কণকপ্রভা স্বচ্ছজলে মাছেদের জলকেলি দেখে আনন্দে উদ্বেলিত হয়। এক সময় সুন্দর রিণরিণে গলায় সুর করে গাইতে থাকে-
"তোমায় আমি নিয়ে যাবো মেঘডাকা পাখিদের বাড়ি,
তোকেই চেনাবো মাছরাঙ্গা পাখিদের ঘর;
আকাশ আর নদীদের পথে আড়াআড়ি,
এ’সব আঙিনা ছেড়ে-সূর্যটা নিলে অবসর|
নজরুল আমি নৈ পাখিদের বিহারে আমার;
ছোটোখাটো রবিবাবু জীবনেতে স্মরণিকা ল্যাখে|
ঘরে ফেরা পাখিকুল তাহাদের ঘরেতে আবার
তোমার ঐ চোখ্টাতে পাখিরাই পাখিদের দ্যাখে|
ভাষাটাকে হারিয়ো না, হারিয়ো না তোমার হৃদয়;
মায়েরা বকে না হায় পাখিদের ফেরা দেরি হোলে|
তোমার আর আমাদের বাড়ি নেই, নেই পরিচয়;
আমরাও পাখি হবো, পাখিদের গান নেবো গলে|
জাতিস্মর গানটাকে ভুলবো না, ভুলবো না খেয়ালের গাছ;
মাছেদের চোখে পাখি, পাখিদের দুপুর গড়ায়ে…….;
তোর হাতে সঁপে দেবো মাছেদের আঁশ কি’বা মাছ|
মাছেরাও পাখি হয় মাছেদের সময় মাড়ায়ে|
সময় পারায়ে যাবো, অসময় হবে ঢের বোকা;
সমাজ মাড়ায়ে যাবো, বনবাস হবে বোকা ঢের|
বুদ্ধির ঝুলি থোবে পাখিরা তো ঢের বোকাশোকা!
পাখিতার নীলে ফের পরিচয় হবে আমাদের|
রোদ যাবে বেচে, আর-শুকোবেও ধানের উঠোন;
নচিকেতা পাখি হবে খড়েদের গানে-কবিতায়|
পাখিদের বাড়ি হবে আমাদের সুখগৃহকোণ|
সে’ বিহারে খুঁজে নেবো আমাদের পাখির হৃদয়"।
:
তার কবিতার ছন্দে কিংবা সুরের তন্ত্রীতে সম্ভবত মাছেরা প্রবলভাবে আকৃষ্ট হয় এবং জেলেরা যখন জাল টানে ভাটার আগেই, তাদের চোখ জ্বলজ্বল করে নানা সাইজের রূপোলি ইলিশের ঝাক দেখে। অপয়া কণকপ্রভাকে তারা "সৌভাগ্যর মৎস্য দেবি"রূপে আরো কিছুকাল নৌকোয় থাকতে বলে। কিন্তু নদীতীরের আন্দোলিত ফসলের মাঠ কণকপ্রভাকে ডাকতে থাকে হিমেল বাতাসে।
:
চরের মাঠভরা খেসারির খেতে নীলচে ফুলে মৌমাছিরা গুণগুণ করতে থাকে ক্রমাগত। গমের শিষেরা কণকপ্রভার ছোঁয়ায় জীবনময়তায় হেসে ওঠে বার কয়েক। কৃষকের যত্নে লাগানো রসুন পরিবার হাত বাড়িয়ে দেয় চাঁদের লহমায়। মাচায় ঝুলতে থাকা লাউ আর শশা দেখে কণকপ্রভা সম্ভবত জীবনকে আবার নতুন চিত্রণে চিত্রায়িত করে।
:
আমরা আলোকিত সকাল ছেড়ে দুপুরের আগেই বাড়ি পৌঁছতে হাঁটতে থাকি পঞ্চরূপি ফসলের মাঠ ছেড়ে। নিকটবর্তী গাঁয়ের পরিচিত কৃষাণিরা আমার সাথে এক পরিণত বয়সের চমকপ্রদ সাজপোশাকের আধুনিকা নারী থেকে মুখ টিপে হাসে, কেউ জানতে চাই সম্পর্কের সুঁইসুতো। নদীতীরের নিরাভরণ শিশুরা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে কণকপ্রভার দিকে। কণকপ্রভা ছো্ট ন্যাংটা ছেলেদের নুনু ধরে আদর করে আর খিলখিলে হাসে। শিশুরা পুরুষালি লজ্জায় নদীতে ঝাপ দিয়ে তাদের জননাঙ্গ ঢাকে। আমরা প্রায় শুকিয়ে যাওয়া চিকচিকে বালুময় খাল পার হই হেঁটেই, যেখানে আধুনিক শহরের গাড়িবহরের মত সারিবদ্ধ গ্রামীণ কৃষক আর জেলেদের নানাবিধ নৌকো সাজানো থাকে।
:
বাড়ি পৌঁছুতে বিশাল সুপোরি গাছের বন পেরুতে হয় আমাদের। যে বাগান এখন নদীভাঙনে বিলিন হচ্ছে ক্রমাগত। কিশোরবেলায় এ বাগানে সারাদিন ঘুরে বেড়াতাম আমি। কণকপ্রভাকে বাগানে ঝুলে থাকা বুনো ছোট পেয়ারা পেরে দেই আমি। নদীতীরে লাগানো মিস্টি আলু তুলে দিলে কণকপ্রভা তা ম্যাগডোনালসের উপাদেয় খাবারের চেয়েও সুখকর হিসেবে নদীজলে ধুয়ে খেতে থাকে তা। আমরা বিল, বাগান, খাল পেরিয়ে দুপুরের আগেই আমার পুরণো শৈশবের বাড়িতে পৌঁছে যাই।
লেখাটি ফেসবুকে দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যান প্লিজ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন