রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

কনকপ্রভা আর আমার জীবনদহন [ভুটান পর্ব] : ২ [কাব্যিক গল্পমালা সিরিজ-৬] গল্প # ৩৮




নেশাচ্ছন্ন অপরাহ্নকে এক সময় নুয়ে পরা আকাশ চুমু খেতে খেতে বিদায় দিয়ে ফিরে আনে উজ্জ্বলতর আলোক সময়কে। আবার প্রাচীন যুগের পাথুরে কালের মত স্তব্দতর সময় সচকিত হয়ে পথ গুণতে থাকে।আমরা সর্পিল পাহাড়ী পথের জোয়ার ভাটায় এগুতে থাকি রাজধানী থিম্পুতে। 'প্রিয়া' হোটেলের নাম দেখে কনকপ্রভা স্বর্ণ হাসিতে খিলখিলিয়ে ওঠে। কোলাহলহীন ছিমছাম ৩-তারকা হোটেলের পরিবেশে কনকপ্রভা অনিত্যর মাঝে ভেসে বেড়ায় ক্ষণকাল। পুরোদিনের পথশ্রান্তির কারণে ক্রোধান্বিত সময়কে মেপে নিচের ক্যাফেতে খেতে যা্ই আমরা। মাছমাংসহীন কেবল 'সবজি-ডাল' আর সুন্দর ভুটানি চালের ভাতে আমাদের স্বর্গের খাবারের মনে কথা করিয়ে দেয়। রুমে ফিরে রুম সার্ভিসের কার্টেসি হিসেবে দেউল্ প্রাঙ্গনে গাঁথা ভুটানি "হট বিয়ারের বোতল-গ্লাস" দেখে বধ্যভূমে বিন্দু বিন্দু শ্যাওলার কণা আলোড়িত করে কনকপ্রভাকে। সে তিলোত্তমা উৎসাহে পঞ্চনদ শৃঙ্গের আনন্দে খুলে ফেলে "হট বিয়ারের" ছিপি। আমরা কপাণকুন্ডলা আর নবকুমার হয়ে মন্ত্রচ্যুত কাপালিককে বধ করতে থাকি সারারাত দ্রোহি জীবন খড়গে।
:
পরদিন একটা ট্যাক্সি ভাড়া করি সারাদিন ঘোরার জন্য ৬০০ টাকায়। ভুটানে ভারত আর ভুটানি টাকা সমমানের এবং চলে সর্বত্র। ট্যাক্সিওয়ালা মুক্তহস্ত ঈশ্বরের মত মনে হল পুরো ভৃটানকেই ঘুরিয়ে দেখাবে একদিনে আমাদের। প্রথমেই নিয়ে গেল ভুটানি জাতীয় প্রাণি 'টাকিন' দেখাতে। জলঢাকা নদীর তীরে ঘুরে বেড়ানো হাজারো 'টাকিন' ঘুরতে দেখে কনকপ্রভা পরমানন্দে বলে উঠলো, "মেঘ তাড়িয়ে জলশাসনে পৃথিবীটা আজ সাজাতে পারতাম ভুটানের মত"! 
:
আমরা সারাদিন পাহাড়ে ঝর্ণায় ক্ষেত আর জঙ্গলে ঘুরে বেড়ালাম দ্বিধাহীন মুষ্টিবদ্ধ দৃঢ়চিত্তে। 'লংগান' নামের বেগুনি এক ফলের বাগানে গিয়ে কনকপ্রভা আর ফিরে যেতে চায়না বাঙলাদেশে। সে ওখানের কৃষিকন্যা হয়ে বাকি জীবন কাটাতে চায়। ড্রাইভার আমাদের নিয়ে যায় চন্দন বাগানে। ঐ বাগানের সব গাছের পাতা, ছাল ঘষা দিলেই তাতে চন্দনের অপূর্ব ঘ্রাণ। সারাদুপুরে আমরা ভুটানি নারীর রাস্তার পাশে বিক্রির নানাবিধ ফল খেয়ে বিকেলের আগেই বসলাম হাজারো ঝর্ণা থেকে দৌড়ে আসা বয়ে চলা খরস্রোতা নদীর তীরে। পঞ্চনদের বহমান জল রক্তে স্ফীতকায় হয়ে আমাদের শিরা উপশিরায় সায়াহ্ন আঁধারে গভীর প্রেমের অনুরণন তোলে। গড়িয়ে চলা নুড়ি পাথরে নেমে আমরা জলতলে ভেসে বাঙলাদেশের দিকে প্রবাহিত হতে চা্ই। কিন্তু প্রবাহমান নদী আমাদের তীরভূমে ফেলে রেখে অচেতন নিত্যকর্মে ঢালুর দিকে সম্ভবত বাঙলা্র দিকেই ধাবিত হয়। কখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে টের পা্ইনা আমরা। জন্মলগ্নতার মাঝে প্রাণতা উড়িয়ে আমরা ভুটানি সন্ধ্যাকাশের স্নিগ্ধতায় রিণরিণে বাতাসে হোটেলের দিকে হাটতে থাকি।
:
রাতের ফিরে চলা পথে আমরা সপ্তপদি মুখোশ বানানো নারী পুরুষের পল্রী পার হতে গিয়ে নানা প্রাণির অদ্বুৎ মুখোশ দেখে বিস্মিত হই। এক অদেখা অশরিরী প্রেতাত্মা মেল-ফিমেলের মুখোশ কিনে তার আড়ালে নিজেরা যখন হোটেলে ফিরি, তখন আমার মাঝে নারী প্রেতাত্মার মুখোশ ভর করে, আর কনকপ্রভার পুরুষ। সারারাত আমরা বিপরীত লিঙ্গ ধারণ করে একে অন্যের শরীর আর বোধকে উপভোগ করতে চাই।কিন্তু আমাদের এ রূপান্তরকামিতায় প্রেতমুখোশ আমাদের মাঝে অবচেতন শবদেহ হয়ে আকড়ে থাকে, আমরা দুর্বার আকর্ষণ্ওে এক প্রস্রবন গোলোক ধাঁধার আচরণে কাছাকাছি আসতে পারিনা। সারারাত বিপরীত লৈঙ্গিক প্রেত মুখোশ পরে আমরা কামনার নোনা রক্তদহনে পুড়তে থাকি জ্বলন্ত ধাবমান কোয়াশারের মত।



লেখাটি ফেসবুকে দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যান প্লিজ


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন