শুক্রবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

একুশ শতকের নারীবাদী কপালকুণ্ডলার শেষ কর্ম (বঙ্কিমচন্দ্রের মূল কপালকুণ্ডলার শেষাংশ ----) [ ছোটগল্প # ১৮ ]





একুশ শতকের নারীবাদী কপালকুণ্ডলার শেষ কর্ম
বঙ্কিমচন্দ্রের মূল কপালকুণ্ডলার শেষাংশ ----

"এইরূপ উচ্চ শব্দ করিয়া নবকুমার কপালকুণ্ডলাকে হৃদয়ে ধারণ করিতে বাহু প্রসারণ করিলেন। কপালকুণ্ডলাকে আর পাইলেন না। চৈত্রবায়ু তাড়িত এক বিশাল তরঙ্গ আসিয়া, তীরে যথায় কপালকুণ্ডলা দাঁড়াইয়া, তথায় তটাধোভাগে প্রহত হইল; অমনি তটমৃত্তিকাখণ্ড কপালকুণ্ডলা সহিত ঘোর রবে নদী প্রবাহমধ্যে ভগ্ন হইয়া পড়িল। নবকুমার তীরভঙ্গের শব্দ শুনিলেন, কপালকুণ্ডলা অন্তর্হিত হইল দেখিলেন। অমনি তৎপশ্চাৎ লম্ফ দিয়া জলে পড়িলেন। নবকুমার সন্তরণে নিতান্ত অক্ষম ছিলেন না। কিছুক্ষণ সাঁতার দিয়া কপালকুণ্ডলার অণ্বেষণ করিতে লাগিলেন। তাঁহাকে পাইলেন না, তিনিও উঠিলেন না। সেই অনন্ত গঙ্গা প্রবাহ মধ্যে, বসন্ত বায়ু বিক্ষিপ্ত বীচিমালায় আন্দোলিত হইতে হইতে কপালকুণ্ডলা ও নবকুমার কোথায় গেল?"
এর পরের ঘটনা -------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

একুশ শতকের নারীবাদি কপালকুণ্ডলার শেষ কর্ম
[রক্তস্নাত দ্রোহি পুরুষ রচিত]


আষাঢ়ের বর্ষা আর হিমালয় প্রবাহমান জলমালার প্রচণ্ড উর্মিমাঝে অনেকক্ষণ এদিক সেদিক সাঁতার কাটার পর প্রচণ্ড ঘূর্ণিস্রোতে অবশেষে কপালকুণ্ডলার খোঁজ পেল নবকুমার। ধাবমান জলরাক্ষসের সাথে অন্ধকার নিশিথে প্রচণ্ড যু্দ্ধশেষে সে কপালকুণ্ডলাকে নিয়ে তীরে উঠলো জলজ জ্বলন্ত আত্মার শপথে। এরই মাঝে চেতনাহীন মৃতপ্রায় কপালকুণ্ডলার মুখে মুখ লাগিয়ে ফুসফুসে অক্সিজেন পাঠিয়ে, বুকে আর পেটে চাপ দিয়ে প্রথম শ্বাস ফিরিয়ে আনলো তার। নিরাভরণ কপালকুণ্ডলাকে বালুময় সমুদ্রতটে সূর্যস্নান করিয়ে দুপুরের মধ্যেই প্রায় সুস্থ্য করে তুললো নবকুমার। রাতের ঝলসে যাওয়া কান্না দুপুরের সূর্যালোকেও দুমড়াতে থাকে কপালকুণ্ডলার বুক। মহাকালের দেঁহাতি পথচলা প্রচণ্ড ভ্যাপসা গরমের মত লাগে তার কাছে। কপালকুণ্ডলা ভালোবাসার নকশিকাঁথা ছুড়ে ফেলে দেয় ক্ষণকালেই। জীবনের নিঃসঙ্গতা তাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করতেই থাকে, অবসাদ আর মৃত্যুর দিকে ধাবমান সে এখন।

এই সেই বালুতট যেখানে বিসর্জিত হয়েছিল নবকুমার, আর এখানেই দেখা মিলেছিল প্রথম কপালকুণ্ডলার। চারদিক নিরীক্ষণ করে অনেকক্ষণ পরষ্পরের দিক নিষ্পলক তাকানোর পর কপালকুণ্ডলার মুখে ক্ষোভ আর জিঘাংসার চিহ্ন ফুটে ওঠে সুষ্পষ্ট। নবকুমারের হাত এক ঝটকায় ছাড়িয়ে কপালকুণ্ডলা দৃঢ়চিত্তে উঠে দাঁড়ায় বালুতটে, সরোষে বজ্রনিনাদে ধ্বনি তোলে- “অবশ্যই বলিদান হবে মার পদতলে হোম, বলি আর শ্মশানভূমিস্থলে”।

অমৃতভাষিণি কপালকৃণ্ডলা নিমিষে রুদ্র মূর্তিতে দৃঢ়পদে ত্রস্তে শ্মশানস্থলে আগাতে থাকলে, আতঙ্কে নবকুমার তাকে অনুসরণ করে দ্রুত। দক্ষিণের বিনম্র ঝাঁঝালো জলের মতো ধেয়ে চলা কপালকুণ্ডলাকে প্রায় দৌঁড়েও ছুঁতে পারেনা নবকুমার।

শ্মশানভূমিস্থলে পূজা, হোম, বলির উপকরণ মাঝে কপালকুণ্ডলার পদশব্দে ত্রস্তে চোখ মেলে কাপালিক। পেছনে নবকুমারকে দেখে তৃপ্তির হাসি ফোটে কাপালিক চেহারায়। আনন্দোচ্ছ্বাসে বলে-

“আইস বৎস, এখনই সূর্যাস্তের প্রাক্কালে বলিদানের উত্তম প্রহর। গঙ্গা থেকে স্নান সমাপন করে এসেছো বিধায়, নব পবিত্রতার দরকার নেই তোমাদের। তুমি বলিস্থলে কপালকুণ্ডলাকে স্থাপন করো, আমি দ্রুতই কার্যাদি সম্পন্ন করিতেছি”।

কাপালিকের কথা শেষ না হতেই, অনুক্ষণ ক্ষত-বিক্ষত কপালকুণ্ডলা দ্রুত হস্তে বলিস্থল হতে কৃপাণ তুলে কালবিলম্ব না করে “যা তোর রক্তেই মার পা ধুইয়ে দিলাম” মন্ত্র উচ্চারণে সরাসরি কৃপাণ হানে কাপালিকের কাঁধে। মুহূর্তে কাপালিকের মস্তক দেহ হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পদদলে গড়িয়ে পড়ে দেবি-মার। কাপালিকেরই রক্তে দেবির পদতল রঞ্জিত হয়ে বলিপিঠ স্নাত হয় ক্ষণকালেই। কাপালিকের মৃত্যু নিনাদ আর মুহূর্তের এ বীভৎসতায় আঁতকে ওঠে কোমলহৃদয় নবকুমার। সহস্রাব্দের এ যজ্ঞ নিষ্ঠুরতার ধারাবাহিকতায় কালিমূর্তিরূপি কপালকুণ্ডলা মুর্হূতে নবকুমারের উদ্দেশ্যে কৃপাণ ঘুরিয়ে বলে, “স্বামি ব্রাক্ষণ শোনিতে তুমিও আজ স্নাত করো মার পদতল, কাপালিক আর তোমার রক্ত মিশে একাকার হোক মার পদযুগল”। কৃপাণ হাতে কপালকুণ্ডলার অবিরাম জেদের বিচ্ছুরণে ভীতত্রস্ত নবকুমার বাকরহিত হয়েও পাথরস্বরে বলে-

“মৃণ্ময়ী!–কপালকুণ্ডলা! তুমি আমায় বলি দেবে এ বনমাঝে? আমি না তোমার কারণে একদিন প্রাণ ফিরে পেয়েছিলাম কাপালিক আশ্রম থেকে? আমি না প্রবল জলদানব থেকে তোমায় ছিনিয়ে এনেছি আজ এ বালুতটে”?

সভ্যতায় বিন্যস্ত শক্তির মাদকতা লাঞ্ছিত কালিরূপি ভঙ্ককরী কপালকুণ্ডলা মুহূর্ত তাকায় নবকুমারের দিকে, পরমূহূর্তেই রক্তস্নাত কাপালিক নরমুণ্ডের দিকে! স্থির সিন্ধান্ত নিতে পারেনা নষ্ট বীজের ভ্রুণ থেকে সদ্য জেগে ওঠা দ্রোহি কপালকুণ্ডলা। সে কি খড়গ চালাবে নবকুমারের মস্তকে? নাকি ঝাপিয়ে পড়বে বাতাস পাখির অনাগত রুপকথারূপী নবকুমারের বুকে?

গঙ্গাতীরের রাত্রির জলকল্লোলের এ যজ্ঞালয়ে অন্ধকার রাতেও পূবাকাশে বনের ফাঁকে হামাগুড়ি দিয়ে উকি মারে বর্ষার ক্ষীণ চাঁদ। শ্মশানভূমিতে শবভুখ পাখি আর পশুরা কর্ক্কশকণ্ঠে বিকট ধ্বনি তুলেই চলে অবিরাম। মেঘেরাও নির্দিষ্ট জীবনচক্রে ঘুরতে থাকে এ শ্মশানাকাশে। নষ্ট জীবনে বিতৃষ্ণ কপালকুণ্ডলার হৃদয়ে অভিমান ফুটে তা ব্যাকুল নীলে পরাজিত হতে থাকে চক্রাবৃত্তে। জীবনের উন্মোচিত কুহকগুলো ঘনান্ধ রাত্রির বেদনায় ব্যথাতুর করে কপালকুণ্ডলাকে। বিস্ময়ের বিষণ্ণ অসীমে নীলকণ্ঠ বিষ্ণু আর অতিনীল মনসার নীলিমতায় আঁতাতের গন্ধ পায় কপালকুণ্ডলা।

নবকুমার পলকহীন ভয়চিত্তে বোঝতে চেষ্টা করে মৃত্তিকার সাথে মেঘেদের পুনর্বার পত্রমিতালী হবে কি এ গহীন ঘনান্ধকার গঙ্গাতীরের শ্মশানভূমে? খগড় ফেলে কপালকুণ্ডলা কি ফিরে যাবে আত্মমৈথুনে? নগ্ন মেঘেরা কি ছুঁয়ে যাবে কপালকুণ্ডলার নিরাভরণ শরীর? নাকি ঝরা পাতার হাহাকারে আত্মহননে নামবে সে নবকুমার আর নিজেকে? নাকি জীবনের অজস্র মিথ্যের মনভোলানো ঘুঙুরের শব্দে সে নেচে যাবে আজন্ম এ মহাবিশ্বে অপ্রতিরোধ্য এক নারী রূপে?

[ লেখাটি বঙ্কিমচন্দ্রের রোমান্টিক উপন্যাস "কপালকুণ্ডলা"র শেষাংশ হিসেবে লিখিত ]



লেখাটি ফেসবুকে দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যান প্লিজ ! 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন