রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

হাওড়া বোম্বে মেলের ওম আর তার মা-হারা মেয়ের কান্না কাহিনি [ গল্প # ৫০ ]



মুম্বাই থেকে কোলকাতা 'জ্ঞানেস্বরি এক্সপ্রেস' ট্রেনে প্রায় ৩৭ ঘন্টার ট্রেন জার্নি। তাপানুকুল কামড়াতে টিকেট করেও কেবল জানালা খুলে চলমান পথ নদী মানুষ আর আকাশকে দেখার লোভে নিজ সিট ফেলে মাঝবয়েসি এক বিহারের লোকের পাশে বসি। হিন্দিতে গল্প করি তার সাথে অনেক গল্প। বাংলাদেশে আটকে পরা বিহারের হিন্দিভাষি মানুষদের কথা বলি তাকে। এক সময় তার পরিচয় দেয় সে, গরিব রাজপুত 'ওম' নাম তার। মা মরা ২-মেয়েকে নিয়ে থাকে কোলকাতা থেকে ২০কিমি দূরত্বে রিষড়াতে। বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছে ৩-মাস আগে মুম্বাইতে এক রাজপুত ছেলের কাছে। ছোট মেয়ের বয়স ১০/১১, তাকে নিয়েই থাকে সে কোলকাতার অদুরে এখন, কাজ করে একটা টেক্সটাইল মিলে।

যাওয়ার আগে বোনকে দেখতে যেতে চেয়েছিল বাবার সাথে ছোট মেয়ে রত্নাও। কিন্তু আসা-যাওয়ায় প্রায় ১৫০০ টাকার ট্রেনভাড়ার কারণে মেয়ে ছাড়াই একা গেল 'ওম' বোম্বেতে। ছোট মেয়েকে অনেক বুঝিয়ে পাশের বাসায় রেখে গেছে ৩-দিনের জন্যে। এখন আবার তার একমাত্র কাজ চাকুরি করে ৩/৪ লাখ টাকা সঞ্চয় করা, যা দিয়ে রাজপুত রীতি অনুসারে ছোট মেয়েকে বিয়ে দিতে পারে সে। প্রেম বা অন্য বর্ণে বিয়ে স্বীকৃত নয় রাজপুত রীতিতে। বড় মেয়েকে বিয়ে দিতে ৪-লাখ খরচ হয়েছে তার, ধার করেছে ১ লাখ।

এমন পিতার বর্ণনায় আপ্লুত হই আমি। মেয়ে রত্নার জন্যে সাথে থাকা বিস্কুট, আপেল আর পিয়ারস দিয়ে দেই ক'টা। আপত্তি করেও রাজপুত বাবা সম্ভবত 'মেয়ের টানে' আমার উপহার গ্রহণ করে। এক ফেসবুক বন্ধু থাকে রিষড়ায়। তাকে ফোন দেই ট্রেন থেকেই। পরদিন প্রোগ্রাম করি দুপুরে দেখা করবো তার সাথে। কোলকাতা অনেক জরুরি কাজ থাকার পরও হাওড়া থেকে ট্রেন ধরে পরদিন যাই রিষড়ায়। ফোন দেই ওমকে, এক সময় কিছু ফল,চকলেট, চিপস কিনে হাজির হই ওমের টালির ভাড়াটে ঘরে। বাবা মেয়ের ছোট্ট সংসার আর মেয়েটার শুকনো ম্লান মুখ দেখে চোখে জল আসে আমার! 

পৃথিবীর সর্বত্র বহতা নদীর মত এই যে জীবন, এ জীবনবোধেই আমাদের বৈশ্বিক মানবিক রূপ দান করে। এখানে ধর্ম বর্ণের উর্ধে মানুষরূপে আমাদের সামনে চলে আসে "মানুষ আর তার মানবিকতা"। কোলকাতা ফিরে আসার জন্যে বর্ধমান লোকালে উঠে পড়ি রিষড়া থেকে, কিন্তু চলমান ট্রেনের ঝিকঝিক শব্দ আর হৃদ কাঁপানো প্রচন্ড হুইসেলেও আমি ওম আর তার মা মরা মেয়ের ট্রাজিক মুখ দেখতে থাকি ষ্পষ্ট অনেকক্ষণ। হাওড়া স্টেশনে পৌঁছার আগ পর্যন্ত আমার মননে এ কবিতা বাজতেই থাকে ----

"আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষগুলো অন্যরকম,
হাঁটতে পারে, বসতে পারে, এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যায়,
মানুষগুলো অন্যরকম, সাপে কাটলে দৌড়ে পালায় ।

আমি হয়তো মানুষ নই, সারাটা দিন দাঁড়িয়ে থাকি,
গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকি।
সাপে কাটলে টের পাই না, সিনেমা দেখে গান গাই না,
অনেকদিন বরফমাখা জল খাই না ।
কী করে তাও বেঁচে থাকছি, ছবি আঁকছি,
সকালবেলা, দুপুরবেলা অবাক করে
সারাটা দিন বেঁচেই আছি আমার মতে । অবাক লাগে ।

আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষ হলে জুতো থাকতো,
বাড়ি থাকতো, ঘর থাকতো,
রাত্রিবেলায় ঘরের মধ্যে নারী থাকতো,
পেটের পটে আমার কালো শিশু আঁকতো ।

আমি হয়তো মানুষ নই,
মানুষ হলে আকাশ দেখে হাসবো কেন ?
মানুষগুলো অন্যরকম, হাত থাকবে,
নাক থাকবে, তোমার মতো চোখ থাকবে,
নিকেলমাখা কী সুন্দর চোখ থাকবে
ভালোবাসার কথা দিলেই কথা রাখবে ।

মানুষ হলে উরুর মধ্যে দাগ থাকতো ,
বাবা থাকতো, বোন থাকতো,
ভালোবাসার লোক থাকতো,
হঠাৎ করে মরে যাবার ভয় থাকতো ।

আমি হয়তো মানুষ নই,
মানুষ হলে তোমাকে নিয়ে কবিতা লেখা
আর হতো না, তোমাকে ছাড়া সারাটা রাত
বেঁচে থাকাটা আর হতো না ।

মানুষগুলো সাপে কাটলে দৌড়ে পালায়;
অথচ আমি সাপ দেখলে এগিয়ে যাই,
অবহেলায় মানুষ ভেবে জাপটে ধরি" ।




লেখাটি ফেসবুকে দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যান প্লিজ



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন