শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

হানাহানির এ বাংলাদেশ : অভাবী দুই ভাইবোনের ভালবাসার ক্লেদাক্ত গল্প : ৫৮

হানাহানির এ বাংলাদেশ : অভাবী দুই ভাইবোনের ভালবাসার ক্লেদাক্ত গল্প
‘বঙ’ থেকে ‘বাংলা’ নামের এ দেশটিতে এক সময় ভালবাসা, সহানুভূতি, অন্যের সুখ-দুঃখে অংশগ্রহণ, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের কমতি ছিলনা। এ জন্যেই হয়তো ‘সতীদাহে’র মত মারাত্মক জীবনঘাতী চরম ‘আত্মত্যাগে’র ভালবাসার কাহিনী এ সেদিনও বাঙালি সমাজে প্রচলিত ছিল। রবীন্দ্রনাথের ‘একগাঁয়ে’ কবিতায়ও ভালবাসার চমৎকার উদাহরণ আমরা দেখেছি কিন্তু আজ এ ‘ডিজিট্যাল ভোগবাদী বাঙালি সমাজে’ নানা সমস্যা আর বিবিধ প্রপঞ্চে অক্টোপাসের মত জড়িয়ে পড়া এ জাতি এখন অতিক্রম করছে চরম ক্রান্তিকাল। ছেলেবেলায় গ্রামের যে ‘দত্তবাড়ি’ গেলে জলপান মানে ‘মোয়া-সন্দেশ’ না খেয়ে ফিরতে পারতাম না। একাত্তরে আমার মা বাচিয়েছিলেন দত্তদের পুরো পরিবারকে। তাদের বড় মেয়েরা রাতে ঘুমাতো আমাদের মাচায়। সে দত্তদের ‘নাতি-পুতিরা’ কোলকাতায় এখন এতোই ‘বাণিজ্যিক’ যে, ধর্মতলা বা সল্টলেকের কোন বিশেষ স্থানে ‘জলপানহীন’ দেখা করে বাপ-দাদার আত্মীয়দের সাথে ‘সামাজিকতা’ সম্পন্ন করে তারা।

আজকের বাঙালির লোভ আর সপ্তপদী কর্মকান্ডে তাদের পূর্ববর্তী আতিথেয়তা, পরোপকার ইত্যাদি আস্তে আস্তে আমাদের থেকে বিদায় নিচ্ছে ক্রমশ। আগে যেখানে গ্রামের একজন সাধারণ মানুষ পারাপারের অপেক্ষাধীন কাউকে কেবল মানবিক মূল্যবোধের কারণে নিজ নৌকা ঘুরিয়ে পার করে দিতেন নদী, আজ সেখানে খালি গাড়ী নিয়ে গেলেও কাউকে ফ্রি ‘লিফট্’ দিতে চাননা সহসা কেউ। পত্রিকার পাতা কিংবা টিভি চ্যানেল খুললেই দেখা যায়, সম্পদ-অর্থ কিংবা নানাবিধ স্বার্থে স্ত্রী খুন করছে স্বামীকে, ভাই হত্যা করছে বোন কিংবা ছেলে হত্যা করছে পিতাকে [এবং ঐশি হত্যা করছে মা+বাবাকে একত্রে]।

আমাদের আদালতগুলোর অধিকাংশ মামলা-মোকদ্দমাও বর্তমানে জায়গা-জমি সংক্রান্ত অর্থ আত্মীয় কেন্দ্রিক। অর্থাৎ এটি বোধহয় এখন আর কাউকে বলে দিতে হবে না যে, আমাদের এ ভোগবাদী সমাজে এখন মা-বাবা, ভাই-বোন, দাদা-দাদী, নানা-নানী ইত্যাদির বন্ধন ক্রমশই ঋজু থেকে ঋজুতর হচ্ছে। এমনই এক ক্ষয়িষ্ণু সময়ে এদেশেরই দুই ভাই-বোন দেখিয়েছে আমাদেরকে তাদের ‘ঈর্ষণীয় ভালবাসা আর আত্মত্যাগে’র উদাহরণ। চলুন সত্য এ কাহিনীটি শুনি।

ভাইটির সঙ্গে এ লেখকের পরিচয় বাড়িওয়ালা-ভাড়াটিয়াসূত্রে। প্রায় ২৫-বছর আগে লেখকের ২০০-টাকা ভাড়ার একটি ছোট্ট ঘরে ভাইটি ওঠে তার স্ত্রী-সস্তান আর একমাত্র বিধবা বোন আর ভাগ্নিকে নিয়ে। সংসার খরচ চালানোর জন্য ভাইটি ঢাকা চলে যায় একটি প্রাইভেট ল্যাবে কাজ করার জন্যে। মাসে মাসে ভাড়া আর সংসার খরচের টাকা পাঠাতো বাড়িওয়ালা মানে লেখকের নামে। চেষ্টা করে বোনকে বিয়ে দিতে। কিন্তু বোন আর বিয়ে না করে টুক-টাক কাজ করে ভাইর সংসারের জন্যে। স্কুলে পাঠানোর চেষ্টা করা হয় বোনের মেয়েটিকে। কিন্তু বোঝা যায় মেয়েটি অনেকটাই প্রতিবন্ধী। ভাই আর বোন সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করে প্রতিবন্ধী মেয়েটিকে মানুষ করার জন্যে। কিন্তু মেয়েটির শরীরে দেখা দেয় ‘লিভার ক্যান্সোরে’র মত কঠিন রোগ। বোন আর ভাই মিলে তাকে রক্ষার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করে অনেকদিন। কিন্তু প্রায় ২৮-বছর কষ্ট পেয়ে বছর তিনেক আগে মেয়েটি মানে ভাগ্নি মারা যায় অত্যন্ত মর্মান্তিকভাবে। এর মধ্যে ভাই ঢাকার প্রাইভেট কোম্পানীর চাকুরী খুইয়ে, নিজ শহরে ফিরে এসে স্বল্প বেতনে স্থানীয় মাছ আরতে ‘হিসাব রাখার চাকুরী’ শুরু করে। নিজেও আক্রান্ত হয় পায়ের কঠিন ব্যথায়। স্বল্প ভাড়ার খোঁজে ৬/৭-মাস পর পর বাসা বদল করতে থাকে, এভাবে চলে জীবনের ঘানি অনেক দিন।

এ লেখক তথা ‘পুরাতন বাড়িওয়ালা’ ভুলে যায় তার ২৫-বছর আগের এক গরিব ২০০ টাকার ভাড়াটের কথা, যার সঙ্গে স্ত্রী সস্তান ছাড়াও ছিল এক বিধবা বোন। কিন্তু কিছুদিন আগে নিজ শহরে হঠাৎ বহুমানুষের জটলা আর ৭৪-বছরের বর্ণিত ভাইটির ‘বুকফাটা আহাজারী’ দেখে লেখক থমকে দাঁড়ায়। সিনেমার গল্পের মত প্রায় ৪৮ বছর ভাইর সংসারে সপ্তপদী সংগ্রাম আর কষ্টে কাটিয়ে, ৬৮-বছর বয়সী মারা যাওয়া বোনটির জন্যেই ভাইটির এ বুকফাটা আহাজারী।

যারা জানতো এ ভাই-বোনের দুঃখ, সংগ্রাম আর ভালবাসার গল্প, তারাও কেঁদেছে ভাইটির সঙ্গে, কেঁদেছে প্রতিবেশী ও পথচারীরা, কি এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় কেঁদেছে এ লেখকও অঝোড়ে শিশুর মত। এ জন্যে কেঁদেছে যে, অভাব, দৈন্যতা আর কষ্টে ভরা একটি সংসারে দীর্ঘদিন একটি ভাই পরম যত্নে আগলে রেখেছে তার বিধবা বোন আর প্রতিবন্ধী বোনের মেয়েকে, ভাগাভাগি করেছে কষ্ট আর আনন্দ বেদনাকে! আর দিয়েছে তার হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা। যা এ সমাজে একদিন হয়তো সবার মাঝে সহজাত ছিল কিন্তু এখন এর শুধু অভাবই নয় দুষ্প্রাপ্যও বটে।

এ দেশের অনেক স্বচ্ছল পরিবারের মা-বাবারাই এখন ‘নচিকেতা’র গানের মত ‘বৃদ্ধাশ্রম’ খুঁজছে। আমরা কি বর্ণিত এ ভাইবোনের সত্য গল্প শুনে আমাদের হারিয়ে যাওয়া ভালবাসা ফিরিয়ে আনতে পারিনা? অসহায় মা-বাবা-বোনদেরকে আগলে রাখতে পারিনা সুখ আর কষ্টের ভাগী করে? এ জন্যেই এ দেশের সকল ব্লগার তথা পাঠকের জন্যে স্বল্প শিক্ষিত অভাবী কিন্তু হৃদয়ে বিত্তবান দুই ভাই-বোনের এ সত্য কথন ছেড়ে দিলাম আলোর পাখি হিসেবে। যেন পাখিটা উড়ে বসে কারো না কারো হৃদয় কাননে! ক্লেদান্ত ভোগবাদি ২০১৪'র বাংলাদেশের হৃদ আকাশে সে পাখি কি উড়বে! ডানা ঝাপড়ে পরে যাবে কি? না নীল দিগন্তে ছুঁয়ে বাসা বাধঁবে হৃদ আকাশে!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন