রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

কনকপ্রভা আর আমার জীবনদহন : ৬ [কাব্যিক গল্পমালা সিরিজ] গল্প # ৪২


ঘাসপাতার ধূসর বিকেলের পড়ন্ত লালচে রোদে পিঠ দিয়ে সূর্য অস্ত যায় ক্রমশ। গোধূলির আকাশে শব্দতুলে দুরের পাখিরা মাকড়সার জালের ছবি আঁকতে আঁকতে অনন্তে যাত্রা করে। পাতার বনে ছোট নাম না জানা পাখিরা গান গাইতে থাকে ঘনায়মান অন্ধকার মাঝে। প্রাণহীন চরে জীবনের ডাকে প্রাণময়তায় আমরা যখন ঘুরে ফিরি, তখন সন্ধ্যার প্রাক্কালে জলতল ভেদ করে থালার মতো চাঁদ দেখে আমরা অপার আনন্দে আন্দোলিত হই। এ যেন দুর্গম খাদ বেয়ে গড়িয়ে নামা উন্মত্ত ঝর্ণা, যার রূপের অঝোর ধারায় তছনচ করে এক জঘন্য সুন্দর!
:
এক জোছনাধোয়া সন্ধ্যারাতে ভরা চাঁদে ক্রমান্বয়ে অন্ধকার ধুসরিত হয়, রূপোলি ইলিশের মত আলোয় পুরো চর চকচক করতে থাকে। প্রবাসী নারী অতিথির জন্যে জোনাকিরা পাতারবনে আলোকমালার খেলা জুড়ে দেয়, যেন হাজারো ফুলে ঝরা বকুলের চাদর। কণকপ্রভাকে নিয়ে নদীর তীরঘেষে বুনো ঘাসে বসি আমরা। মৃত্তিকার সাথে জলদের বিবাদ; নদী, আকাশ, চাঁদ আর মেঘেদের ডুবসাঁতার দেখতে দেখতে রাত গভীরতর হয়। আমাদের পাশ ঘেয়ে সপ্তবর্ণা আলোকমালা তুলে ঢাকার দিকের জলযানগুলো রাতের জলকেটে এগুতে থাকে। একটা থেকে হঠাৎ সার্চলাইট মারে আমাদের দিকে, জানিনা এ গহীন রাতে জনমানবহীন চরে দুজন পাশাপাশি মানুষকে নৈ:শব্দতার মাঝে বসে থাকতে দেখে তারা কি ভাবছে?
:
স্বচ্ছ আকালে লক্ষকোটি নক্ষত্র আর নদীতে জ্বলজ্বলে করে জেলে নৌকোর অগণিত আলোকমালা। রাখালরা শক্তিশালী টর্চ হাতে চরময় ঘুরে বেড়ায় তাদের পশু আর আমাদের নিরাপত্তায়। নীল অপরাজিতা আলোর ঘ্রাণে ডুবসাঁতার দিতে দিতে কণকপ্রভা তার শক্তিধর দুরবীন দিয়ে খুঁজতে থাকে নক্ষতমালাকে। আমি তাকে নক্ষত্রের নাম দিয়ে সহায়তা করি, যাতে সে খুঁজে পায় পূর্বাষাঢ়া; উত্তরাষাঢ়া; শ্রবণা; ধনিষ্ঠা; শতভিষা; পূর্ব্বভাদ্রপদ; উত্তরভাদ্রপদ; রেবতী; অশ্বিনী; ভরণী; কৃত্তিকা; রোহিণী; মৃগশিরা; আর্দ্রা; পুনর্বসু; পুষ্যা; অশ্লেষা; মঘা; পূর্বফাল্গুনী; উত্তরফাল্গুনী; চিত্রা; বিশাখা; অনুরাধা; জ্যেষ্ঠা; মূলা বা স্বাতী নক্ষত্রকে। ক্ষয়িষ্ণু ঝড়েপড়া নক্ষত্রের মাঝে আমার মাকে খুঁজতে থাকি আমি এক ঘোরতর তন্দ্রার ভেতর। পশ্চিমাকাশে আকস্মিক হাজারো নক্ষত্র খসে পরে, তা দেখে মার জন্যে আমার একাকিত্বের মৌলিক অবোধ দুঃখবোধগুলো লিন হতে থাকে ভোরের শিশির ঝড়া কাশফুলের পাপড়ির মত।
:
দূরে জেলে কিংবা বেদেদের নৌকোয় বাউলের একতাড়ায় দেঁহাতি সুর বাজে, যাতে জীবনের ডাকে ক্ষয়ে যাওয়া মানুষের পোড়ানো হৃদয়ের কথকতা ধ্বনিত হয়! এক পরিমিত প্রিয় নিরবতার মাঝে শৃঙ্খলা কিংবা বিশৃঙ্খলা; স্থিরতা কিংবা অস্থিরতা; সময়-স্রোত-ইচ্ছা আর স্বপ্নেরা মহাকাশের অনন্ত নক্ষত্রের মাঝে খেলা করে ক্রমাগত। মনে হয় তাতে আমরা দুজনেই জ্বলছি; নিশ্চুপ জ্বালাচ্ছি এ গভীর অদ্বিতীয় আবছা অন্ধকারকে। জগতের এ শান্ত সৌম্যের মাঝে রাতের বয়ে চলা মাটিনদী কিংবা আকাশনদীর ধারাবাহিক কুহকগুলো নিবিড় রাত্রির বিছানায় জেগে থাকে অনন্তে। আর আমরাও এ বসতিহীন মহিষের চরে বিস্ময়ের বিষণ্ণ অসীমে জেগে থাকি আদিম কামনাবাসনাহীন কর্ষিত জমির মতো। 
:
নক্ষত্র খুৃঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত কণকপ্রভার চোখ ক্লান্তিকে ক্লেদাক্ত হয়। ঘুমের কথা বলে সে। টের পেয়ে আমি তাকে তসলিমা নাসরিনের রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে লেখা চিঠিটার কথা বলি। ডায়েরি খুলে পড়ে শোনাই তাকে--
:
প্রিয় রুদ্র, প্রযত্নেঃ আকাশ,
তুমি আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখতে বলেছিলে। তুমি কি এখন আকাশ জুড়ে থাকো? তুমি আকাশে উড়ে বেড়াও? তুলোর মতো, পাখির মতো? তুমি এই জগত্সংসার ছেড়ে আকাশে চলে গেছো। তুমি আসলে বেঁচেই গেছো রুদ্র। আচ্ছা, তোমার কি পাখি হয়ে উড়ে ফিরে আসতে ইচ্ছে করে না? তোমার সেই ইন্দিরা রোডের বাড়িতে, আবার সেই নীলক্ষেত, শাহবাগ, পরীবাগ, লালবাগ চষে বেড়াতে? ইচ্ছে তোমার হয় না এ আমি বিশ্বাস করি না, ইচ্ছে ঠিকই হয়, পারো না। অথচ এক সময় যা ইচ্ছে হতো তোমার তাই করতে। ইচ্ছে যদি হতো সারারাত না ঘুমিয়ে গল্প করতে – করতে। ইচ্ছে যদি হতো সারাদিন পথে পথে হাটতে – হাটতে। কে তোমাকে বাধা দিতো? জীবন তোমার হাতের মুঠোয় ছিলো। এই জীবন নিয়ে যেমন ইচ্ছে খেলেছো। আমার ভেবে অবাক লাগে, জীবন এখন তোমার হাতের মুঠোয় নেই। ওরা তোমাকে ট্রাকে উঠিয়ে মিঠেখালি রেখে এলো, তুমি প্রতিবাদ করতে পারোনি।
:
আচ্ছা, তোমার লালবাগের সেই প্রেমিকাটির খবর কি, দীর্ঘ বছর প্রেম করেছিলে তোমার যে নেলী খালার সাথে? তার উদ্দেশ্যে তোমার দিস্তা দিস্তা প্রেমের কবিতা দেখে আমি কি ভীষণ কেঁদেছিলাম একদিন! তুমি আর কারো সঙ্গে প্রেম করছো, এ আমার সইতো না। কি অবুঝ বালিকা ছিলাম! তাই কি? যেন আমাকেই তোমার ভালোবাসতে হবে। যেন আমরা দু’জন জন্মেছি দু’জনের জন্য। যেদিন ট্রাকে করে তোমাকে নিয়ে গেলো বাড়ি থেকে, আমার খুব দম বন্ধ লাগছিলো। ঢাকা শহরটিকে এতো ফাঁকা আর কখনো লাগেনি। বুকের মধ্যে আমার এতো হাহাকারও আর কখনো জমেনি। আমি ঢাকা ছেড়ে সেদিন চলে গিয়েছিলাম ময়মনসিংহে। আমার ঘরে তোমার বাক্সভর্তি চিঠিগুলো হাতে নিয়ে জন্মের কান্না কেঁদেছিলাম। আমাদের বিচ্ছেদ ছিলো চার বছরের। এতো বছর পরও তুমি কী গভীর করে বুকের মধ্যে রয়ে গিয়েছিলে! সেদিন আমি টের পেয়েছি।
:
আমার বড়ো হাসি পায় দেখে, এখন তোমার শ’য়ে শ’য়ে বন্ধু বেরোচ্ছে। তারা তখন কোথায় ছিলো? যখন পয়সার অভাবে তুমি একটি সিঙ্গারা খেয়ে দুপুর কাটিয়েছো। আমি না হয় তোমার বন্ধু নই, তোমাকে ছেড়ে চলে এসেছিলাম বলে। এই যে এখন তোমার নামে মেলা হয়, তোমার চেনা এক আমিই বোধ হয় অনুপস্থিত থাকি মেলায়। যারা এখন রুদ্র রুদ্র বলে মাতম করে বুঝিনা তারা তখন কোথায় ছিলো?
:
শেষদিকে তুমি শিমুল নামের এক মেয়েকে ভালোবাসতে। বিয়ের কথাও হচ্ছিলো। আমাকে শিমুলের সব গল্প একদিন করলে। শুনে … তুমি বোঝোনি আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো। এই ভেবে যে, তুমি কি অনায়াসে প্রেম করছো! তার গল্প শোনাচ্ছো ! ঠিক এইরকম অনুভব একসময় আমার জন্য ছিলো তোমার! আজ আরেকজনের জন্য তোমার অস্থিরতা। নির্ঘুম রাত কাটাবার গল্প শুনে আমার কান্না পায় না বলো? তুমি শিমুলকে নিয়ে কি কি কবিতা লিখলে তা দিব্যি বলে গেলে! আমাকে আবার জিজ্ঞেসও করলে, কেমন হয়েছে। আমি বললাম, খুব ভালো। শিমুল মেয়েটিকে আমি কোনোদিন দেখিনি, তুমি তাকে ভালোবাসো, যখন নিজেই বললে, তখন আমার কষ্টটাকে বুঝতে দেইনি। তোমাকে ছেড়ে চলে গেছি ঠিকই কিন্তু আর কাউকে ভালোবাসতে পারিনি। ভালোবাসা যে যাকে তাকে বিলোবার জিনিস নয়।
:
আকাশের সঙ্গে কতো কথা হয় রোজ! কষ্টের কথা, সুখের কথা। একদিন আকাশভরা জোত্স্নায় গা ভেসে যাচ্ছিলো আমাদের। তুমি দু চারটি কষ্টের কথা বলে নিজের লেখা একটি গান শুনিয়েছিলে। “ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি দিও”। মংলায় বসে গানটি লিখেছিলে। মনে মনে তুমি কার চিঠি চেয়েছিলে? আমার? নেলী খালার? শিমুলের? অনেক দিন ইচ্ছে তোমাকে একটা চিঠি লিখি। একটা সময় ছিলো তোমাকে প্রতিদিন চিঠি লিখতাম। তুমিও লিখতে প্রতিদিন। সেবার আরমানিটোলার বাড়িতে বসে দিলে আকাশের ঠিকানা। তুমি পাবে তো এই চিঠি? জীবন এবং জগতের তৃষ্ণা তো মানুষের কখনো মেটে না, তবু মানুষ আর বাঁচে ক’দিন বলো? দিন তো ফুরোয়। আমার কি দিন ফুরোচ্ছে না? তুমি ভালো থেকো। আমি ভালো নেই।

ইতি, সকাল
:
চিঠি পড়া শেষ হওয়ার আগেই কণকপ্রভা ঘুমে ঢলে পরে আমার কাধে। আমি কণকপ্রভার মাথা আমার কাধে রেখে আকাশ আর মেঘেদের আকাশবনে লুকোচুরি দেখতে চেষ্টা করি। ভরা পূর্ণিমার চাঁদ পশ্চিমাকাশে তখন ডুবতে বসেছে। পূবাকাশে রক্তিমাভা। কুয়াশায় ভিজে গেছে আমাদের দুজনের শরীর। আমি কি করবো বুঝতে পারিনা!



লেখাটি ফেসবুকে দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যান প্লিজ




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন