রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

প্যাসিফিকে ৩-দিন সমুদ্র-সহবাস ও ডলফিন বন্ধুত্বে স্বাপ্নিক দেশে গমন : পর্ব-২ [ স্বাপ্নিক গল্পসিরিজ : ৩১ ]



দু:স্বপ্নের ভয়ে নির্ঘুম সময় কেটে ঘন্টাখানেক পর চোখ খুললে দেখি, ঐ দুজন মানুষ আমার পাশে দাঁড়িয়ে। ইশারায় তারা তাদের অনুসরণ করতে বলে আমায়। কতক্ষণ চললে চোখে পরে সুন্দর অনুপম সারিতে লাগানো গাছ থেকে কেউ ফল পারছে ,কেউ কুড়োচ্ছে, কেউ জড়ো করছে। সবাইকে ব্যস্ত দেখতে পাই আমি। সব ফল আর সবজি স্তুপিকৃত করে রাখছে তারা। আমার সাথের দুজনও ফল স্তুপ করার কাজে লেগে যায় তখন। ঔৎসুক্য নিয়ে সামনে হেঁটে যাই আমি, দেখি নানান ফসলের ক্ষেত। তাতে যন্ত্রের মত কাজ করছে হরেক বয়সি মানুষ। কেউ চারা লাগাচ্ছে, কেউ জল দিচ্ছে, কেউ ফসল কাটছে, কেউ আগাচ্ছা পরিস্কার করছে এসব। শব্দহীনভাবে কাজ করছে সব নারী-পুরুষ, কেউ তাকাচ্ছে না কারো নিরাভরণ পর্দাহীন শরীরের দিকে, যেন মৃতদের ফসলের বিল পার হচ্ছি আমি ধর্ষণ আর ইভটিজিংমুক্ত শান্ত জনপদ। 
:
মেঠো চলার পথের পাশেই দেখি কলা নিয়ে বসে আজে একজন। দুতিন জনে অনেক পাকা কলা নিয়ে আসলো সেখানে। দুজন দুটো কলা নিয়ে খেতে খেতে চলে গেল আমার পাশ দিয়ে কোন শব্দ না করে।কেউবা হেঁটো গেলো তরমুজ নিয়ে আরো সামনে। এগুতেই দেখি অনেক তরমুজ জড়ো করা হয়েছে অদুরেই। একটা বড় কিছু দিয়ে তা স্লাইজ করে কেটে রাখছে এক নারী। কাছে যেতেই ইশারায় বললো, খাবে? আমি মাথা নেড়ে জানতে চাইলাম, বিক্রি করো? দাম কতো? ডলার চলে এদেশে? আমার পকেটে ইউএস ডলার আছে। হা করে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে তারপর হেসে এক টুকরো দিলো আমার হাতে। ইশারায় বললো আমায় খেতে। জীবনে এতো সুস্বাদু তরমুজ আর খাইনি আমি। ছোলা ফেললে চেহারায় রাগ ভাব আনলো মেয়েছি। উঠে ছোলাটা এনে নিজেই খেলো। আরেক টুকরো চাইলাম তার কাছে। চেহারায় দু:খভাব নিয়ে অনেকগুলো টুকরো দিলো আমার হাতে। ৩-দিন সাগরে ভাসলেও কোমরে ছোট ট্রাভেল ব্যাগ বাঁধা ছিল আমার, যাতে পাসপোর্ট ডলার সবই ছিল যেন দেশে ফিরতে পারি আমি। কোমর থেকে দলাপাকানো ডলার বের করে জানতে চাই, দাম কতো? চোখ বড় করে তরমুজ রক্ষক নারী ইশারায় বলে, এটা কি? বুঝতে পারি তরমুজ বিক্রেতা বোবা, আর ডলার চেনেনা সে। আমার জিন্সপ্যান্ট আর ব্যাগ দেখে ইশারায় বলতে চায়, এটা কেন পরেছি আমি? মানে পোশাক চেনেনা তারা। মনে মনে বলি, ঢাকার রাস্তায় গেলে তুমি বুঝতে নারী পোশাক কাকে বলে? পোশাকের সাথে হিজাবও পরতে হতো তোমায়। তারপরো ধর্ষণের শিকার হতে তুমি, আমার মত কেবল তরমুজ খেয়ে চলে যেত না তোমায় একাকি এভাবে নির্পোশাকে দেখে।
:
হাঁটতে হাঁটতে কখন সৈকতে চলে এসেছি জানিনা আমি। দেখি সূর্য ডুবছে অনন্ত সমুদ্রে। সমুদ্রতীরে বসে ভাবতে থাকি, কি করবো কোথায় যাবো এখন? আপাতত ভয় নেই এ বসতিপূর্ণ দ্বীপে। কিন্তু কেমন মরা মরা লাগে দ্বীপটি, কোন শব্দ নেই, এমনকি পাখির শব্দও নেই। শব্দহীন এমন দ্বীপও আছে পৃথিবীতে? চারদিকে অন্ধকার হলে উঠে দাঁড়াই লোকালয়ে যেতে। দ্বীপের আলো আঁধারির মাঝে একটা মানুষকেও্ আর খুঁজে পাইনা আমি। কারো কোন ঘরবাড়ি, আলো, হাসি-কান্নাহীন অন্ধকারে কিছুক্ষণ ঘুরে আবার সৈকতে ফিরে এতিম মানুষের মত বালুতটে ঘুমোতে।
:
সকালে জেগেই পুরো দ্বীপময় কর্মমুখর মানুষদের দেখতে পাই আমি। দেখি যন্ত্রের মত প্রত্যেকেটি মানুষ কেউ কৃষি, কেউ কুমোর, কেউ মুটে, কেউবা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে বিবিধ জিনিসপত্র এখান থেকে সেখানে। কিন্তু শব্দহীন এ দ্বীপের মানুষ। প্রত্যেকেই কি এক নিজস্ব প্রণোদনায় কাজ করে যাচ্ছে বাঁধাহীন, বাক্যহীন, শব্দহীনভাবে। দেখলাম গাছের ছায়ায় ছোট শিশুদের গাছে চরা, ফল সংগ্রহ, কৃষি কাজ শেখাচ্ছেন অভিজ্ঞ শিক্ষক নানাবিধ প্রায়োগিক উপায়ে। কিন্তু শব্দহীন সবাই। সম্ভবত এ দ্বীপের মানুষের কোন শাব্দিক ভাষা নেই, সব কাজই ইশারায় করে তারা। বড় মোহনীয় আর অর্থবহ সে ইশারা। বেশি স্থুল বা কৃশ, খাটো বা লম্বা মানুষ দেখলাম না। সবাই প্রায় একই রকম উচ্চতা আর স্থাস্থ্যধারী। কোন বিদ্যুৎ, টিভি, সেলফোন কোন কিছুই নেই মানুষের কাছে। নারী পুরুষ সবাই্ অলঙ্কারহীন নিরাভরণ কারো দিকে কেউ তাকাচ্ছেই না, রোবটরা যেমন তাকায়না কেউ কারো দিকে নিজের সমর্পিত কাজ ছাড়া্।
:
আমি সারাদ্বীপে ঘুরে বেড়ালাম দুপুর পর্যন্ত। কেউ তেমন একটা তাকালো না আমার দিকেও। তবে ২/১ জন নারী আমাকে প্যান্ট পরা দেখে মুখ টিকে হেসে চলে গেল পাশ দিয়ে। বুঝলাম দ্বীপে কোন টাকা, মাদ্রাসা, দোকান, ধর্ম, রাজনীতি, উপাসনালয়, কোরান, গীতা, ত্রিপিটক, বাইবেল, নেতা, গণভোট, চাঁদাবাজ, সন্ত্রাস, ধর্ষণ, অপহরণ, ঘুষ, হারাম-হালাল কিছুই নেই তাদের। নিজস্ব চেতনা আর দায়িত্ববোধ থেকে তারা তাদের উপর অর্পিত কাজ করে যাচ্ছে বিরামহীনভাবে। পথ চলা কাঁচা সড়কের পাশে সজ্জিত নানাবিধ প্রাকৃতিক খাবার, তা চাহিদামত খেয়ে নিচ্ছে দ্বীপের মানুষ যখন যার ইচ্ছেমত। হঠাৎ একজন পরে গেল গাছ থেকে। শব্দহীনভাবে পরেও কোন চিৎকার করলো না সে। কেবল আকাশে তীরের মত একটা কিছু নিক্ষেপ করলো পাশের লোকটি। মুহূর্তে দৌঁড়ে এলো ৪-ব্যক্তি। যাদের দুজন নারী, দুজন পুরুষ। চারজনে বিশেষ কায়দায় কাঁধে করে দ্রুত চললো অন্য পথে। আমিও দ্রুত চললাম তাদের পিছুপিছু। বুঝলাম এটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নয়, নারী পুরুষ ভেদাভেদ নেই এখানে। আহারে! তসলিমা নাসরিন এদেশটা যদি দেখতো! সম্ভবত এখানেই থেকে যেতে চাইতো তবে !
:
একটু হেঁটে মাটির গর্তের মতো ঘরে ঢুকলো তারা। নিচে নেমে অভিভূত হলাম আমি। মাটির নিচে মাটি দিয়েই বানানো সুন্দর হাসপাতাল ঘর। সেখানেও ডাক্তার নার্স জাতীয় মানুষ, আর রোগি অনেক দেখলাম। সবাই পোশাকের বদলে কেবল বিশেষ রঙে চেহারাকে রঞ্জিত করেছে। ভেষজ চিকিৎসা সব ওখানে। সদ্য আগত রোগিকেও কি খাওয়ালেন যেন হাসপাতালের লোকজন, হাত পা টানলেন একটু। ৩/৪ মিনিটর মাঝে রোগি উঠে বসলো। দেয়ালে হেলান দিয়ে বসানো হলো তাকে, কিছু একটা খাওয়ানোর পর আমায় চমকিত করে হেঁটে বাইরে চলে গেলো গাছ থেকে পরা রোগি।
:
মাটির নিচে বিশাল জগত এ দ্বীপের মানুষদের। হাসপাতালের পাশেই দেখলাম বুড়ো মানুষদের আবাসস্থল। তারা কেউ বসে নেই, ছোট ছোট নানাবিধ কাজ করছে তারা। একদম অকর্মন্য কাউকেই্ পেলাম না ওখানে। বুড়োদের ঘরের পাশে হাজারো শিশু সাজানো বয়সভেদে, এক রুমে দেখলাম কেবল ঘুমন্ত শিশুদের, যাদের নার্সিং করছে সমসংখ্যক নারী-পুরুষরা। পাশের রুমে হাঁটতে শিখছে এমন শিশুর বাস। এভাবে মাটির নিচে পুরো দ্বীপটাতেই তাদের মাটির ঘরবাড়ি বানানো, ওপরে ক্ষেত খামার বাগান পথ। সম্ভবত সন্ধ্যার পর সবাই এ মাটির ঘরে চলে আসে, তাই গতরাতে কাউকে আর খুঁজে পাইনি আমি। দু:খ জলের ন্যুব্জতা ভেঙে অপেক্ষা করতে থাকি আমি পরবর্তী নাট্যকল্পের চিত্ররূপের !



লেখাটি ফেসবুকে দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যান প্লিজ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন