রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

প্যাসিফিকে ৩-দিন সমুদ্র-সহবাস ও ডলফিন বন্ধুত্বে স্বাপ্নিক দেশে গমন : পর্ব-৩ [ স্বাপ্নিক গল্পসিরিজ : ৩২ ]



সারাদিন ঘুরলাম স্বাধিনমনে সর্বত্র কেউ আমায় বাঁধা দিলোনা বা কিছু জানতে চাইলো না আমার কাছে। ওদের সব কিছুই দেখলাম একদম ছিমছাম গোছানো কোন ঝামেলাহীন। কেউ কারো সাতে-পাঁচে নেই, সবাই নিজ নিজ কাজ কর‌্ছে, সবাই নিয়মমত খাবার, চিকিৎসা, শিক্ষা আর কাজ পাচ্ছে। যেন মৌমাছির জীবনের মত লোভহীন সাজানো ঐ নিবাবরণ মানুষের দেশ। 
:
সন্ধ্যার আগেই প্লান করলাম রাতে কোথায় যায় কি করে এরা দেখবো আমি। হঠাৎ সূর্য ডোবার প্রাক মুহূর্তে বেশ কটি গর্তগেট দিয়ে লাইন ধরে ঢুকলো সব নারী পুরুষরা। বয়স হিসেবে তারা ব্যবহার করলো ভিন্নভিন্ন গর্ত-গেট। কমবয়েশি শিশুরা বিশাল হলঘরের মতো বেডরুমে গেল একসাথে। সেক্স হিসেবে মেয়ে শিশু, আর ছেলে শিশুদের আলাদা আলাদা শয়নঘর। বয়সভেদে যেমন কুড়ি বছরের পুরুষ-নারীরা জোড়ায় জোড়ায় একেকটা মাটির কুঠরিতে ঢুকলো, আবার ৩০, ৪০, ৫০ এভাবে সমবয়সি নারীপুরুষেরা জোড়ায় জোড়ায় পরস্পর হাত ধরে চলে গেল আরো নিচের শয়নঘরে। ঘন্টাখানেকের মধ্যে দেখলাম কেউই নেই কোন গর্তদরজায়। আলোহীন অন্ধকার শব্দহীন ঘরগুলোতে নিশব্দে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। কিন্তু কোন শব্দ পেলাম না। এ দ্বীপে কি কোন শিয়াল, কুকুর বা পাখিও নেই? 
:
পরদিন দুজন মানুষ মারা গেলো মাটির ঘরের হাসপাতাল সংলগ্ন বুড়োদের ঘরে। যার একজন পুরুষ অন্যজন বয়স্ক মহিলা। কেবল ঐ নারী পুরুষের সন্তানেরা আর তাদের পৌত্ররা বহন করলো তাদের লাশ। অন্যেরা যার যার কাজ করতে থাকলো নিত্যদিনের মত, যেন কিছুই হয়নি এখানে। পরম যত্নে সন্তান আর তার বংশধরেরা দুজনের মৃতদেহকে সমুদ্রে সমাহিত করলো। যেহেতু তারা কথা বলেনা, তাই কোন নাম নেই সম্ভবত ঐ স্থানটিরও। নীল জলের গভীর সমুদ্রে ভাসিয়ে ঐ জলে সবাই স্নান করে লোকালয়ে ফিরলো স্বজনরা ভগ্ন হৃদয়ে চোখ মুছতে মুছতে তামাটে শরীরে।
:
ধর্মমুক্ত, ভাষামুক্ত, রাষ্ট্রমুক্ত, শাসকমুক্ত, বিয়েমুক্ত, শোষণমুক্ত এমন সুশৃঙ্খল দেশটি দেখে অভিভুত হলাম আমি। যেখানে ধর্মীয় বিভাজন, ঝগড়া বিবাদ, শোষণ, প্রতারণা, ফতোয়া, রাজনীতি, নারীবাদ, পুরুষতন্ত্র, মিথ্যাচার, ভ্যাজাল, ঠকানো সব কিছুই অনুপস্থিত। বাংলাদেশ নামক আধুনিক বিশ্বের একটা জটিল প্রপঞ্চের দেশের বাসিন্দা আমি। তাই এমন দেশকে কল্পনা করি নিজের দেশের সাথে। আহ্‌! এমন দেশ যদি হতো বাঙলাদেশ নামক আমার দেশটিতে। যেখানে ধর্মের নামে, জাতি-উপজাতির নামে, বর্ণের নামে, ধনী-দরিদ্রের নামে, অভিজাত-অনভিজাতের নামে, পেশা-অপেশার নামে, নাস্তিক-আস্তিকতার নামে কত অত্যাচার জুলুম আর নির্যাতন হয় প্রতিনিয়ত। শোষণহীন, ক্ষুধাহীন, পুঁজিবাদহীন এমন সাম্যের শব্দহীন রাষ্ট্রটিকে নিয়ে যেতে মন চাইছে আমার প্রবলভাবে নিজ দেশে। কিন্তু আমি জানিনা এটা কোন দেশ আর কিভাবে যাবো আমি আমার দেশে এ দেশের এ সভ্যতাকে বহন করে? আমি কি কখনো যেতে পারবো এ শিষ্ঠাচারকে নিয়ে যেতে আমার দেশে?
:
নামহীন ঐ নিবাবরণ মানুষের দেশে বাংলাদেশের বাঁশবাগানে চাঁদ ওঠা গ্রামীণতার চিরচেনা সন্ধ্যা নামে। স্বপ্নময় ভোর বাতাসেরা মেঘ ঘুড়ি হয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের আকাশে ওড়ে। নিবাবরণ দ্বীপের স্বর্ণোজ্জ্বল জন্ম-মৃত্যুর আল্পনা আঁকা মানুষেরা ভালবাসার প্রেমজ মধুরতার মাঝে তাদের রাতদিন কাটায়। বাকহীন মানুষের মাঝে আলো আর আকাশ দেখি আমি মেঘের মানচিত্রে সমুদ্র তটে বসে থেকে। মেঘমুক্ত আকাশে উজ্জ্বল আতশবাজির মতো সন্ধ্যার নক্ষত্রমালারা খসে পরে দুরের সমুদ্রজলে। কালের পাতায় বিবর্তিত হতে থাকে পৃথিবীর ভূ-গোলক আর অথৈ জলমালারা। বাংলাদেশ নামক দেশটির মানুষের প্রাগৈতিহাসিক রূঢ়তার গল্পগুলো মনে করে চোখ থেকে ঝরে পরে আমার হৃদয়ের রক্ত! আমার দেশের বন্ধ শৈশবের শক্ত কাঠ দুয়ার খুলে আমি ঢুকতে পারিনা নিজ ঘরে। দক্ষিণ প্যাসিফিকের নিরাভরণ দ্বীপের নীল জলে ধর্মহীন ডলফিনের ঝাঁক দেখি আমি আনন্দ কেলিরত। ঝরাপাতা কুয়াশায় হিম বিষণ্ণতা নিয়ে আমি প্রহর গুণতে থাকি কবে ফিরবো বাংলাদেশে? অপলক দূর-দিগন্তে চেয়ে-চেয়ে শব্দহীন মৃত ঐ দ্বীপে আমি শুনতে পাই বাংলাদেশের করুণ এস্রাজের দু:খাতুর আওয়াজের সুর। সুতো ছেড়া নাটাই ঘুড়িতে প্যাসিফিক আকাশে বাউল আ. করিমের গানের সুর বেজে চলে বেদনার সবুজঘ্রাণে- 
:
“আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম,
গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান, 
মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম,
হিন্দু বাড়িতে যাত্রা গান হইত,
নিমন্ত্রণ দিত আমরা যাইতাম।।
জারি গান, বাউল গান আনন্দের তুফান,
গাইয়া সারি গান নৌকা দৌঁড়াইতাম,
বর্ষা যখন হইত, গাজির গান আইত,
রঙে ঢঙে গাইত, আনন্দ পাইতাম ।।
কে হবে মেম্বার, কে বা গ্রাম সরকার,
আমরা কি তার খবরও লইতাম?
হায়রে আমরা কি তার খবরও লইতাম!
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম ।।
বিবাদ ঘটিলে পঞ্চায়েতের বলে,
গরীব কাংগালে বিচার পাইতাম ।।
মানুষ ছিল সরল, ছিল ধর্ম বল ।।
এখন সবাই পাগল বড়লোক হইতাম ।।
করি ভাবনা, সেই দিন কি আর পাব নাহ,
ছিল বাসনা সুখি হইতাম ।।
দিন হতে দিন আসে যে কঠিন,
করিম দীনহীন কোন পথে যাইতাম,
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম….............................................”!




https://soundcloud.com/arshinogorer-porshi/mp3-1  


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন