শুক্রবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

ঝরাপাতা দাস আর আমার নাক্ষত্রিক প্রেমের গল্প ! (পর্ব # ১) [ চলার পথের গল্প # ৯ ]




মাঘের কুয়াশা ছেঁড়া হিম বিষণ্ণতার মাঝে খুব সকালে নৈহাটি জংশনে নেমে চুঁচুড়া যাবো গঙ্গা পার হয়ে। ৪-টাকার টিকেট কেটে আলোময় গহীন হৃদয়ে বসে আছি ফেরির গলুইয়ে। ভোরের সন্ধ্যার চিরচেনা গ্রামীণতার মাঝে ফেরি ছেড়ে দেয়ার ঠিক প্রাক-মুহূর্তে মাঝ বয়সি এক নারী দৌঁড়ে এলো ফেরিতে ওঠার শেষলগ্নে। হাতে ধরা তার দুটো অবোধ শিশু। শিশু দুটো কৈশোরের চপলতায় খিলখিলিয়ে লাফ দিয়ে ফেরিতে উঠতে পারলেও, পা রাখার আগেই ফেরিটি পেছনে গঙ্গার দিকে যেতে থাকলে, আতঙ্কে এক ভয়ার্ত আর্তনাদ করে উঠলো অচেনা সিঁদুরপরা নারীটি। আমি প্রকৃতির মনকম্পনে হেসে ওঠা জীবন ছেড়ে, হাত বাড়িয়ে ভয়াতুর নারীটিকে টেনে ধরি ফেরির দিকে। ছেঁড়া নাটাইয়ের ঘুর্ণনের কষ্ট ভুলে রিণরিণে শব্দে হেসে ওঠে নারীটি। দ্বিধান্বিত দ্বীপমালার ঘ্রাণে নিজ সন্তানের হাতে হাত রেখে ফিরে তাকায় টেনে তোলা সহায়তাকারীর দিকে কৃতজ্ঞচিত্তে। আমিও পাথুরে সময়ের অপ্রতুলতা ছেড়ে চোখ রাখি নারীটির চোখে। পৌরাণিক গুহার পাথর পৃথিবীর মানুষেরা যেমন অসহায়তার মাঝে ডুবে যায়, তেমনি আঁতকে উঠি আমি। প্রাচীন প্রেমিকার স্থবিরতা ঝেরে ফেলে তাকিয়ে থাকি আমি ঐ পৌরাণিক নারীর দিকে। নারীটিও তার সন্তানের হাত ছেড়ে পুরণো ভালবাসার খাদখন্দর খুঁজে মরতে থাকে গঙ্গার শীতার্থ বাতাসে। দিগন্ত ঝুঁকে সময় পেরুতে থাকে, গঙ্গার মানবহীন চরের কাশফুলের কান্নার মত আমিই প্রথম কথা বলি, “তুমি ঝরাপাতা দাস না”?
:
জলের যকৃত ফেটে দু:খ বেড়োনোর মতো ঝরাপাতা দাস বলে, “হা, তুমি এখানে? কেমন আছো তুমি”?
:
নৈহাটি ফেরি ছেড়ে দিগন্ত বিস্তৃত কালের নৌকোয় চড়ে বসি আমি। ফিরে যাই ১৭-বছর আগের ঢাকা ভার্সিটির বাঙলা বিভাগের অপরাজেয় বাংলার আমতলায়। যেখানে ঝরাপাতা দাস আর আমি কাটাতাম ভালবাসার স্বপ্ন আবাদে ঘর সাজানোর সপ্তরঙা পরিকল্পক হিসেবে সারাবেলা। লেখালেখি পড়াপড়ির সূত্রে আমাদের ঘনিষ্ঠতা হয় অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের রুমে। ভৈরবের এ ছিপছিপে মেয়েটি পড়ালেখায় পাল্লা দিতো আমার সাথে। স্বপ্ন অস্তিত্বের সমুদ্রে স্নানের মাঝেও আমরা কখনো ভুলতাম না জীবনানন্দ, অমিয়, বিষ্ণুদে কিংবা সুধীন্দ্রনাথকে। ত্রিশোত্তর এ কবিদের কাব্যের জটিলতায়ও আমাদের অভিসারী মনের ভাললাগার আলোতে ঘাটতি পরতো না কখনো। ভালবাসার পাথর পাহাড় গলে কখনো তা বিবাদে রূপ নিতো। আমি এ নৈরাশ্যবাদী নারীর তনুতে তৃষ্ণার আগুন জ্বালাতাম, তাতে তার মনশরীর জ্বলে-জ্বলে একসময় তুলতুলে মোম হয়ে গলে পরতো। নিরাভরণ ঈশ্বরের মত প্রতিনিয়ত দু:খাতুর আমরা নিজেদের স্বপ্নগুলো পাকিয়ে তুললাম অস্থিরলগ্নে জেনেটিক প্রেমের মতো। ধর্মান্ধরা যেমন ঈশ্বরের পায়ুপথে চুমো খায়, আমরাও তেমনি অনন্ত বন্দনার জিয়নকাঠী জ্বালিয়ে রাখতাম দুজনে দুজনার। 
:
বৈদিক ধর্মপরিবারে জন্ম নেয়া এ মেয়েটি মুসলিম পরিবারে কিভাবে আসবে তা চিন্তনে প্রায়শই আমরা সুখহীনতার অতলতার গভীরে ডুব দিতাম। আমার আলহাজ্ব ধর্মভিরু জননীকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সে, বাবা-মাকে রাজি করিয়ে মুসলিম হয়ে মার পুত্রবধু হবে সে, যদিও নিরিশ্বরবাদি ছিলাম আমরা দুজনেই। দেবী স্বরসতিকে পুঁজো না দিয়েও ঈর্ষণীয় ফলাফল করি ভার্সিটিতে আমরা দুজনে। দক্ষিণায়নের হৃদটানে হৃদয় রেখে আমরা খুব কাছাকাছি চলে আসি দুজনার। মাস্টার্সে ভর্তির কদিন আগে ঢাবির হল ছেড়ে নিয়তির পরিজায়ী মেঘেরা যেমন দৌঁড়ে যায় স্বজনাকাশে, তেমনি ঝরাপাতা যায় তার মায়ের কাছে, ধর্মান্তরের কঠিন চ্যালেঞ্জ নিয়ে যেন করুণ বৃক্ষের স্বপ্রাণ ভিক্ষুক হয়ে।
:
জীবন পেন্ডুলামে সময় গড়িয়ে যায় আমাদের। ঝরাপাতা আর ফেরে না ঢাবিতে। ঝরাপাতার স্বপ্নেরা আমার কাছে পালকঝড়া বুড়ো পৃথিবী হয়ে হাঁটতে থাকে ক্যূজো হয়ে। বনান্তরে যেমন খুঁজে মরে কপালকুন্ডলা, তেমনি আমি ভৈরবে খুঁজতে চাই ঝরাপাতাকে আহত দ্রোহী সমুদ্রের নিষ্পলক চাহনি নিয়ে। খরস্রোতা মেঘনার ঘোলাটে ভৈরব জলতলের সপ্তম করতলে ডুবেও আমি ঝরাপাতাকে খুঁজে পাইনা আর। ধর্ম তাকে আমার জীবন থেকে ধুসর প্রান্তের অধীর অস্তিত্বে নিয়ে গেছে। আমাদের ভালবাসার বনজ নীলিমা ছিন্ন করে কোলকাতর বণিক সাহা এক অভালবাসার পুরুষ ঝড়াপাতার কপালে সিঁদুর আর সাতটি পাক দিয়ে ছিনিয়ে নিয়েছে তাকে। পরিযায়ী মেঘের কান্না তার আকাশ সাথী হারানোর বেদনা নিয়ে বৈদিক ঝরাপাতা চলে যায় বৈদিক দেশে বৈদিক স্বামীর নৈকট্যে।
:
দুমাস পরে এ সংবাদ যখন পাই আমি ঝরাপাতার পিত্রালয়ে, শতাব্দীর জেগে ওঠা ঘনসবুজ ভৈরবের ঘাসেরা তখন হলুদাভ হয়। ক্রান্তিগ্রহের শিশু গ্রহাণুরা কাঁদে মহাকাশে আমার দু:খের অব্যক্ততায়। এক আঁধার বিভার ঘিরে ধরে আমায়। আমার পালকের পুষ্পগুলো উড়ে যায় দু:খবাতি হাতে নক্ষত্রের মাঝ দিয়ে দূর মহাকাশে। জীবন নির্মাণের নবম প্রহরে কষ্টের এক সাথে জেগে ওঠাকে এক সময় পদদলিত করি আমি। ঘনকৃষ্ণ দু:খের আঙিনায় আলোর আরাধনা শুরুর প্রাক্কালে লঘু রোদের স্ব্প্নময়তায় হাসে আবার জীবন। ঘাসফুলের অতল সান্নিধ্যে দেখি আবার তারার নাচন। স্বর্গীয় হুরপরিদের আস্তানার প্রেমকে ধিক্কার দিয়ে, বিত্তের ঋজু বন্দনা ভেঙে হৃদয় টানি ক্যারিয়ারের দিকে। আবার জীবনকে পরাতে চাই্ শুভ সকালের শিশিরের মালা। রৌদ্রাঘাতে শিশির ভাঙতে থাকি আমি দুহাতে দুপায়ে দলেদলে। দূরাগত বৃষ্টির একটানা সুরকে জীবনে মিলিয়ে তা ঘষে আগুন বের করি আমি। দু:খ নগ্নতাকে তছনছ করে পৃথিবী আর তার মানুষ দেখতে থাকি ক্রমাগত। হাওরজলে আকাশ আর তারারা কেলি কলে আমার অরণ্যানী জনবসতিতে। আকাশের নক্ষত্রদের সাথে কথা কইতে কইতে দিগন্তের সূর্য ঢলে যায় ৪৫ ডিগ্রিতে। আবার আমার জীবন নদীর চরাচরে শব্দহীন নীলে বৃষ্টিরা ঝরে। মাঝে কখনো ঘুম ভেঙ্গে দু:খ জেগে ওঠে কুয়াশাঘেরা জীবনের দিগন্তপারে। মানুষ আর তার সপ্তপদি পৃথিবী দেখে জলের মতন স্নিগ্ধতা ফিরে পাই আমি। কখনোবা ভালবাসার শব্দ রক্ত ফোঁটা হয়ে ঝরে পড়ে বুকে আমার। সহিষ্ণুতার বর্ণালি হরিৎ ঘিরে তাকে ঠেলে দেই পৃথিবীর নরম পায়ের তলে। আমার প্রপিতামহের শরীরের দাগ আমায় কিষাণ কথকথা শোনায়! কখনোবা ঝড়ো মন কর্ষিত জমির মতো বিপথগামী হতে চায়। তখন হিম মৃত্যুর মতো হতাশাকে চপেটাঘাত করে আমি আনন্দের ফল্গুধারায় হেসে উঠি জীবন ফাল্গুনে। মাঝে মাঝে মন্ত্রচ্যুত কাপালিকের মতো দিকভ্রান্ত হই আমি। আমার হাড়কাঠ তখন নোনারক্তে ভিজে একাকার হয়। বৃক্ষ সারিতলে জমাট অন্ধকার নীলাকাশ ছেড়ে তখন পৃথিবী দেখতে বের হই। সব ছেড়ে আমি তখন বাতাস পাখির অনাগত রূপকথা শুনি। 
:
বধির বিকেলের ঝরে পড়া কষ্টগুলো ভুলতে ক্রমাগত দ্বীপদেশগুলো ঘুরতে থাকি আমি। সতেরো বছর এভাবে সুপ্ত দুঃখ ঘুমোয় আমার পাশে একই বালিশে মাথা দিয়ে। ঝরাপাতাকে মনে পরতো কখনোবা বিস্ময়ের বিষণ্ণ অসীমে। ঢাকা থেকে কোলকাতাতে এলেই মনে হতো হাওড়া কিংবা সল্টলেকে একদিন ঝরাপাতাকে দেখবো কিংবা পাবো একটা চিঠি, এমএমএস বা ইমেইল। অথচ কিছুই এলোনা এ সতেরো বছরে। সিনেমাতে সম্ভবত আসে, বিচ্যুত শব্দের বলিদানে হয়তো বাস্তবতায় নয়। অথচ আজ এ গঙ্গার মাঘের এ হিমেল বাতাস আকষ্মিক চৈত্রের খাঁ খাঁ রৌদ্র হয়ে ঝরাপাতা আর আমাকে দাঁড় করিয়ে দিল আলুথালু আকাশ হাওর জলে। প্রাচীন যুগের পাথুরে গড়া মূর্তির মতো ঝরাপাতা কোন কথাই কইতে পারলোনা আর। ওর অবোধ সন্তানেরা ওর দুহাত ধরে দাঁড়ায় পাশে।

:
শিশিরের হিমঝরা প্রহর আমাদের মাঝে নীল বিষ্ণু আর অতিনীল মনসার দংশন আর তীব্র আঁতাতের গন্ধে ক্লেদান্ত করে! আমি বন্ধুহীন ক্ষয়িষ্ণু ভগ্ন চাঁদের মত ঝরাপাতার ভাঙান্যূজ শরীরের দিকে চেয়ে থাকি অপলক দৃষ্টিতে। ও কিছুই বলতে পারেনা, সম্ভবত ওর জমাট বাঁধা ক্লেদাক্ত কষ্ট চোখকে রক্তবর্ণ করে। আমি চিন্তিত হই এটা ভেবে যে, কষ্ট দহনের ধোয়া অশ্রু হয়ে ওর চোখে দেখছি না কেন? ওকি তবে প্রস্রবণ রক্তকায়া শবদেহ নারী? যার পিণ্ডদানে আলোর কান্নারা কাঁপাকাঁপা রিণরিণে শব্দ তুলবে? গঙ্গার শীতের ধোয়াশায়ও আষাঢ়ের বৃষ্টিঝড়া ট্রাজিক সুর বাজবে? নোঙরছেঁড়া হৃদয়ের কথা ভুলে আমি মৃত প্রেতের মতো ভয়ার্ত স্ব্প্নালোকে চেয়ে থাকি ঝরাপাতার দিকে। 
:
এরই মাঝে বাতাসের পাহারায় স্বনিয়ন্ত্রিত শব্দসন্ত্রাস তোলে চলন্ত ফেরি। বিমূঢ় জীবনের কথকতা না ফুরোতেই প্রচণ্ড ধাক্কা লেগে ফেরিটা ঘাটে লাগে। নবমন্ত্রে পুণ্যতর ধবংসের সাধনা পুনর্বার জেগে ওঠে আমার মননে। আমি এবার একসাথে ঝরাপাতা আর তার দুসন্তানসহ তিনজনকেই ঝাপটে ধরি, যেন তারা টাল সামলাতে না পেরে অকথ্য ক্লান্তিতে গঙ্গার জলে না পরে। পঞ্চনদ উৎস শৃঙ্গ ভেঙে ঊষাকালে জন্মলগ্ন সায়াহ্ন ভাঙার মত অবোধ দুই শিশু একসাথে বলে ওঠে, “মা তাড়াতাড়ি চলো, ঐ দেখ বাবা ইশারায় ডাকছে”!



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন