সোমবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

ফেসবুক বন্ধু নিত্যহরির অসুস্থ্যতা এবং তার স্ত্রীর জীবন দহনের গান [চলার পথের গল্পমালা] # ৫৬



ফেসবুকে প্রবাসি Nitya Hari Mondal-'র সাথে পরিচয় হয় আমার গতবছর এ দিনেই। আমার মতই এক অন্ধকার দ্বীপের বাসিন্দা বন্ধু নিত্যহরি। ভোলা জেলার এ হাসিখুশি মানুষটি আমায় ক্লিক করেছিল আলজিরিয়া থেকে। সেখানে ভাল পদে জব করে সে। আমার ধর্মমুক্ত, মুক্তচিন্তনের মানবতাবাদি লেখার ভক্ত হয়েছিল নিত্যহরি। নভেম্বর'১৪-তে ছুটিতে দেশে এলে দেখা করতে চায় আমার সাথে। শত ব্যস্ততাকে পায়ে ঠেলে নিত্যহরি আর আমি শাহবাগের ছবির হাঁটের পাশে বসি অন্তরঙ্গ নিবিড়তায়। আলজিরিয়া থেকে তাজা খেজুর, আর একটা সেন্ট এনেছে আমার জন্যে প্রথম পরিচিত বন্ধু নিত্যহরি। দুজনে ফুসকা খা্ই ছবিরহাঁটের ফুটপাথে। নিমন্ত্রণ করি তাকে বাসায় বৌদিসহ বেড়াতে। কথা দিলেও সপ্তপদি ব্যস্ততায় চলে যায় সে আলজিরিয়া আমার নিমন্ত্রণ গ্রহণ না করেই।
:
মাস তিনেক আগে হঠাৎ একদিন কল দিলো ঢাকা থেকে। বিস্মিত করে জানায় কি একটা অসুখ নিয়ে দেশে ফিরেছে সে। চিকিৎসা বিষয়ক পরামর্শ চায় আমার কাছে। অনেক স্বজনকে ভারতে চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ্য করেছি আমি। নিজেরও "হাত কাম ঘাড় কাম বুক" ব্যথা হলে, বাংলাদেশের নানাবিধ বিশেষজ্ঞগণের পরামর্শেও যখন ব্যথা বাড়তেই থাকে, তখন পরামর্শ নিলাম কোলকাতার পিয়ারলেসের একজন নিউরোলজিস্টের। সব শুনে ঢাকার এক্সরে ইত্যাদি দেখে বললেন, এটা "কম্পিউটার সিনড্রোম"। যারা বেশিক্ষণ কাজ করে পিসি বা ল্যাপটপে তাদের হয় এটা। একটানা বেশিক্ষণ পিসিতে কাজ না করতে, ১-ঘন্টা পর পর উঠে একটু হাঁটতে, আর ঘাড়+হাতের কিছু ব্যয়াম শিখিয়ে বিনা ওষুধে বিদেয় দিলেন কোলকাতার নিউরোলজিস্ট। বিস্ময়করভাবে মাস খানেকের মধ্যে পুরো হাত, ঘাড় আর বুকের ব্যথা চলে গেল আমার। ঐ ডাক্তার কি জাদুকর পিসি সরকারের বংশধর ছিল নাকি?
:
তাই বন্ধু নিত্যহরিকেও বললাম, "কোলকাতা যান, সম্ভবত কম খরচে ভাল ট্রিটমেন্ট পাবেন"। এরপর সেও আর যোগাযোগ করেনি, আমি নানাবিধ ব্যস্ততায় আর খোঁজ নেইনি ঐ ফেসবুক বন্ধুর। মনে করেছিলাম, আগের মতই হয়তো আবার চলে গেছে আলজিরিয়া কর্মস্থলে সুস্থ হয়ে।
:
গতকাল ফেসবুকবন্ধু মাহফুজ কি প্রসঙ্গে যেন বললো নিত্যহরির অসুস্থ্যতার কথা। ক্যান্সার জাতিয় রোগের কথাও বললো সে। অনেক দিন খোঁজ না নেয়া বন্ধুর জন্য মন উতলা হলো তাৎক্ষণিকভাবে আমার। ফোন দিলাম রাতেই নিত্যহরিকে। জানলাম, অনেক দুরে থাকে সে, বুড়িগঙ্গার ওপারে কেরাণিগঞ্জে একটা ছোট ফ্লাট কিনেছিল, সেখানেই এখন দিন কাটে তার ফেসববুকহীন জীবন।


আজ অফিসে একটু ঢু মেরেই নিজে ড্রাইভ করে 'বসিলা ব্রিজ' পার হয়ে হাজির হলাম বন্ধু নিত্যহরির বাড়ি। ১-বছর আগের আর আজকের নিত্যহরিকে দেখে নিজের অজান্তেই আঁতকে উঠলাম আমি। জটিল ক্যান্সারে আক্রান্ত সে। ভারতে যাওয়ার মেডিকেল ভিসার জন্যে পাসপোর্ট জমা করেছিল ভিসা সেন্টারে। কাগজপত্রের নানাবিধ অপ্রতুলতার কথা বলে ভিসা ছাড়া পাসপোর্ট ফেরত দিলো দুতাবাস। এবার আলজিরিয়ান ডাক্তার, ওখানের দাপ্তরিক কাগজপত্র, ভারতের টাটা ক্যান্সার হাসপাতালের এ্যাপয়েন্টমেন্ট, ঢাকার ডাক্তারের সব মূল কাগজপত্রসহ পুনরায় জমা দিল ভিসা সেন্টারে। ৩ দিন পর পাসপোর্ট ফেরত পেল ভিসা ছাড়া। সে কারণ জানতে চাইল ভিসা না দেয়ার, আর ফেরত চাইলো তার মুল কাগজপত্র। কিন্তু ভিসা সেন্টারের লোকজন কোন সহায়তাই্ করলো না তাকে। বিদায় দিলো নিষ্ঠুরভাবে। একজন হিন্দু নামধারীকে চিকিৎসা ভিসা দিলোনা ভারত কি এক অবোধ্য কারণে, তা মাথায় ঢুকলো না আমার। এটা কি আলজিরিয়ান ভিসা থাকার কারণে? তার জমাকৃত মূল কাগজগুলোও দরকার তার খুব, তাও ফেরত পাচ্ছেনা ভারতীয় দূতাবাস থেকে মারাত্মক অসুস্থ্য বন্ধু নিত্যহরি।
:
অবশেষে ঢাকাতেই মাথায় একটি অপারেশন, আর ক্যামোথেরাপি করালো প্রাইভেট হাসপাতালে। বিদেশ থেকে সঞ্চিত ১০-লাখ টাকার সবই শেষ হয়ে গেল বন্ধু নিত্যহরির। দুসন্তান তার। এক ছেলে আর এক মেয়ে। দুজনেই ৯ম শ্রেণিতে পড়ে ঢাকাতে। কেনা ছোট ফ্লাটটির অর্ধেকেরও বেশি টাকা অপরিশোধিত। নিত্যহরির বউ গান শিখেছিল বিয়ের আগে। সখে গান গাইতো অনেক অনুষ্ঠানে, এমনকি বাংলাদেশ বেতারেও। আজ অশ্রুসজলতায় গাইলো "আমার এ জীবনের সেই শুভদিন ফিরে আ্সবে কবে? সুন্দর পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হবে"।


বিদায় নিতে মন চাইছিল না আমার। জুকারবার্গের ফেসবুক মায়াফ্যাক্টরিতে বাঁধা পড়েছিল আমার মন। আমার জীবনের অন্তর্বর্তী গল্পগুলো আর শেয়ার করা হয়নি নিত্যহরির সাথে। সে এখন আর ফেসবুকে ঢোকেনা, সম্ভবত ঢুকতে পারেনা। আইডিটি ৯ম শ্রেণি পড়ুয়া ছেলেটি চালায় এখন। দরজা খুলে সিড়িতে নামি আমি। নিত্যহরির রুগ্ন অগ্নিকুণ্ডের কিনারে কষ্টের পরজীবী প্রজাপতিরা ওড়াউড়ি করে। মায়ের টাকায় সদ্য কেনা গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে হাতে রেখে ক্ষণজীবী মানুষের যাপিত জীবনের গার্হস্থ্যবেলায় হারিয়ে যাই আমি। আর প্রশ্ন করি এক অচেনা অদেখা কাল্পনিক ঈশ্বরকে, যে ধ্রুপদী সময়ের কাছে বাঁধা মানবিক সম্পর্কগুলো পদদলিত করে নিত্যহরিকে নিয়ে যায় প্রকৃতির লোহিততন্ত্রের তীব্র দাহনদ্বারে। তখন প্রাগৈতিহাসিক চিরন্তন জগদ্দল দু:খরা গাড়ির পেছনের সিটে বসে আমার সাথে যাত্রী হয়ে। আমাদের ভালবাসর প্রাচীন বসতভিটায় হাঁটি আমি একাকি দু:খদের সাথে। এক ফণাধরা ক্লান্ত গোক্ষুর এক ফালি কষ্টের নদী হয়ে আমার দম আটকে ধরে তখন। 
:
ছবি পরিচিত :
১) ১-বছর আগের দেখা বন্ধু নিত্যহরি;
২) আজকের অসুস্থ্য বন্ধু নিত্যহরি;
৩) জীবন দহনের গান গাইছেন নিত্যহরির স্ত্রী।



লেখাটি ফেসবুকে দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যান প্লিজ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন