শুক্রবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

ইতালির ফ্রান্সিসকা আর বাংলাদেশের স্বর্ণপ্রভার বিস্ময়কর গিফট্ [ চলার পথের গল্প # ১৫ ]




আমার কুড়ি বর্ষীয়া একমাত্র বোন স্বর্ণপ্রভা গ্রীম্মের ছুটিতে যখন দেশে এলো আমার কর্মস্থল ঢাকায়, তখন তার ভার্সিটি আর হোস্টেলের বিদেশি বন্ধুদের গল্প শুনতে শুনতে আমার কান ঝালাপালা প্রায়। রাশিয়ান সরকারের একটি স্কলারশিপ নিয়ে আমার বোন ‘মিডিয়া এন্ড কমিউনিকেশন’ বিষয়ে পড়তে গিয়েছিল মস্কো থেকে প্রায় ৭-ঘন্টার বিমান পথের দূরত্বের ছোট্ট শহর ‘টমস্কে’ প্রায় ৩-বছর আগে। টমস্ক রাশিয়ার সাইবেরিয় এলাকার উত্তরাঞ্চলের তুষারমত নিরিবিলি শান্ত শহরগুলোর অন্যতম। ভলগা আর লেনা নদীস্রোতের জল যেখানে বছরের ৮-৯ মাসের বেশী সময় থাকে বরফে ঢাকা। 

শহরবাসীরা ফ্রিজের পরিবর্তে তাদের খাবার পলিথিনে ভরে জানালার সাথে ঝুলিয়ে রাখে তাজা রাখার মানসে। টমস্ক নদীতে পালতোলা নৌকো আর ফিশিং বোটের পরিবর্তে বছরের অধিকাংশ সময় সৌখিন তরুণ-তরুণী ‘স্কি’ করে সময় কাটায়। কুকুর টাকা স্লেজ গাড়িতে করে কেউ কেউ নদীর অপর পাড়ের রুশ ভাষিক গাঁয়ে ঘুরতে যায় সাইবেরিয় গ্রামীণ জীবন দর্শনের আকাঙ্খায়। ফুল আর পাতাশূন্য জমে যাওয়া শীতার্ত ওক আর পাইন বৃক্ষময় এতো ছোট্ট স্বল্প মানুষের শহর যে, ১৬-কোটি মানুষে ঠাসা বাংলাদেশ কিংবা জনবহুল ঢাকা শহরের নাম অধিকাংশ শহরবাসী না শোনার কারণে, বাংলাদেশে ফিরে আসার বিমান টিকেট কাটতে আমার বোনটিকে যেতে হয় পার্শ্ববর্তী আরেক শীতল শহর ‘নভোসিভিরক্সে’। নভোসিভিরক্স হচ্ছে আবার টমস্ক থেকে দক্ষিণ পশ্চিমে সাড়ে তিন ঘন্টার ট্রেন যাত্রার দূরত্বে, যেখানে অন্তত কিছু ইংরেজি ভাষিক পরিজায়ি বিদেশি ও ট্রাভেল এজেন্টের দেখা মেলে, যারা অনন্তর চেষ্টায় ইন্টারনেটে সেনেগালের রাজধানি ‘ডাকার’ এর পরিবর্তে বাংলাদেশের ‘ঢাকা’ শহর খুঁজে পায় শেষাবধি। ঢাকার ৪০-৪৫ ডিগ্রী তাপমাত্রার জল-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা আইসক্রিম প্রিয় মা-হীন আমার বোন যখন বর্ণিত মাইনাস তাপমান মাঠঘাট সর্বত্র ‘আইসক্রিমময় শহর’ থেকে সপ্তপদি অভিজ্ঞতা নিয়ে স্বভূম ঢাকায় ফিরে আসে দীর্ঘদিন পর, তখন তার অকথিত অভিজ্ঞতা শুনবে না এ সাধ্য আছে কার?
:
সাইবেরীয় প্রেইরি, স্তেপ তৃণভূমি, ফসলের ক্ষেত, বরফে স্কি স্কেটিং, লোকাল পুলিশের প্রকাশ্যে ভদকা পান, পেজা তুলোর মত তুষারপাত, আর নানাদেশীয় বন্ধু-বান্ধবদের গল্প শুনতে শুনতে এক সময় কষ্টকরভাবে স্বর্ণপ্রভার ছুটি ফুরিয়ে যায়। আবার টমস্ক ফেরার প্রাক্কালে স্বর্ণপ্রভা তার রুমমেট ও সবচেয়ে প্রিয় ইতালিয় বান্ধবি ফ্রান্সিসকার জন্যে ‘গিফট’ কেনার বায়না ধরে। গুলশান-বনানীর অভিজাত গিফট শপেও মন মত উপহার খুঁজে পায়না সে। কারণ উপহারটি হতে হবে ‘‘একক, অনন্য তথা অসাধারণ’’, যাতে ফ্রান্সিসকা চমকিত হয় বাংলাদেশ থেকে নেয়া তার প্রিয় বন্ধুর উপহারে! নানা দোকান ঘুরে অবশেষে বসুন্ধরা সিটির সেভেল সেভেনে ‘গিফট ফর ইউ’ শপের মনোমুগ্ধকর গিফট পছন্দ হয় স্বর্ণপ্রভার। হৃদয়গ্রাহী কারুকার্যখচিত গ্রীক পুরাণের দেবদূতের পিঠে উড়ন্ত মানব-মানবীর শিল্পমন্ডিত ‘ক্রিস্টাল এনটিক্স’ কিনে দিতে হয় অত্যন্ত চড়া দামে, একমাত্র বোনের আবদার রক্ষার্থে অসহায় ভাই তার বিদেশীনি বন্ধুর জন্যে। ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে বোন কনফার্ম করে ইতোমধ্যেই তার ইতালীয় রুমমেট ফ্রান্সিসকা ছুটি কাটিয়ে ফিরে গেছে টমস্ক ভার্সিটি হোস্টেলে, অপেক্ষা করছে স্বর্ণপ্রভার জন্যে।
:
আমিরাত ইকে ফ্লাইটে দুবাই হয়ে প্রায় দু’দিনের ক্লান্তিকর অথচ নির্বিঘ্ন বিমান আর ট্রেন জার্নি শেষে স্বর্ণপ্রভা পৌছে যায় তার টমস্কের ভার্সিটি জীবনে। শুরু হয় ব্যস্ততম লেখাপড়ার প্রতিযোগিতামূলক ছকে বাঁধা কাব্যময় জীবন। নতুন সেশনে রেজিস্ট্রেশন, ক্লাস রুটিন, নবতর ফ্যাকাল্টির সাথে পরিচয়পর্বে ব্যস্ততম সময় কাটে সারাদিন। জমে যাওয়া সন্ধ্যায় হোস্টেলে ফিরে দেখা মেলে ইতালীয় ‘টরিন’ শহরের নীল চোখ আর সোনালি চুলের লাস্যময়ি রুমমেট ‘ফ্রান্সিসকা’র সঙ্গে। টরিনের ছোট্ট আঞ্চলিক সাপ্তাহিকি ‘পেরানদেল্লা’র সম্পাদকের একমাত্র মেয়ে ফ্রান্সিসকা। তার আচরণে মনেই হয়না সে ইসিভুক্ত ইতালিয় নাগরিক, বরং নদী তীরের কোন এক লাজুক বাঙালি ললনার কথা মনে করিয়ে দেয় সে, যে গ্রাম থেকে বড় শহরে জীবনে প্রথম এসেছে মনে হয় ‘এসএসসি পরীক্ষা দিতে’। এমন সরলতার জন্যেই স্বর্ণপ্রভার সাথে অল্পদিনেই গড়ে উঠেছে সখ্যতা ফ্রান্সিসকার। 
:
দিন তিনেক আগে ফিরে এলেও ফ্রান্সিসকাও সারাদিন ব্যস্ত ছিল দূরবর্তী ফ্যাকাল্টির একটি অত্যাবশ্যকীয় কাজে। যে কারণে স্বর্ণপ্রভার সঙ্গে সারাদিন তার সেল ফোনে কথা হলেও, দেখা হয়নি একটু আগেও। দু’জনেই রাতে সাক্ষাতের প্রতিক্ষায় ছিল, যখন বিনিময় হবে তাদের দু’জনের কেনা ‘সিক্রেট’ উপহার।

স্বদেশ ত্যাগের প্রাক্কালে ফ্রান্সিসকাও একটি দামি উপহার এনেছে স্বর্ণপ্রভার জন্যে সুদুর ইতালির পৌরাণিক শহর রোম থেকে। রোমের বিশ্বখ্যাত মনোলোভা ফ্যাশন মল ‘ভ্যালেনতিনো’ থেকে ফ্রান্সিসকা কিনেছে ‘ফুলতোলা টি-শার্ট’ আর ‘স্নো প্রুফ জ্যাকেট সেট’ স্বর্ণপ্রভার জন্যে। সারপ্রাইজ গিফট দেয়ার জন্য দু’জনে সিক্রেট রেখেছে উপহারের নাম আর বর্ণনা। নানা কথকতা আর ডিনার শেষে স্বর্ণপ্রভা বের করলো প্রিয় বান্ধবি ফ্রান্সিসকার জন্য ঢাকার বসুন্ধরা সিটি থেকে মহাকষ্টে কেনা ‘এনটিক্স’টি পরম যত্নে। র্যােপিং করা এনটিক্স প্রদানের আগেই ফ্রান্সিসকা বের করলো তার টি-শার্ট আর জ্যাকেট সেট। কথা হলো একসঙ্গে ৩-২-১-০ ‘কাউন্ট-ডাউন’ করে দু’জনে খুলবে তাদের র্যা পিং এক সাথে। এবং কথামতো প্যাকিং উন্মোচনের পর ফ্রান্সিসকা চোখ ফেরাতে পারলো না ঢাকা থেকে স্বর্ণপ্রভার আনা ক্রিস্টাল এনটিক্স থেকে। স্বর্ণপ্রভারও খুব পছন্দ হলো ফ্রান্সিসকা প্রদত্ত টি-শার্ট ও জ্যাকেট সেটটি। মারাত্মক তুষারপাতেও জ্যাকেটটি ব্যবহার করতে পারবে স্বর্ণপ্রভা ভেবে মনে মনে পুলকিত হলো সে। পরম পছন্দে দু’জনে নাড়াচাড়া করার প্রাক্কালে স্বর্ণপ্রভা চিৎকার করে উঠলো বিস্ময়কর উল্লাসে, ‘‘আরে টি-শার্ট আর জ্যাকেটে ‘ভ্যালেনতিনো’ স্টিকার লাগানো থাকলেও, তাতে লেখা ‘মেড ইন বাংলাদেশ’। এ যে বাংলাদেশের গ্রামীণ বস্ত্র বালিকাদের তৈরী আমাদের প্রধানতম রপ্তানী পণ্য গার্মেন্টস আইটেম’’। 
:
স্বর্ণপ্রভার উচ্ছ্বাসে ফ্রান্সিসকা কিছুটা হক্চকিত হয়ে নিজের ক্রিস্টাল উপহারের নিচে খোদাই করা লেখাগুলো পড়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো দ্বিগুণ উল্লাসে, ‘‘আরে কি চমৎকার অদ্ভুৎ ব্যাপার, ঢাকা থেকে আনা তোমার উপহারটিতো ইতালীর তৈরী। দামী এ ক্রিস্টাল এনটিক্সগুলো তৈরী করে রোমের উপশহর ‘ইদিভার’এর শ্রমজীবী নারী শিল্পীরা, এদের জীবন আর শিল্পকর্ম নিয়ে এর আগে আমি একটি ডকুমেন্টারী দেখেছি চ্যানেল ফক্স-ফোরে। ক্রিস্টাল এনটিক্সের গায়ে ইতালীয় ভাষায় লেখা ‘‘ইদিভার-ইতালিয়ানো’’।
:
ভিনদেশি দুই তরুণী নিজ বাসভূম থেকে বহুদূরের রুশিয় কোন এক অখ্যাত ছোট্ট শহরে বরফঝড়া শীতার্থ রাতে বিদেশি কর্তৃক প্রদত্ত নিজ দেশিয় উপহার হাতে পরম বিস্ময়ে চেয়ে থাকে একে অপরের দিকে! যে দেশ আর মাতৃভূমিকে চরমভাবে ভালবেসেও, জীবন বাস্তবতায় যারা তাকে ফেলে এসেছে যোজন যোজন দূরে, সে দেশ ঠিকই তাদের মনে রেখেছে পরম মমতায় মাতৃস্নেহে। এবং তাই প্রাক্তন সোভিয়েতের উত্তর-পূর্ব সাইবেরীয় বরফ জমা এক নিস্তব্দ শহরের নিঝুম রাতে বিশ্বের দুই প্রান্তিকের দুই তরুণীকে বিস্ময়করভাবে স্বাদেশিক উপহারে উদ্ভাসিত করে পরম মমতায়, যার ব্যাখ্যা হয়তো এ বস্ত্তবাদি সমাজ দিতে পারবে না কোন কালেই। কিন্তু উপহার হাতে ফ্রান্সিসকা আর স্বর্ণপ্রভার চোখ যখন বাইরে তুষারপাতের মত নোনা জলে ঝাপসা হয় ক্রমশ, তখনও তারা বুঝতে পারে না এ কান্না আসলে কিসের! এ কি ফেলে আসা মা-বাবা, স্বজন কিংবা অলৌকিকভাবে নিজ মাতৃভূমি প্রদত্ত বিস্ময়কর স্বাদেশীক উপহারের জন্যে? 



লেখাটি ফেসবুকে দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যান প্লিজ !

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন