রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

কনকপ্রভা আর আমার জীবনদহন [ভুটান পর্ব] : ১ [কাব্যিক গল্পমালা সিরিজ-৫] গল্প # ৩৭


দু:খের পর্বান্তর মুছে দিয়ে সমস্ত তুচ্ছতাকে মথিত করে ফেসবুক জগতে সপ্তরঙা বন্ধুর হাত ধরেছি আমি। প্রবাসি বন্ধু কনকপ্রভা আমার দ্বীপগাঁ ঘুরে বনস্পতির সুষমায় অদ্ভুৎ আনন্দে মুখরিত হয়ে ভুটান ঘোরার বায়না তুললো শিল্পিত সুষমায় একদিন। পৃথিবীতে একটাতেই নেশাসক্ত আমি, আর তা প্রবাস ভ্রমণে। অতএব কনকপ্রভার কাছে মিথ্যা অহঙ নিয়ে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারিনা আমি, ভেঙে পড়ি। আশাহীন নিষ্প্রভ জৈ্ষ্ঠের ভেজা বাতাসে আমরা উড়ে চলি পৃথিবীর প্রশান্তির দেশ ভুটানের পথে।
:
বুড়িমারি সিমান্ত পার হয়ে জলপাইগুড়ির চ্যাংড়াবান্দা স্টেশন থেকে উঠে পড়ি ভুটানের কাছাকাছি 'হাসিমারা'র ট্রেনে। 'হাসিমারা' কিংবা 'আলিপুরদুয়ার' থেকে ১০ মিনিটের পথ 'জয়গাঁ' তথা ভুটানের সীমান্তশহর 'ফুল্টসোলিং'। প্রথমে সড়ক পথে আসতে চায়নি কনকপ্রভা বলেছিল, এয়ারে যাবে ভুটানের 'পারো' বিমানবন্দরে Druk Air a। অপেক্ষারত সময়কে ভাগাভাগি করে আমিই মুলত এ পথে নিয়ে আসি তাকে অনেকটা তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে। কিন্তু পথের নানারঙা সৌন্দর্যে মোহিত কনকপ্রভার শব্দময়তার ঝিলিকে পথশ্রান্তিরা উড়ে পালায়। কৃতার্থ হয় সে আমার প্রতি এ পথে তাকে আনার জন্য।
: 
বিকেলের মাঝেই ভুটান গেট পার হয়ে আমরা ইমিগ্রেশনে দাঁড়াই। নির্লোভ ভুটানি অফিসার ১০-মিনিটের মাথায় আমাদের ইচ্ছেনুসারে বিনা পয়সায় ৩০-দিনের অন "এ্যারাইভাল ভিসা" দেয় হাসিমুখে। অনেক দেশ ভ্রমণ করা বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে আমার মনে হয়, পৃথিবীতে সম্ভবত ভুটানিরাই কোনরূপ সন্দেহ সংশয় ছাড়া হাসিমুখে ভিসা দেয় বাংলাদেশিদের। বাঙলাদেশকে ১ম স্বীকৃতিপ্রদানকারি দেশ হিসেবে ভুটানিদের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা অবনত হয় আমার। সম্ভবত এ কারণেই সুইজারল্যান্ডের মত দেশ্ও ভুটানিদের 'অন এ্যারা্ইভাল' ভিসা দেয়, যা দেয়না আমাদের মন্ত্রীদেরও। ৬/৭ ঘন্টার থিম্পুর পাহাড়ি পথে বিকেলে সাধারণত কোন ট্যাক্সি চলেনা, তাই ভিসা লাগানোর পরও আমরা খোলা ভুটান গেট দিয়ে রাত যাপনের জন্যে ফিরে আসি ভারতীয় শহর 'জয়গাঁতে'। কারণ জয়গার হোটেল-খাবার সব ভুটানের চেয়ে কিছুটা সস্তা, প্রায় ১০% তো হবেই।
:
পরদিন ভোরের নাস্তা সেরেই ৮০০ রুপিতে রিজার্ভ ট্যাক্সি নেই রাজধানী থিম্পুর। ৬/৭ ঘন্টার জটিল পাহাড়ি পথে মাত্র ৮০০ ভারতীয় রুপি কমই মনে হয় আমার কাছে। বাঙলাদেশে এ পথ ২-৩ হাজার টাকার কমে যেত বলে মনে হয়না আমার। পথে অসংখ্য ঝর্ণা, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, পাহাড়ি পথে মনের গুল্মলতাগুলো ঘেরা অুনপম স্নিগ্ধ ভুটানি বাড়ি দেখতে দেখতে আমরা এগুতে থাকি রাজধানীর দিকে। আলোকিত সময় এক ঝাক কালো মেঘ উড়ে এসে পুরো পথকে রাতের মত অন্ধকার করে দেয়। অমোঘ মেঘের জলবাতাসে আমরা পুরোপুরি ভিজে একাকার হই। গাড়িগুলো অনিরাপদ পাহাড়ি পথে দাঁড়িয়ে প্রহর গুণতে থাকে সুবর্ণ সময়ের। আমাদের চুল ছুঁয়ে একঝাক বুনো পাখি প্রবল রব তুলে পশ্চিমাকাশে হারিয়ে যায়। ভেসে চলা বুনো পাখিদের সঞ্চারণে আলোড়িত হয় কনকপ্রভা। মোহময়তা, স্নিগ্ধতা আর জীবন দহনের ক্ষোভে এক সহজ উপস্থাপনায় গেয়ে ওঠে আমার প্রিয় লোপামুদ্রা মিত্রের সকরুণ গান-




”পশ্চিমের ঐ পাখিরা সব কোথায় গেছে চলে/গেছে কোথায় সাইবেরিয়ায়/ফিরবে নাকি মানুষ পোড়া বন্ধ হলে/কণ্ঠনীল পাখিরা ছিল এই শহরে সন্ধে বেলায় আকাশ থেকে ফিরতো তার ঘরে ।।/গাছের নিচে পুড়ছে মানুষ দেখা যায় না …/পাখিরা সব কোথায় গেছে চলে/ফিরবে নাকি মানুষ পোড়া বন্ধ হলে … ॥/আকাশ ছিল দরাজ আকাশ ছিল নীল , আজ আকাশে উড়ে কেবল মানুষ লোভী চিল/কতো যে বক পোড়া ধোয়ায় ঘুরে মরেছে কতো যে টিয়া পুড়ে মরেছে/মানুষ পুড়ে যায় মানুষ পুড়ে যায় ।পাখিরা সব কোথায় গেছে চলে/ফিরবে নাকি মানুষ পোড়া বন্ধ হলে … ॥”
:
গুজরাটে মানুষ হত্যার প্রতিবাদে লোপামুদ্রার এ গান অনেকবার শুনেছি আমি। আজ ভুটানের পাহাড়ের গা ঘেসে ধানক্ষেত, আপেল বাগান, মেঘ আর বৃষ্টির জল আর মেঘ উপমায় কনকপ্রভা যেন লোপামুদ্রা হয়ে আমার শোনাতে থাকে এ হৃদ-ভাঙার গান। ঝাপসা অন্ধকারের মাঝেও কনকপ্রভার গান লোপার মতই আমার হৃদ প্রকোষ্ঠে প্রগাঢ়তা তুলে বিরতিহীন ঠোকর দিতেই থাকে। কনকপ্রভার পশ্চিম দিগন্তে হৃদস্পন্দন উড়িয়ে দিয়ে লোপার “পশ্চিমের ঐ পাখিরা সব কোথায় গেছে চলে/গেছে কোথায় সাইবেরিয়ায়/ফিরবে নাকি মানুষ পোড়া বন্ধ হলে” গাইতেই থাকে। আমি বুঝতে পারিনা আমার ফেসুবক বন্ধু কনকপ্রভা আজ ভুটানের এ পাহাড়ি পথে যে গান গা্ইছে, তা কি গুজরাটের পোড়া মানুষের জন্যে, নাকি বাংলাদেশে পোড়া মানুষের জন্যে!


লেখাটি ফেসবুকে দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যান প্লিজ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন