রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

কনকপ্রভা আর আমার জীবনদহন : ৫ [কাব্যিক গল্পমালা সিরিজ] গল্প # ৪১



বাড়ি পৌঁছানোর পথেই আমার মৃত মায়ের সমাধিশৌধের সামনে দাঁড়াই আমি। যে সমাধিতে ঘুমিয়ে আছে মা সাত বছরেরও বেশি সময়। যে মার কারণে সাতসমুদ্র তের নদীর কত দেশে ঘুরেছি আমি অথচ মা ঘুমিয়ে রয়েছে এ ঘুঘুডাকা পাতাঝড়া মাটির বিছানায় ছোট্ট গাঁয়ে। মার স্মৃতিতে রক্তাক্ত হয় আমার হৃদয়, মাকে ভাসিয়ে রেখে আজ আমার ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করেনা কোথাও। আমার জীবন দহনে কণকপ্রভাও পুড়তে থাকে, হয়তো বিশ্বের সকল মা আর সন্তানের এ এক চিরন্তন জীবনবোধ। আকাশে তারা হয়ে জেগে থাকা মাকে ফেলে শিয়রে প্রজ্জ্বলিত আলোকমালা হাতে আমরা বাড়ির দিকে এগুতে থাকি।
:
প্রবেশের আগে মার প্রতিষ্ঠিত মক্তবে সুর করে শিশুদের সুরা মুখস্তের সমবেত সুর শুনে কণকপ্রভা ঢুকতে চায় মক্তবে। এখানেও অপাঙক্তেয় 'নারী'কে মক্তবের দরজায় দাঁড় করাই আমি, শ'দুয়েক শিশুরা সমবেত কোরাসে আমাদের সালাম দেয়, যেন বিশাল মিছিলের কোন সমবেত ধ্বনি। 
:
অনেকদিন মানুষহীন বাড়িতে ঘাস ওঠা উঠোন পেড়িয়ে পুকুরপাড়ে যাই আমরা। খবর পেয়ে স্বজনরা অনেক ডাব পাড়িয়েছে আমাদের জন্যে প্রায় ৪০-টার মতন, মার লাগানো সকল গাছে এখন প্রচুর নারিকেল ধরে, মার সন্তানেরা এখন সবাই বাড়িছাড়া জীবন বাস্তবতায়, তাই কে খাবে এতো ডাব? শীতের দিনে এতো ডাব কিভাবে খাবো ভেবে না পেয়ে এক প্রস্তাব দেই কণকপ্রভাকে, যেন ডাবের পানিতে সে মুখ ধোয় এমনকি চাইলে পুরো শরীর, তাতে কমনীয়তা বাড়তে তার। এ প্রস্তাবে সানন্দে সায় দেয় কণকপ্রভা, আর তাকে চল্লিশটি ডাবের পুরো এক বালতি ডাবের পানিতে স্নান করতে হয় অবশেষে। এমন স্নানে জীবন লহমায় বিচ্ছুরিত আলোক ছটায় মোহিত হয় কণকপ্রভার চিন্তন। 
:
বিকেলের সূর্য ঢলার আগেই আমরা বেড়িয়ে পরি চার কিলোমিটার দূরের বসতিহীন দ্বীপচরের উদ্দেশ্যে। যে চরে কেবল শ'দুয়েক মহিষ, আর তার রাখালেরা থাকে রাতে। চরে যেতে বেদেদের নৌকোয় উঠি আমরা। নারীনেত্রীত্বপ্রধান ভাসমান বেদেরা জলে জলে ঘুরে বেড়ায় জাল আর বড়শি নিয়ে। মাছ ধরে নারীরা, নৌকাও বায় তারা। পুরুষরা রান্না আর শিশু রক্ষণাবেক্ষণ করে নৌকোতে। জলজীবনে বিচিত্র সুখদুখ তাদের। শিশুদের দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতে হয় ভাসমান নৌকোতে, যেন জলে না পড়ে যায় অসাবধানে কখনো। আমাদের অজান্তেই প্রাকৃতিক জীবন্ত দুপুর শেষ হয়ে বিকেলের রোদ খিল খিল করে হেসে ওঠে বালির চরে। আমাদের হোগলা পাতার বনে নামানোর আগে বেদে রমণিরা চুরি বিক্রি করতে ভোলেনা কণকপ্রভার কাছে। 
:
শুকনো বালির চরে হোগলা পাতার বনে আমাদের স্বাগত জানাতে আসে মহিষের ৩-রাখাল। শান্ত বিকেলে ধারালো পাতার মেঠো পথে আমাদের এগিয়ে নেয় রাখালেরা পরম যত্নে। এ চরে আমাদের পৈত্রিক ভূমি আছে একটা বিশাল, যেখানে চরে বেড়ায় রাখালদের মহিষ। আমার বাবারও এক সময় শ'খানেক মহিষ চরে বেড়াতো এ ভূমিতে। বাবার সন্তানেরা এখন ঢাকা কিংবা ইউরোপ আমেরিকা পরিজায়ী হওয়াতে মহিষের পুত্র-প্রো-পৌত্ররা এখন অন্যের মালিকানায়। তারপরো আমাদের সম্মান করে বর্তমান মহিষ মালিক আর তাদের রক্ষক রাখালেরা। 
:
বসতিহীন এ চরে বর্ষার দিনে থাকে প্রায় জলমগ্ন। আর শীতে শুকনো ধু-ধু বালির চর। হোগলা পাতা আর নানাবিধ ঘাস জন্মে এ বালুতটে। তাই গরু মহিষ পালে এলাকার গৃহস্তরা ফসলহীন এ চরে। প্রতি ৫০/৬০টা গরু মহিষের জন্যে একজন রক্ষক বা রাখাল থাকে চরে। বাঁশের খুটি দিয়ে উঁচু ঘর তৈরি করে রাখালেরা তাদের থাকার জন্যে। যাতে নিচে পানি থাকলেও উঁচু সিঁড়ি দিয়ে ও্পরে উঠে রাতে ঘুমোয় তারা আপাত নিরাপদ বাসস্থান হিসেবে। প্রতিদিন সকালে পাশের গাঁ থেকে গোয়ালা আশে নৌকো নিয়ে দুধ সংগ্রহে। রাখালদের জন্যে চাল-ডাল, তেল-নুন নিয়ে আসে তারা ফরমায়েশ মতো। কখনো রাখালেরা ১০/১৫ দিনে পর একবার বাড়ি যায় নিজের পরিবারের কাছে, সকালে গেলে আবার বিকেলে ফিরতে হয় চরে। এখন রাখালরাও ব্যবহার করে সেলফোন এ চরে, মালিকরা কিনে দিয়েছে ফেসবুক করতে নয়, তার পশুদের নিরাপত্তার জন্যে। 
:
রাখালদের মাচার মত বানানো ঘরে বাঁশের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে কষ্ট হয় কণকপ্রভার, তারপরো ৩ রাখাল আর আমার সহযোগিতায় উঠে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে বিকেলের আলোকপ্রভা সূর্যের মত। রাখালরা চরের ছোট খালে ধরা বেলে, বাটা মাছ, ঘন মহিষের দুধ আর মোটা চালের ভাত দিয়ে আপ্যায়ন করে আমাদের। কণকপ্রভার আগ্রহে রাখালরা সরাসরি মহিষের বাট থেকে উষ্ণ দুধ টেনে তার মুখে ফেলে। কণকপ্রভা গভীর প্রেম আর অনুরাগের আনন্দে হেসে হেসে সারা মুখে ঘন মহিষের কাচা দুধে নিজেকে সিক্ত করে। শান্ত নারী মহিষের পিঠে চরায় রাখালেরা তাদের নারী অতিথিকে। বুনো মহিষের গল্প শোনায় তারা, নারীদের দেখলে কিভাবে বুনো পুরুষ মহিষ আক্রমন করে, তার শিহরিত গল্প শুনে আতঙ্কের আঁচলে কণকপ্রভা মুহূর্তে নেমে যায় মহিষের পিঠ থেকে।


লেখাটি ফেসবুকে দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যান প্লিজ





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন