শুক্রবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

স্বর্ণপ্রভা ইতু আর একটা ঝাউগাছের গল্প [ছোটগল্প # ১৯ ]


[প্রকৃতিকে যারা ভালবাসে তাদের প্রতি উত্সর্গকৃত]


স্বর্ণপ্রভা আর ইতু বিয়ে করেছে ভালবেসে। বছর পাঁচেক আগে স্বর্ণপ্রভা যখন ‘পরিবেশ বিজ্ঞানে’র শেষ বর্ষের ছাত্রী, ক্যাম্পাস মলে তখন পরিচয় হয় ‘প্রাণীবিদ্যা’র ছাত্র ইতুর সঙ্গে। সপ্তপদী প্রপঞ্চে দেখতে দেখতে দু’জনের ছাত্রত্ব জীবন শেষ হয়, বন্ধুত্ব রূপান্তরিত হয় সামাজিকতার স্বামী-স্ত্রী হিসেবে। প্রকৃতির সবুজায়ন আর বৈশ্বির ভারসাম্য নিয়ে কাজ করে এমন একটি বিদেশী এনজিও-তে দু’জনেরই চাকুরী হয়ে যায় প্রায় একই সঙ্গে। দু’জনের ইচ্ছেনুসারে রাঙামাটির পাহাড়ঘেরা নদী তীরবর্তী উপজাতীয়দের বৈচিত্র্যময় জীবন ও কর্মের উপর নগরায়ন, শিল্পায়ন আর বৃক্ষের প্রভাব নিয়ে কাজ করে ওরা। ছোট্ট পাহাড়ী নদীর টিলার পাশেই ওদের থাকার জন্যে চমকপ্রদ একটি বাংলো টাইপের বাড়ি বানিয়ে দিয়েছে বর্ণিত সুইডেন ভিত্তিক সংস্থাটি, যাতে সোলার প্যানেলসহ আধুনিক জীবনের প্রায় সব উপকরণই কমবেশী বিদ্যমান। পাহাড়ী ঝর্ণার স্বচ্ছ জলধারা থেকে ছোট সোলার মোটরের সাহায্যে পানি টেনে আনতে সক্ষম ওরা সুইডিস টেকনিকে। ছাদে স্থাপিত ‘ভিএসএফ’ স্যাটেলাইটে ঢাকা ছাড়াও সরাসরি সুইডেনে কথা বলা যায় সংস্থাটির সদর দপ্তরে যে কোন সময়। একই প্রযুক্তিতে ইন্টারনেট চলে নিরবিছিন্ন ভাবে ল্যাপটপ কিংবা ডেস্কটপে প্রচণ্ড গতিতে। 

ছোট ছোট পাহাড়ে বাঁশ-ঘাসের বৃক্ষঘেরা নিরাভরণ ঘরে বসবাসকারী নানা ধর্ম, বর্ণ আর শ্রেণির পাহাড়ী বৃদ্ধ, তরুণী আর শিশুদের সঙ্গে পরিচয় হয় স্বর্ণপ্রভা আর ইতুর। অন্ধকার রাতে ছোট কুঁড়ের বাঁশের বেড়ার ফাঁকের চিকচিকে অনুজ্জ্বল আলো ইতুদের বলে দেয় বনজ মানুষের ঘর-বসতির চিহ্ন। কেউ কেউ ওদেরকে খুব ভালবেসে নিজ কুঁড়েতে আপ্যায়ন করে কখনোবা, প্রকৃতির সঙ্গে থেকে কাজ করতে অনুপ্রাণিত করে, আবার অনেকেই সমতলের বাঙালি পরিচয়ে ঋণাত্মক দৃষ্টি লালন করে ওদের প্রতি, মনে হয় সুযোগ পেলে আক্রমন করবে এই অসাম্প্রদায়িক প্রকৃতি-বান্ধব মানুষ দু’টোর প্রতি। যদিও তারা জানেনা, এই পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য আর মানুষ ও প্রকৃতির অক্ট্রেস্ট্রায় কিভাবে ওদের জীবনে অনুরণন তোলে, ওরা কখনো পার্থক্য বোঝেনা মানুষ হিসেবে সমতল আর পাহাড়ীদের মাঝে। ধর্ম, বর্ণ আর নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের চেয়ে মানুষ আর প্রকৃতির হারমোনিই ইতু-স্বর্ণপ্রভার কাছে সবচেয়ে বড়, যদিও মহাবৈশ্বিক গভীরতর বিচারে অন্য প্রাণিকূল আর মানুষের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য খুঁজে পায়না স্বর্ণপ্রভা ইতু দম্পতি। প্রকৃতিপ্রেম আর মানুষের প্রতি মমত্ববোধই শিক্ষিত আধুনিক এই দম্পতিকে টেনে এনেছে নির্জন আর দুর্গম এ প্রকৃতির কোলে, যেখানে যোগাযোগসহ প্রকৃতির দুর্গমতা তাদের কাছে নিতান্তই তুচ্ছ। এই তুচ্ছতাকে মননে ধারণ করে ওরা মহাঐশ্বর্যময়ী পশ্চিমা ‘ইমিগ্রান্ট ভিসা’ পেয়েও তা ছেড়ে ছুড়ে চলে এসেছে এ সবুজাভ প্রকৃতির কোলে।

সারাদিন কাজ শেষে শ্রান্ত স্বর্ণপ্রভা-ইতু বিকেলে বাংলোর সামনে লনে বসে ছো্ট্ট পাহাড়ী নদী তার বৃক্ষদের সবুজ সমীকরণ দেখে। পাহাড়, টিলা আর বনের গভীরে নানা জাত-প্রজাতির অসাম্প্রদায়িক বৃক্ষ-লতা ওদের একাকীত্বের জীবনকে পূর্ণতা দেয়। মনে হয় মাঘের শীতার্থ এ নির্জন বনে বৃক্ষরাই ওদের কাঙ্খিত স্বজন। যারা বনের গভীরে ওদের হাতছানি দিয়ে ডাকে। পরম মমতায় ছুঁয়ে দিলে পাতা আর ফুল ওদের আলিঙ্গন করে নিবিড়তায় সারা শরীরে।
দেখতে দেখতে ওদের বনরাজ্যে বসবাসের ৫-বছর পূর্ণ হয়। পঞ্চ-বর্ষপূর্তির এ দিনে সন্তানহীন এ স্বাধীন দম্পতি বাংলোতে ওঠার প্রথম দিনকে স্মরণীয় করার মানসে ইতু রোপিত ঝাউ চারাটিকে ছুঁয়ে দেখে প্রায় একই সঙ্গে। ৫-বছরের বৃক্ষটি এখন মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে দীপ্ত তারুণ্যের ভঙ্গিতে। এ ক’বছরে সবুজ পাতায় ঢাকা শাখা-প্রশাখাময় চারাটি এখন অনেকটা পূর্ণ বৃক্ষের রূপ লাভ করতে যাচ্ছে। হয়তো দু’য়েক বছরেই ফুল-ফলে শোভিত করবে চারিদিক। স্বর্ণপ্রভা ইতু প্রত্যহ ছুঁয়ে দেখে তাদের রোপিত প্রথম ভালবাসার গাছটিকে। কখনো তারা হাস্যকর প্রতিযোগিতার নামে বৃক্ষটির পরিচর্যায়। প্রত্যহ বিকেলে ওকে ছুঁয়েই ওরা চায়ের কাপে মুখ দেয়, ওদের চা-পানের সঙ্গী হওয়ার আহবান জানায় প্রগাঢ় আন্তরিকতায়! ওদের হাতের ছাপ আর ষ্পর্শ বৃক্ষটি তার বুকে ধারণ করে রাখে সর্বত্র। মনে হয় ওরা কাছে গেলে বৃক্ষটি তার সূক্ষ্ম ডাল আর লক-লকে সতেজ পাতা দিয়ে ওদের আঁকড়ে ধরতে ধরবে। কে বেশী ভালবাসে ঝাউ গাছটিকে তা নিয়েও ওদের মধ্যে অসম প্রতিযোগিতা হয়, কখনো ক্ষণিক স্থায়ী বিবাদ লাগে গাছটির মালিকানা স্বত্ব ও লৈঙ্গিক চিহ্নিতকরণ নিয়ে!

বনময় নিস্তব্দ নিঝুম রাতে নানা গল্পচ্ছলে ওরা ওদের মৃত্যু নিয়ে অপ্রিয় আলোচনা শুর করে। যুগলের কারো আগে মৃত্যু হলে অন্যে কিভাবে বাঁচবে আর কাটাবে তার একাকিত্বের কাল, তা নিয়ে গভীর দার্শনিক কথাবার্তা চলে দু’জনের মধ্যে গভীর রাত অবধি। কৃত্রিম অথচ কষ্টকর বিবাদ লাগে ওদের মধ্যে কে আগে মরবে হিসেব করে। দু’জনের কেউই মৃত্যু বিষয়ক প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হতে চায়না একে অপরকে হারানোর কষ্ট সইতে পারবে না বলে। 

বিশালকায় ধাবমান মহাবিশ্বের সৃষ্টিশীলতার মাঝে নিতান্তই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ও তুচ্ছ গাঙ্গেয় উপত্যকার দুই প্রান্তিকের বিস্ময়কর এই তরুণ-তরুণী প্রকৃতির মাঝে লীন হতে গিয়ে এক সময় সত্যিই ইতু টুপ করে মারা যায় এক গভীর রাতে স্বর্ণপ্রভাকে একা ফেলে। মৃত্যুর প্রাক্কালে অনুভবের সুতীব্রতায় স্বর্ণপ্রভাকে খোঁচা দিতে ভোলেনা যে, ইতুই আসলে জয়ী হতে যাচ্ছে স্বর্ণপ্রভার আগেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে, যাতে স্বর্ণপ্রভার মৃত্যু কাতরতা আর করুণতা তাকে দেখতে না হয়, বইতে না হয় স্বর্ণপ্রভাহীন একাকিত্বের যন্ত্রণাময় ক্লেদাক্ত জীবনের অসহনীয় ভার!

বয়ে চলা সর্পিল নদী-ধ্বনি আর নাম না জানা বনপাখিদের ক্রন্দসী ডাকের মাঝেই সূর্যোদয়কালে ইতুর লাশকে ঝাউ বৃক্ষের নিচে রেখে নোনা জলে ঝাপসা হওয়া চোখ আর কাঁপা গলায় স্বর্ণপ্রভা ইতুর উদ্দেশ্যে বলতে থাকে, ‘আমাকে তুমি হারাতে পারোনি ইতু, আমি একা হইনি। তুমি না থাকলেও, তোমার স্বরূপ আর প্রতিচ্ছায়ারূপে তুমি রেখে গেছো যে ঝাউ গাছকে, যাকে তুমি নিয়ে যেতে পারোনি তোমার সাথে, এই বৃক্ষকেই তোমার প্রতীক ধরে আমাদের দু’জনের অসমাপ্ত কাজকে এগিয়ে নেব অনন্তর গন্তব্যে! এই গহীন বনে ঐ বৃক্ষকেই আমি আমার ইতু বন্ধু করে রাখবো চিরদিন!’ 

বন-গহীনে সূর্যোদয়ের বিচ্ছুরিত আলোকমালায় স্বর্ণপ্রভা ষ্পষ্ট দেখতে পায় ইতু রোপিত ঝাউগাছ তাকে ডাকছে, যেমন ডাকতো ইতু। ক্লান্ত পায়ে স্বর্ণপ্রভা জড়িতে ধরে ঝাউগাছকে, বৃক্ষ স্বপ্রতিভ হয়, জড়িয়ে ধরে সেও মানুষের মতই কাঁদতে থাকে অশ্রুরুদ্ধে ! তখন আদিম ঝরনার মতো অজস্র ধারায় ফিনকি দেয়া টকটকে লাল রক্তে ভিজে ওঠে বুনো ঘাসেরা পাখিরা আর ক্লান্ত বাতাসেরা। সবাই করুণ অর্কেস্ট্রায় বাজাতে থাকে ফিউনারেলের বন-ভায়োলিন। আর কাঁদতে থাকে ইতুর জন্য, কাঁদে স্বর্ণপ্রভার জন্যে কিন্তু বস্তুবাদি মানুষ কি সে কান্নার অতীন্দ্রিয় ধ্বনি শুনতে পায় কখনো?



লেখাটি ফেসবুকে দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যান প্লিজ !

https://www.facebook.com/photo.php?fbid=1518043418429809&set=a.1381466915420794.1073741828.100006724954459&type=1&theater&notif_t=like


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন