রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

৯-জন হিন্দু যুবতি মেয়ে ও আমার মায়ের গল্প : পর্ব # ৩ [ চলার পথের সত্যি ঘটনার গল্পসিরিজ : ২২ ]






সকালে আমার ঘুমন্ত জানালায় উকি মারে গোচরণের স্নিগ্ধ সূর্যোদয়। খুব কাছের ট্রেন ট্রাকের অনাবিল শব্দে এক সময় ঘুম তাড়িয়ে উঠে বসি বিছানায়। সুরেন্দ্রের সাথে বাড়ির পাশের পুকুরে স্নান সেরে একাত্তরের তরুণি আর আজকের পৌঢ়া মাসিমার কাছে এসে বসি। ঘরের ৩-নারী সম্ভবত তাদের জানা সব রকমের খাবার তৈরি করেছে এরই মাঝে। দেখে বিমোহিত হয়ে বলি, মাসিমা কোলকাতার মানুষের কৃপণতার কিসসা মনে হয় আপনি ভেঙে দিলেন। আবার মাসিমা বলে, তোমার পরিবারের ঋণ কি এ আয়োজনে শেষ হয় রে বাবা? 
:
আগ্রহে বলি, মাসিমা আপনাদের হোগলা পাতার বনে ১-মাসের জীবনের কথাটা বলুনতো! খুবই ইন্টারেস্টিং লাগছে অন্তত আমার কাছে। সুরেন্দ্র, স্বর্ণা আর মৃত্তিকাও জানতে চায় তার মার চরের হোগলা বনের নির্বাসিত জীবন কথন। 
:
আবার মাসিমা ফিরে যায় তার ফেলে আসা ধূসর ক্লেদাক্ত জীবনের হৃদঘন কথামালায়। হঠাৎ তার হাসিমুখ ঋজু হয়ে যেন শব্দরক্ত ঝরে পড়ে তার হৃদমননে। ধরা গলায় শুরু করে- তিনটা মাচান টংঘর ছিল ঐ লক্ষ্মির চরে। সেখানে কেবল বুনো ঘাস আর লম্বা হোগলাপাতার বন ছিল। বাঁশের খুটি আর নাড়ার চালের টংঘরে সুপুরির চালির মাচান ছিল অনেকটা দোতলা ঘরের মতো। আমরা রাতে ঐ তিনটা ঘরের দুটোতে ঘুমোতাম, বাকিটাতে থাকতো ৩-রাখাল, যার দুজনই ছিল তোমাদের মাইনে করা, বাকিজন মাসিমার বাবার বাড়ির। তবে ৩-জনই মানতো মাসিমাকে খুব। গ্রামে মাসিমার খুব সুনাম আর সুখ্যাতি ছিল। তারা চরে গরু-মহিষ রাখতো। ওগুলো সারা চরময় ঘুরে বেড়োতো ইচ্ছেমত আর সবুজ ঘাস খেতো সারাদিন। মহিষেরা রাতেও ঘাসের চরে ঘুরতো। কোন কোন মহিষ হিংস্র ছিল, অপরিচিত মেয়েদের দেখে তারা তেড়ে আসতো কখনো কখনো। দক্ষ রাখালেরা হিংস্র মহিষের খুব কাছে নিয়ে তাদের গা স্পর্শ করিয়ে আমাদের পরিচিত করাতো বুনো মহিষের সাথে, যাতে তারা আক্রমন না করে আমাদের। চরের হিংস্র প্রতিবেশিদের সাথে সখ্যতা গড়তে কখনো ভয়ে ভয়ে ওদের গা চুলকাতাম, লেজ নেড়ে দিতাম, কচি সবুজ ঘাস এনে তাদের মুখের কাছে ধরতাম আমরা রাখালদের পরামর্শে। স্বজন ভেবে ওরা আমাদের চেটে দিতো কখনোবা। হঠাৎ মহিষের ছোট্ট বাচ্চাকে আদর করলে মহিষ মা তেড়ে আসতো সন্তানের টানে। ভয় পেলেও আমরা দৌঁড় দিতাম না তাদের কৃত্রিম বন্ধুত্ব পেতে। 
:
খুব ভোরে ছোট ছোট নৌকো নিয়ে গোয়ালারা আসতো দুধ নিতে। দুধেল গরু আর মহিষগুলো মাসিমার নির্দেশে একটা খোলা স্থানে জড়ো করে রাখতো রাখালেরা। দুধ দোয়াতে আর বাঁশের চোঙায় মেপে বড় পাত্রে করে নৌকায় ভরতে প্রায় ঘন্টা দু'য়েক লেগে যেতো। শেষ নৌকোটি না ছাড়া পর্যন্ত আমরা বের হতাম না। আমরা সবাই হোগলা পাতার বেড়ার ফাঁক দিতে উৎকণ্ঠা নিয়ে দেখতাম সব। আমরা তখন সবাই টংঘরে অবস্থান করতাম যাতে কেউ না জানে আমাদের কথা। 
:
জোয়ারে জল উঠতো চরে, আর ভাটায় নেমে যেতো। দুদিন পর মাসিমার নির্দেশে রাখালেরা মাসিমার বাবার বাড়ি থেকে দুটো জাল নিয়ে আসে। কারণ তোমাদের বাড়ি তখন পুড়ে গিয়েছিল তাই কিছুই ছিলনা তোমাদের আর। পাশের নবগ্রামে ছিল মাসিমার বাবার বাড়ি। চরে জোয়ার এলে জাল আর আমাদের শাড়ি কাঠি দিয়ে টানিয়ে রাখতাম। জল নেমে গেলে তাতে অনেক মাছ আটকে থাকতো। বেলে মাছ, বাটা মাছ, চিংড়ি মাছ কত কি! ৪/৫ দিনেই আমরা দক্ষ জেলেনি হয়ে উঠেছিলাম। তখন এতো মাছ পেতাম যে, খেয়ে শেষ করতে পারতাম না। রাখালেরা কিছু মাছ গ্রামে নিয়ে যেত। কিন্ত তখন মাছের প্রাচুর্য ছিল বলে মাছ তেমন কিনতো না কেউ। কিনলেও দাম ছিল খুবই কম। যেমন বড় ইলিশ পাওয়া যেত এক টাকায় দুটো। তোমাদের দুধ গোয়ালারা নিতো গরুর দুধ ২৫ পয়সা, আর মহিষের দুধ ৫০ পয়সা প্রতি সের। ঐ মাছ আর দুধ ছিল আমাদের সব সময়ের খাবার। মহিষের দুধ দিয়ে দধি বানাতাম আমরা। গ্রাম থেকে মাসিমা খেজুরের গুর নিয়ে আসতো, ঐ গুর দিয়ে দধি খেতাম সবাইা। আমাদের গাঁয়ের সবচেয়ে পড়ুয়া মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যাালয়ের "চন্দনা" দই বানাতো খুব সুন্দর করে মহিষের দুধ দিয়ে। ঢাবির এ ছাত্রী অল্পদিনেই "ঘোষ" উপাধি লাভ করেছিল আমাদের থেকে। মাছ ধরতে পারতাম আমি বেশি। চরে জমে থাকা জলে নেমে আমি সাতরানো দক্ষ বাটার ঝাক থেকে সহজেই ডুব দিয়ে বাটামাছ ধরতাম। তাই ওরা "জাইল্লার বউ" বলতো আমায় মজা করে। 
:
চমকে ওঠা বৃক্ষের মত মাসিমার কথায় আমরা আলোড়িত হই। গাংচিলের ডানায় ক্ষুধাতুর সুখের মত আমরা উন্মুখ হয়ে শুনতে চাই মাসিমা, ৮ হিন্দু তরুণি আর আমার মায়ের একাত্তরের চর জীবনের বিষাক্ত ক্ষতমুখ আর পুঁজরসের করুণ কথা!



লেখাটি ফেসবুকে দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যান প্লিজ


https://www.facebook.com/logicalbengali/posts/1696259960608153

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন