রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

আমার পথ চলা, জীবন দহন আর আনন্দের সাতকাহন ! পর্ব : ৩ [কাব্যিক গল্পমালা সিরিজ] গল্প # ৪৫



একটা বিষয়ে জানতে চাইলাম তার কাছে, পতেঙ্গার একদম শেষ সিমায় (মানে যেখানে কর্ণফুলি শেষ) একাত্তরে শহীদ সোভিয়েত সৈনিকদের যে “স্মৃতিসৌধ” আছে তা সে দেখেছে কিনা? সে জানালো এ বিষয়ে কিছুই জানেনা সে, আর ঐ শেষ পয়েন্টে এখন নৌবাহিনীর লোকেরা সাধারণ পাবলিককে যেতেও দেয়না, নিরাপত্তার জন্যে আটকে দিয়েছে দেয়াল করে। তবে তার বহুল পরিচিত এলাকা বিধায়, সে জানে ভাঙা ওয়ালের ফাঁক দিয়ে কিভাবে ওখানে যেতে হয়, তারা বন্ধুরা দল বেঁধে অনেকবার সেখানে গিয়েছে কিন্তু না জানার কারণে ঐ ধরণের স্মৃতিস্তম্ভ তাদের চোখে পড়েনি কখনো।
:
এবারো তার বুদ্ধিমত্তায় পুলকিত হই আমি। সত্যিই সে আমায় একটা বিশেষ ভাঙা দেয়ালের পথ দিয়ে কাঙ্খিত পয়েন্টে নিয়ে গেল। ভদ্র পোশাকের কারণে কেউ আমাদের কিছু জানতে চাইলো না বা আটকালো না পথ। কিন্তু নানা খোঁজাখুঁজির পরও আমার ইতোপূর্বে দেখা মৃত সোভিয়েত সৈনিকদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিশৌধটি খুঁজে পেলাম না আমরা। হয়তো কোন কারণে ভেঙে ফেলা হয়েছে কিংবা অন্য কোন কারণে আমরা তার সঠিক লোকেশন খুঁজে পাইনি এবার। অবৈধ অনুপ্রবেশকারি হিসেবে তাড়াতাড়ি ফিরে এলাম বাইরে একাত্তরের যুদ্ধশেষে বঙ্গোপসাগরকে নিরাপদ জলপথ হিসেবে “মাইন সুইপ” করতে গিয়ে বিস্ফোরণে নিহত ৮-সোভিয়েত সৈনিকের স্মরণে নির্মিত মিনার না দেখেই। পাগলাবাবা আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলো বিস্ফোরণের ঘটনাটি। 
:
পাকিস্তানিরা চূড়ান্ত আত্মসমর্পণের আগে আমাদের চট্টগ্রামে বন্দরকে অনিরাপদ করার জন্য অসংখ্য ভাসমান মাইন ছড়িয়ে দেয় বঙ্গোপসাগরে, যাতে দেশটির পোর্টে কোন জাহাজ ঢুকতে না পারে। ১৬-ডিসেম্বরের পর বাংলাদেশের অনুরোধে ক’টি সোভিয়েত যুদ্ধজাহাজ বঙ্গোপসাগরকে মাইনমুক্ত করতে গিয়ে বিস্ফোরণে একটি জাহাজ ডুবে গেলে, ৮-নৌ সেনা নিহত হয় সাগরেই। ৭২-সনে কোন এক পত্রিকায় [নাম না জানা] প্রকাশিত একটি পেপার কাটিং কেটে রেখেছিল আমার মৃত মুক্তিযোদ্ধা বাবা, যাতে তাদের নামগুলো ছিল নিম্নরূপ : [১] Aleksandar Ustanov [Александр], [২] Demyan Andripov [Демьян], [৩] Dimitri Feodor [Димитрий], [৪] Gerasim Istonov [Герасим], [৫] Gennady Lyov [Геннадий], [৬] Lavrenti Yuriy [Лаврентий], [৭] Igor Vladimir [Игорь] এবং [৮] Fyodor Irinei [Фёдор] সম্ভবত তাদের স্মৃতিতেই মূলত পতেঙ্গা কর্নারে এ স্মৃতিশৌধটি নির্মিত হয়েছিল ১৯৭২-সনে।
:
দেখলাম মৃত ভিনদেশি এ সৈনিকদের আত্মত্যাগের কথা শুনে চোখে জল চিকচিক করছে পাগলাবাবার, যাদের জন্ম হয়েছিল প্রাক্তন সোভিয়েতের স্তেপ তৃণভূমি, সাইবেরিয় তুন্দ্রা অঞ্চলে কিংবা ভলগা, কিয়েভ, তুরা, ইস্কটস্ক, লেনা, আমুর, উড়াল বা অন্য কোন নদী তীরে ছিল যাদের গাঁ, আর এরাই জীবন দিয়ে গেল অপরিচিত এক জাতির মুক্তির সংগ্রামে। জানিনা তাদের মৃতদেহ আর পাওয়া গিয়েছিল কিনা কিংবা ফেরত গিয়েছিল কিনা প্রাক্তন সোভিয়েত রাশিয়ায় তাদের তমস্ক, নভোসিভিরস্ক, ভরখয়ানস্ক, সিস্ত্রা বা ভেতলুগা গাঁয়ে। এ সৈনিকদের মায়েরা কি জানে তাদের সন্তানেরা লীন হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের অথৈ সমুদ্রে? এখনো কি তারা প্রতিক্ষা করছে তাদের প্রিয় সন্তান ভ্লাদিমির, ফিউদর, ইগর, আলেকসন্দর, দেমিয়ান, দিমিত্রি, গেরাসিম আর গেন্নাদি লিওভের জন্যে? বাঙালিরা কি এ ঋণ শোধ করেছিল কখনো তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতায়?
:
পঞ্চমুখী স্মৃতিকাতরতা আর কথকতায় পাগলাবাবার সাথে সারা বিকেল আর সন্ধ্যা কাটলো আমার আনন্দ আর বর্ণিত স্মৃতির কষ্টের নিগড়ে। নানাবিধ আধুনিক চিন্তনে, বুদ্ধির প্রখরতায়, দেশপ্রেমের ঝলকানিতে, আর প্রকৃতি প্রেমে একদিনেই নিবিড় ঘন বন্ধুত্ব হলো অসম বয়সি দু’প্রান্তের দু-মানুষের।




লেখাটি ফেসবুকে দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যান প্লিজ


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন