শুক্রবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পের ‘ভিখুর শেষ অভিযান’ [ছোট গল্প # ১৭ ]








[ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিশ্বখ্যাত শ্রেষ্ঠ ছোটগল্প ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পের শেষাংশ হিসেবে এটি লিখিত। যারা মূল গল্পটি পড়েননি, তাদেরকে আগে মূল গল্পটি পড়ার অনুরোধ করছি, যাতে এটি বুঝতে সুবিধা হয়। মূল গল্পের লিংক : http://mohamoti.blogspot.com/2013/03/blog-post_4521.html ]

এই ২০১৪ সালেও ভিখুর সাহসিকতা, অমানবিকতা, প্রতিশোধস্পৃহা, জীবনদ্রোহ একটুও কমেনি। এক অসাম্য আর অগ্রহণযোগ্য সমাজের বিরুদ্ধে যাহা তাহার বিপ্লবেরই নামান্তর। ভিখুর বিচারে অবিচার, ব্যধি ও দারিদ্র্য তাঁহাকে আমৃত্য ঠ্যাঙ্গাইয়াছে যত্রযত্র। পাঁচীকে পিঠের উপর বহন করিতে করিতে জীবনের নৌকাটি টালমাটাল হইয়া পড়িয়াছে, এখন তাহাকে নোঙর করিতে হইবে কোন এক ঘাটে। ভিখু শত অসামর্থ ও বাঁধা উপেক্ষা করিয়া বাঁচিবার দুদান্ত স্বপ্নে আবার বিভোর হয়। পাঁচীর প্রাক্তন প্রেমিক বসিরকে হত্যা করিয়া উপার্জিত ’শ টাকা পুঁজি লইয়া পাঁচীকে কাধে বহিয়া দক্ষিণ বাংলার নানান দ্বীপে সে ঘুরিয়া ঘুরিয়া অনেকটাই ক্লান্ত শ্রান্ত এখন। অবশেষে মেঘনা তীরবর্তী ‘পাতারহাট’ বন্দরে একটি খেয়া নৌকা বাগাইয়া তাহার উপার্জনে নতুন সংসার চালাইতে মনস্থির করিল সে। এ জগৎ-সংসারে কতই না কিছু ঘটিতেছে, যাহা সচরাচর সাধারণ মানুষের দৃষ্টির অন্তরালে, অনুধাবনের উর্ধে থাকিয়া যায়। ভিখু সেই মানুষের প্রতিভূ যে পরাস্ত হইতে জানে না, কখনোই সে পরাস্ত হইবে না।


এরই মধ্যে দ্বীপাঞ্চলের সহায়হীন মানুষের চিকিৎসার জন্য পাতারহাট ঘাটে ভেড়ে বিদেশি ভাসমান হাসপাতাল ‘জীবননৌকা’। ভিখু নদীতে হরেক মানুষ পারাপার করে আর অবসরে হাসপাতাল ‘জীবননৌকা’র দিকে হা-করিয়া তাকাইয়া থাকে। ৩-তলা জাহাজের রেলিংয়ে দাঁড়ানো বিদেশি রূপশ্রী মনোলোভা নার্স-ডাক্তারগণ ভিখুর পলকহীন লোভনিয় দৃষ্টি এড়াইতে পারেনা। জাহাজটিতে উঠিবার প্রবল ইচ্ছা জাগে ভিখুর মনে। সময় পরিক্রমায় ঈশ্বর বোধহয় সদয় হয় ঈশ্বর অবিশ্বাসি ভিখুর প্রতি। একদিন বিকেলে ২-ডাক্তার নৌবিহারে ওঠে ভিখুর পারাপারের নৌকায়। নিজেদের মধ্যে অবোধ্য ভাষায় কথা বলে, হাসাহাসি করে ডাক্তারদ্বয়। ভিখু হা করিয়া তাহাদের কথা বুঝিবার চেষ্টা করে। পুরুষ ডাক্তারটি বয়স্ক, মোটা, তামাটে ও কদর্য অনেকটা, মনে হয় আফ্রিকান। সঙ্গের মেয়েটি অল্পবয়স্কা, সুন্দরী, নিলাক্ষী, সোনালি চুলের। নদীর উজানে অনেকদূর যাওয়ার পর ভিখুর অসাড় হাতটির দিকে চোখ পড়ে মেয়েটির। সে ভাঙা বাংলায় তাহার হাতের অবশতার কথা জানিতে চাহে ভিখুর কাছে। ইশারায় তাহাকে জাহাজে যাইতে বলে পরেরদিন। জানায় তাহার নাম ডা. ইরিনা, বেলজিয়াম নামক একটি দেশে তাহার বাড়ি।


ইরিনা খুব যত্নে পরিক্ষা করে ভিখুর অবশেন্দ্রিয় ডানহাত খানি। হাতে আঘাত করিয়া, চিমটি কাটিয়া নানারূপ পরিক্ষায় পুলকিত হয় ক্ষুধাতুর ভিখুর শরির। একটা যন্ত্রে হাত ঢুকাইয়া তাহাতে ক্রমাগত উত্তাপ দিতে দিতে একসময় অবশায়িত হাতটি ফিরিয়া পায় তাহার লুপ্ত শক্তি। ভিখুর জিনের জন্মগত প্রবৃত্তির প্রজন্ম পরম্পরার ধারাবাহিকতা সত্য হিসেবে ভিখুর সামনে উপস্থাপিত হয়। ডা. ইরিনার প্রতি কৃতজ্ঞতার বদলে ভোগষ্পৃহা আর কামলোলুপতা ভিখুর বিচিত্র জীবনের অন্ধিসন্ধিতে হানা দিতে শুরু করিয়াছে। অনিষ্টসাধক ক্ষুধাতুর ভিখু কাউকেই ক্ষমা করেনি এ জীবনে। বসন্তপুরের বৈকুণ্ঠ সাহা, চিতলপুরের পেহলাদ, বিন্নু মাঝির চালা, বসির বা পাঁচী সবারই থেকে চরম প্রতিশোধ নিয়াছে ভিখু। পাঁচীর দূরারাগ্য ঘায়ের যন্ত্রণায় শেষাবধি তাহাকে মাঝ নদীতে ডুবাইয়া দিয়াছে ভিখু রাতের অন্ধকারে। প্রতিশোধ নিতে গিয়াছিল পেহলাদের স্ত্রীরও কিন্তু খুঁজিয়া পায় নাই ভাগ্যবতি বাগ্দিকন্যাকে এ ত্রিভূবনে।


ঘটনাক্রমে ডা. ইরিনার সহিত ভাব জমিয়াছে ভিখুর। তাহার জন্য প্রতিবেশির গাছের চুরি করা ডাব সমেত সে ঢুকিয়া পড়ে জাহাজে সরাসরি ইরিনার কেবিনে। সরল বিশ্বাসে বিদেশি ডাক্তার ইরিনা এক গ্রামিণ মাঝির আন্তরিকাতায় মুগ্ধ, পুলকিত ও আনন্দিত হয়। ভিখু নিবিড় পর্যবেক্ষণ করে তাহার কক্ষ-আসবাব-বিছানা বহির্গমন পথ ইত্যাদি। প্রায় মাসাধিকাল হইয়া গেল এই দ্বীপবন্দরে ‘জীবননৌকা’র। ইরিনা জানাইয়াছে শিঘ্রই চলিয়া যাইবে তাহারা ঢাকার উদ্দেশ্যে, তাহার পর স্বদেশ বেলজিয়ামে।

‘জীবননৌকা’র বদৌলতে ২-হাতে ক্ষমতাধর ভিখু আর সময় ক্ষেপণ করিতে চাহেনা। আপন পরিকল্পনা মোতাবেক রাতের অন্ধকারে নিজ নৌকা জাহাজের সঙ্গে লাগাইয়া তরতর উঠিয়া যায় দোতলায় ইরিনার কক্ষে। সন্তর্পণে দরজা ঠেলিয়া ভেতরে ঢুকিয়া আলো আঁধারীর আবছা আলোয় ঠাহর করে ঘুমন্ত বিদেশীনি ইরিনাকে। নিখুঁত দক্ষতায় গামছায় বাঁধিয়া ফেলে ইরিনার মুখ আর হাত-পা। পাতলা ছিপছিপে ইরিনাকে নিয়া রেলিং বাহিয়া নৌকায় নামিতে তেমন বেগ পাইতে হয়না শক্তিধর দক্ষ প্রাক্তন ডাকাত ভিখুর। কিন্তু জাহাজের রক্ষিরা টের পাইয়া চিৎকারে জাগিয়ে দেয় পুরো জাহাজকে। সাহসে অপরাজেয় ভিখু নানাবিধ চিৎকার ও হৈচের ভিতরেই পাটাতনে ইরিনাকে ছুড়িয়া নৌকা ছাড়িয়া দেয় প্রবল ভাটির টানে সোজা দক্ষিণমুখি। জাহাজিরা ছোট নৌকা খুঁজিতে থাকে ভিখু-ইরিনা অনুসরণে! অন্ধকারে জগৎ চরাচরের সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় অমানবিয় আর অবিশ্রান্ত ভিখু নির্জিব ইরিনাকে লইয়া এক অনন্তের পথে যাত্রা করে।

মেঘনার তিব্র ঘোলা ঘুর্ণিবর্তে অন্ধকার মায়াবি আকাশে নানাবিধ নক্ষত্রের আলোতে ভর করিয়া প্রবল স্রোতে এক বিদেশিনিসহ নৌকা আগাইয়া যায় ভাটির স্রোতে। নদিতিরের গাছগাছালির আবছা আলোয় দূরগ্রামে ক্ষীণ চাঁদ পূর্ব দিগন্তে উঁকি মারে। প্রবল মেঘনায় বিরামহিন জলস্রোতের কলধ্বনি ছাড়া ঈশ্বরের পৃথিবিতে শান্ত নিরবতা এই কালরাত্রিতে। হয়তো ঐ নক্ষত্র, মহাকাশ আর এই পৃথিবির ইতিহাস আছে কিন্তু যে অন্ধকার জগতের জিন বহন করিতেছে এক ঋণাত্মক আবেষ্টনি, তাহা অনন্ত আর প্রাগৈতিহাসিক। মহাজাগতিক কোন আলো আজ পর্যস্ত তাহার সন্ধান পায় নাই, কোনো দিন পাইবে কিনা তাহা ভিখু জানেনা, কেবল কালচক্রই বলিতে পারে।


লেখাটি ফেসবুকে দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যান প্লিজ !

https://www.facebook.com/photo.php?fbid=1461548024079349&set=a.1381466915420794.1073741828.100006724954459&type=1&theater

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন