস করতে করতে শব্দহীন ট্রেনটা বনগাঁ জংশনে দাঁড়ায়। খুব কাছেই বাংলাদেশ সীমান্ত পেট্রাপোল-বেনাপোল বর্ডার। আমিনাকে নিয়ে আমি বর্ডারের দিকে এগুতে থাকি স্তব্ধতা স্মৃতি আর আকাঙ্ক্ষার সব গল্পকে পেছনে ফেলে। শীতের ক্ষয়ে যাওয়া দুপুরের ধূসরতা আর বিষন্ন নিরুত্তাপ রোদে নিস্ব ক্ষেতের মাঠ ছেড়ে উর্দি পড়া বিএসএফ-বিজিবির দিকে এগুতে থাকি অবৈধ আমিনার হাত ধরে আমি। কাঁপতে থাকে আমার বুক। পারবো কি এ বৈশ্বিক জটিলতার জাল ছিন্ন করে তার পৈত্রিকভিটা গফুর জোলার কাশিপুর গাঁয়ে নিয়ে যেতে তাকে? যে গাঁয়ে ঘুরে বেড়াছে গফুরের অতৃপ্ত আত্মা অবোধ মহেশের স্মৃতি নিঙড়ে! 
:
শরৎচন্দ্রের মহেষ (গফুর আর আমিনার গল্পের শেষ পর্ব)



লেখাটি ফেসবুকে দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যান প্লিজ


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন