রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

৯-জন হিন্দু যুবতি মেয়ে ও আমার মায়ের গল্প : পর্ব # ৬ [ চলার পথের সত্যি ঘটনার গল্পসিরিজ : ২৫ ]





প্রায় ১ মাস হোগলা পাতার বনে ৮ তরুণির গরু মহিষের সাথে বসবাসের পর যখন ফিরলাম আমাদের নিজ গাঁয়ে, নদীর ঘাটে যখন ভিড়লো আমাদের প্রথম ছোট জেলেডিঙি এবং পরপর অন্য নৌকোগুলো, প্রবল করতালিতে আকাশ মুখরিত করলো জেলেবউ আর কৃষাণিরা। ৯টি হিন্দু বালিকা, আর তাদের গোপনে আশ্রয় দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা ত্রাণকর্র্তী রাবেয়া মাসিমার জন্যে গ্রামের সকল নারীরা ঘাটে সমবেত হলো এক জলজ প্রাণময়তার টানে। অল্প কজন হিন্দু বয়স্কা নারীর সাথে আমরাও জীবন সঙ্গীতের উলুধ্বনিতে সামিল হলাম। সবার চোখে তখন আনন্দ বেদনার জল আর হৃদয়ে আনন্দ। চরম পুলকে ছোট কিশোরেরা ঝুপ-ঝুপ করে নদীতে ঝাপ দিতে থাকলো। মেঘনার ঘোলাজল আমাদর গায়ে ছিটিতে তারা নিজেদের আনন্দকে ভাগ করতে চাইলো আমাদের সাথে। দীর্ঘ নয় মাসের কষ্টের বটবৃক্ষরা যেন পাখি হয়ে উড়ে গেল আমাদের মন থেকে। মনে হলো আজ স্বাধীনতা যেন মেঘনাপাড়ের এ দ্বীপগ্রামেই। রাবেয়া মাসিমা এবং আমাদের নয় জনকে গ্রামের তরুণ আর কৃষাণিরা কোলে করে নামালো নৌকো থেকে পরম যত্নে। ডিসেম্বরের শুকনো নদীতীরে লাঠিখেলা শুরু করলো গ্রামীণ বয়স্ক লাঠিয়ালরা স্বপ্রণোদিত হয়ে। মাসিমাকে কোলে তুলে নিয়ে গেলো তাদের খেলার মাঠের মধ্যখানে। নাচ না জানা গ্রামীণ বুড়োরা আমাদের ৯-জনকে মাঠের মাঝে নিয়ে শুরু করলো "লাঠিখেলার নাচ", যা দেখার মত ছিল বটে। পৃথিবীর নাচের "মুদ্রাহীন এ বেঢপ" নাচে যে অনাবিলতা ছিল, তা এখনো জ্বলজ্বল করে আমার চোখের সামনে। এক পর্যায়ে বুড়োদের সাথে বুড়িরাও যোগ দিলো ৯ হিন্দু যুবতির সাথে এ "লাঠি নাচে"।
:
আনন্দের আতিশয্যে রাবেয়া মাসিমা ঐ মাঠেই আনালেন তার বাবার বাড়ির প্রদত্ত সখের "লাল গাই" গরুটা। দুধেল ছোট্ট বাছুরসহ তা দিয়ে দিলেন আমাদের ডিঙির ১০ মাঝিকে তখনই। অন্য সব মাঝিদের আমন্ত্রণ জানালেন বিকেলে তার বাড়ির পোড়া ভিটায়। মাসিমার স্বামী ভাইসহ অনেকেই ছিলেন তখন ভারত সীমান্তে মুক্তিযুদ্ধে, তাই তিনি মুক্তির এ আনন্দ ভাগ করতে চাইলেন নিজ ধুলোময় গাঁয়ের্ স্বজনদের সাথে। মানুষ ডেকে তখনই বাবার বাড়ি থেকে আনালেন বড় ষাঁড় আর ৫-মন চাল। সব মাঝিদের আমন্ত্রণ জানালেন তার পোড়া ভিটিতে যেন উৎসব করে আজ সবাই এ ষাঁড়ের মাংস দিয়ে। গায়ের উপস্থিত সব মানুষ দুপুরেই ষাঁড় জবাই করে মাসিমার পো্ড়া ভিটিতে হোগলার চাটাই বিছিয়ে, কলাপাতায় খেলো মুক্তির মহাআনন্দ ভোজ। আমাদের হিন্দু পরিবারগুলোর জন্যে ধরালেন পুকুরের মাছ। আমরা সব নারীরা রান্নার কাজ করলাম, পুরুষরা দিলো কেটে-কুটে। মোটা চালের ভাত আর মাংস-মাছ দিয়ে হলো মুক্তির উৎসব। আমরা চরের "৯-ঘোষ নারী" পাকালাম দুধের খির। ঐ রাতে আমরা আর ঘুমাতে পারলাম না। সারারাত আমাদের কাটাতে হলো মাসিমার পোড়া ভিটায়, সেখানে হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে চললো গ্রামীণ নাচ, গান আর লাঠিখেলা। কী সে আনন্দ, কী সে উৎসব? ঐ উৎসবের রাজা যেন 'মাসিমা' আর আমরা হলাম বৈশ্বিক রাজ্যের ৯-রাজকন্যা, যারা ডানা মেলেছে আজ হাজার বছর ঘুম ভাঙার পর যেন এ দ্বীপরাজ্যে।
:
আজ ৪৩ বছর পর মাসিমার এ সৎ কথন আমাদের কাছে কৃত্রিম সাজানো শান্ত সৌম্য রূপকথার মতো মনে হয়। আমরা অপেক্ষাতুর শিকারি লীলাবতির মত মাসিমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি যেন মৃত মাছ আমরা। গোচরণের দুপুরের পড়ন্ত লালচে রোদে ভেসে যাই বিস্ময়াভিভুত আমরা চারজন। ওদের আধা পাকা ঘরের জানালায় আমার অদেখা শৈশব এসে দাঁড়ায় যেন। এসব কথার পরও মাসিমার স্মৃতির দু:খগুলো পাহাড়ের মত অনড় থাকে তার হৃদপিন্ডে। আমার মায়ের ভালবাসার আগুনের নৌকোয় তখনো পুড়তে থাকে গোচরণের মাসিমা। তার ফেলে আসা নদীবসতির দু:খাতর বেদে নৌকোরা জলকান্না হয়ে হাতরাতে থাকে এ অচেনা দহন। এক কষ্টকর বিদায়ের সুবর্ণরেখায় দাঁড়িয়ে বলি, "মাসিমা আপনি ছাড়া বাকি ৮-নারী এখন কোথায়? শুনেছি তার সবাই কোলকাতা চলে এসেছে? যোগাযোগ আছে আপনার সাথে ঐ ৮ হোগলা পাতার বনের ঘোষ নারীদের"? মূহূর্তে কষ্টের নিস্তব্ধ নগরের এক অনাথ বাসিন্দার মত মাসিমার মুখ ফ্যাকাসে হয়। বাংলাদেশ নামক এক হারানো পিতৃভূমের অন্ধকার ঘরে ঘুমন্ত লাশের সারিঘর ভেসে ওঠে তার চোখে। মাসিমার ৩ সন্তান আর আমি তার ছোট্ট ঘরে সাগর জলে নিজেদের প্রতিবিম্ব দেখি। আমাদের ইচ্ছে পাখিরা ঘুমিয়ে থাকে গোচরণের ছোট্ট ফোকড়ে হোগলা পাতা বনের অনাথ মহিষ শাবক হয়ে !



লেখাটি ফেসবুকে দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যান প্লিজ


https://www.facebook.com/logicalbengali/posts/1696777020556447?notif_t=like

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন