স্বপ্নধূলিতে
ধুসরিত হয়ে ঝরাপাতা আর নামতে পারেনা ফেরি থেকে। দুর নক্ষত্রের রিণরিণে ব্যথাগুলো
চেপে আমি অচেতন নিত্যকর্মে বলি, “তোমার
স্বামী ডাকছে তোমায়? তার সাথে পরিচয়
করাবে না”?
:
শুক্লা তিথির
জেগে থাকা চাঁদের মত এবার অশ্রু গড়ায় ঝরাপাতার দুগাল বেয়ে। রক্তে ভেসে যাওয়া
শতজন্ম অবদমিত করে বলি, “চোখ
মুছে সামনে আগাও, তোমার
স্বামীকে দেখি”।
:
পোড়খাওয়া চেহারার পঞ্চাশোর্ধ বয়সের এক
পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে ক্রাচ ভর করে। তাকে দেখে আঁতকে উঠি আমি। মুখে বসন্তের দাগ
অনেকটা সিনেমার ওমপুরির মত। ঝরাপাতা এড়িয়ে যেতে চায় আমায়, বলে “আমরা
এখন যাবো, কাছেই আমাদের বাড়ি। তুমি কই যাবে”?
:
বলি, "তোমার হাজবেন্ডের সাথে কথা বলতে চাই"।
ঝরাপাতাই স্বামীর দিকে তাকিলে বলে, "আমার দাদা, বাংলাদেশ
থেকে এসেছে"।
মাথা নিচু করে নমস্কার করেন দুহাত তুলে
স্বামী ভদ্রলোক।
ক্লেদাক্ত চেহারার জীবনের ফাটলে-ফাটলে
ঝড়াপাতার ক্লেদের গান শুনতে পাই আমি।
স্বামীটি বলে, "বেড়াতে এসেছেন আমাদের বাড়ি? টাকা
পয়সা দিয়েছে কিছু ওর বাবা? খুব
খারাপ সময় যাচ্ছে আমাদের। টাকার জন্যে ফোন করেছিলাম তা জানেন"?
কাফনের ঢাকনা খুলে মৃত্যুর কাছে যাওয়ার
মত ঝরাপাতা ক্ষীণকণ্ঠে বলে, "দাদা
এসেছেন অন্য কাজে। বাবার সাথে দেখা হয়নি তার। তুমি যাও তোমার কাজে দাদা। আমরা
যাই"।
ঝরাপাতা চলে যেতে চাইছে আমাকে এড়িয়ে। এ
কষ্টের ব্যাধিবীজ টাটাচ্ছে মননে আমার। বলি, তোমাদের
সাথে নেবেনা তোমাদের বাড়ি? স্বমীটি
তৎক্ষণাৎ বললো,
"কেন
নেব না দাদা চলুন আমাদের সাথে"।
:
ঝরাপাতার অবজ্ঞাকে পেছনে ফেলে ওদের
সহযাত্রী হই গ্রামীণ পায়ে চালানো ভ্যানে চেপে। 'সুগন্ধা' গ্রামে
ওদের বাড়ি। প্রায় ১০কিমি দুর এ ঘাট থেকে। কষ্টকর ঝিকঝিকে কুয়াশার মত কথা কয়ে কয়ে
একই ভ্যানে আমরা ৫ জনে পৌঁছে যাই দুপুরের আগেই এক জীর্ণ ক্ষয়ে যাওয়া বাড়িতে। ঢুকেই
রাতভাঙা জলের সিড়ি বেয়ে ঝরাপাতা আমার আপ্যায়নে ব্যাপৃত হয়। কিন্তু ক্রাচভররত
স্বামীটি অর্থপ্রাপ্তির আশাহীনতায় তার বিরক্তির কথা প্রকাশে কৃপণতা করেনা। আগত
অতিথিকে আপ্যায়নে তার অক্ষমতার কথাও বলে যান অবলীলায়। আমার সাথে থাকা অল্প কিছু
ভারতীয় রুপি হাতে দিয়ে বলি, "যান
আপনি বাজার করে আনুন। আপনার ঘরে থাকবো আমি আজ"।
:
অর্থপ্রাপ্তিতে পুন নমস্কার করে ক্রাচে
ঠকঠক শব্দ তুলে বাড়ি ত্যাগ করেন ঝরাপাতার স্বামী।
:
আমি ঝরাপাতাকে ডেকে তার যুথবদ্ধ
অন্তলীন জীবনের কান্না শুনতে চাই। এবার নিটোল মুক্তো গড়াতে ঝিনুকের দু:খগুলো যেমন
অকথিত থাকে মুক্তোতে, তেমনি
জলবতী টলটলে দু:খমালাগুলো তুলে ধরে ঝরাপাতা ক্রমান্বয়ে রিণরিণে কান্নার ঝংকারে।
ধর্মান্তরিত হওয়ার কথা শুনে কিভাবে তার বাবা-মা তাকে আত্মহত্যর ভয় দেখিছে, কোলকাতার
বড় বাজারের এই কাপড়ের ব্যবসায়ী রজত সাহাকে ৫-লাখ টাকা যৌতুক দিয়ে, বাংলাদেশের
ভৈরবে সকল বরযাত্রীকে কোলকাতা থেকে আসা যাওয়ার ব্যবস্থা করে, মাত্র
৩-দিনে বিয়ের সব কাজ সম্পন্ন করে, আবার
সবাইকে কোলকাতা পাঠিয়ে দিল তার সবিস্তার কাহিনি।
:
প্রথম দিনগুলো তেমন খারাপ ছিল না
ঝরাপাতার, মা বাবার জন্যে সব মেনে নেয় সে। কিন্তু স্বামী রজত ক্রমান্বয়ে
মদাসক্ত হয়ে ব্যবসার পাততাড়ি গুটায়। এক সময় সড়ক দুর্ঘটনায় বছর তিনেক আগে মারাত্মক
আহত হয়ে ৫-মাস হাসপাতালে থাকে। চিকিৎসা ও সংসার চালাতে দোকানটি লাঠে ওঠে
অল্পদিনেই। বাংলাদেশ থেকে ঝরাপাতা বাবাকে বলে ৪-কিস্তিকে অনেক টাকা এনেছে সংসার আর
চিকিৎসার নামে। মধ্যবিত্ত ঝরাপাতার বাবাও এখন আর টাকা পয়সা দিতে চায়না ১৭-বছরের
পুরণো মেয়ে জামাইকে। তা ছাড়া বাংলাদেশেও তারা খুব ভাল নেই এখন। তাই কোলকাতা ছেড়ে
মাস কয়েক আগে রজতের এ পৈত্রিক গ্রামের বাড়িতে চলে এসেছে পুরো পরিবার। সংসারে এখন
অর্থ সংকটটাই মুখ্য। টাকা পেলেই রজত চলে যায় মদের দোকানে।
:
ঝরাপাতার কান্নাকাহিনিতে দিনজ্যোস্নায়
আদিম গোধূলির ম্লানতা ছায় আমার পুরো শরীরে। আহ! দু:খাতুর ফেরারী অতীত ভাঙে আমার
জীবনের জলরঙা সিড়ি! একসাথে পড়তাম আমরা। কত সাবলিল ছিল ঝরাপাতার জীবন। আমি বাংলাদেশ
সরকারে উচ্চপদে জব করছি, ঝরাপাতা
ধর্মীয় কারণে আমাকে না পেয়ে, কালচক্রে
এখন হুগলির সুগগ্ধা গ্রামের অসহায় অচল রজত সাহার স্ত্রী। সেও হয়তো আজ বাংলাদেশে
উচ্চপদে জব করতো কিংবা থাকতো আমার পরিবারে সুখের উঠোনের নিজস্ব আকাশের নীলে। ধর্ম
আমাদের জীবনের সুখগুলো কিভাবে অনিকেত প্রান্তরে ঝড়াপাতার বৃক্ষের কান্না বানালো, তা
ভেবে নিজের জন্য নয়, ঝরাপাতার
জন্যে আমার এ অপরিচিত গ্রামীণ বাড়িতে চির সনাতন প্রত্নদাগে দু:খগুলো জেগে উঠলো
আবার।
:
১৭ বছরের আগের ঢাবির কলাভবনের ঝরাপাতার
সে দিনগুলো খুঁজে ছায়াস্নিগ্ধ ধুসরতার রেপ্লিকা খুজি আমি। কষ্টের বীজ বোনা উত্তরের
বৃষ্টির মত দুখরা একসাথে আঁকড়ে ধরে আমায়। আমি আর থাকতে পারিনা ঝরাপাতার কাছে। এ
মিথ্যেকে জাপটে ধরে প্রচন্ড দ্রোহ করতে ইচ্ছে করে আমার। গহীন অতল জলধির একাকিত্বের
মত আমি উঠতে চাই ঝরাপাতার ঘর থেকে। কিন্তু কষ্টের ছবিরা স্বপ্নের অনুরণে আমাকে
পুরণো দিনের নিটোল প্রেমময়তার আটকে রাখে ওর ঘরে। মনের মানচিত্র আঁকা নীলাভ
প্রেমময়তা এক অঘোর অমাবশ্যার সৃষ্টি করে। জীর্ণ উদ্ভিদকূলের কষ্টের মত দুখগুলো উড়ে
উড়ে আমাকে নিয়ে চলে আকাশ সমুদ্র আর ঘনান্ধকার পাতালরাজ্যে। পসাইডনের মত ক্ষমতারধর
পাতাল দেবতাও আমাকে উদ্ধার করতে পারেনা। প্রচণ্ড এক ঘোরের মাঝে আমি চাঁদ, তারা, জোস্নাস্নাত
জোনাকির আলোতে ঝিঝি পোকার একঘেয়ে ডাক শুনি। বেদনার বৃক্ষময় বটের ঝুড়িরা আমার পুরো
শরীর গ্রাস করে। দু:খ রেখায়নে করুণতার গানের সুর পাল্টে কি করবো ঠিক বুঝতে পারিনা
আমি, ঝরাপাতাকে বলি, "তুমি
কি বাংলাদেশে ফিরে যাবে আমার সাথে? পুরণো
জীবনে"?
:
"সন্তান
আছে আমার। না হলে চলেই যেতাম আমি। তোমার বলতে হতো না"।
:
ঝরাপাতার দুই অবোধ শিশু এসে তার কোলে
ঝাপ দেয়। বলে,
"মা
আমরা কি বাংলাদেশে বেড়াতে যাবো"?
আমার বুকের মাঠের ঢেউদিগন্তে শালিক
নাচে। বলি, "যাবে মা তোমরা আমার সাথে বাংলাদেশে"?
:
শিশুরা মা’র
দিকে তাকায়!
ঝরাপাতা চেয়ে থাকে আমার দিকে পৌরাণিক
ঈশ্বরের ধারাভাষ্যের মত !
:
প্রাচীন গলির বিষন্ন সন্ধ্যার মত
ঝরাপাতা এ্ই প্রথম ডুকরে কেঁদে ওঠে। আমার স্মৃতির স্তবির সিম্ফনিরা হাহাকার করে
বারবার। অনেকক্ষণ পর জীবনের জলকণারা আবার তীর ভাঙে জীবন নদীতে। দৃঢ়তায় বলি, "আগামীর করুণক্লান্ত বৃত্তে বন্দি থাকবো না দুজনা, চলো
এগিয়ে যাই"!
:
ব্যথার উঠোনে জন্মানো শ্যাওলার মত
ঝরাপাতা অপলক তাকিয়ে থাকে সতেরো বছর আগের নাক্ষত্রিক প্রেমিকের দিকে। ঝরাপাতার
চোখে জল ঝরছে!
লেখাটি ফেসবুকে দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যান প্লিজ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন