রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

একটা নুতন গাড়ি ও মৃত্যু জেতা ঝড়ো-কাকের 'মা' ডাক ! [ চলার পথের সত্যি ঘটনার গল্পসিরিজ : ২৯ ]


জীবনের নিরানন্দ নিরক্ষ রেখায় দাঁড়িয়ে মনে হলো এক গ্রামীণ মায়ের আঁচল ধরে বড় হয়েছিলাম আমি। সময়ের সপ্তরঙা রঙসূত্র ছেকে দেখি, কি সংগ্রাম সাহসি আর নিখাঁদ ছিল আমার মায়ের ভালবাসা- গাঁয়ের মানুষ আর তার সন্তানদের জন্যে। সুখের গা ছুঁয়ে দু:খের সন্ধ্যারা আমায় বলে, বাংলাদেশের জটিল সামাজিক আর পারিবারিক দ্বান্দ্বিকতা, ধর্মীয় ব্যভিচার, প্রতারণা, চরের লাঠিয়ালতন্ত্র, আর মুক্তিযুদ্ধের মাঝে প্রবল সাহসিকতা নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলেন তোমার মা একাকি। একটা ঘন কুয়াশার অন্ধকারাচ্ছন সমাজ থেকে তার সব সন্তানদের কিভাবে নিয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশের সেরা সব কলেজ-ভার্সিটিতে, তা চিন্ততে বিস্মিত হই আমি পোড়াকাঠের ক্লেদময় স্মৃতির মত। যদিও গ্রামে পড়তাম আমরা ভাঙা একটা স্কুলে, যা ছিল বেতফলের তেতো সাধের মত। ঐ স্কুল ঘরে যেমন বেড়া ছিলনা, তেমনটি অনেক টিচারের গায়ে্ও থাকতো না জামা। আট আহ্নিকের পরাজিত বোধ নিয়ে লজ্জাকরভাবে বেঁচে থাকতেন তারা মৃতের মত। 

সুসুপ্তির ঘুম ভেঙে দেখি মার মৃত্যু হয়েছে আজ অনেক বছর হলো। মন মৃদঙ্গের করুণতার সুরে সুরে দেশভ্রমণ আমার জীবনের চিত্রকল্পকে পাল্টে দিয়েছে বারবার। আমার অন্য স্বজনরা যখন একটা স্থির জীবনে এসে কোটি টাকা বানিয়ে মার্সিডিসে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঢাকার সড়কদ্বীপে, আমার সাকুল্যে পুঁজি তখন ৫৭-টা দেশভ্রমণের অভিজ্ঞতা মাত্র। ভাল পজিশনে জব করে দীর্ঘদিনে একটা গাড়িও কিনতে পারিনি আমি। সরকারি গাড়িতে ভাগে অফিসে যাই, আর ফিরি ঐ সরকারি গাড়িতেই একক পেন্ডুলাম ধরে। ধ্যানমগ্ন জীবনের সপ্তর্ষির কথাকাব্য পাঠে অভিজ্ঞ মা এটা বুঝেই হয়তো ছেড়ে গিয়েছিলেন কিছু জমি নদীর মাঝে। জলদেবতার কৃপায় নদী ভাঙনের অনেক বছর পর মায়ের জমি এখন জাগলো চর হিসেবে। সন্তানদের সবাইকে মা শিক্ষার পুঁজি দিয়ে শহুরে করে গেছেন বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার মাঝে। তাই ভাইবোনের কেউ আর চরের জমির খোঁজ নিতে চায়না ২০১৫ সনের অস্থির বাংলাদেশে। ।এবং সবার ই্চ্ছেতে বিক্রি হলো মার জমি, যাতে আমিও ভাগে পেলাম তার সন্তান হিসেবে একটা গাড়ি কেনার মত অর্থ। অবশেষে মায়ের ছেড়ে যাওয়া জমি বিক্রির টাকায় কদিন আগে কিনলাম একটা কমদামি নতুন গাড়ি। সুপুরির সাঁকো পেরুণোর কষ্টে আমাদের মানুষ করা মা, মৃত্যুর পরও আমার গাড়ির সংস্থান করছেন! কষ্টের ক্ষয়িষ্ণু নির্ঘুম রাতে এমন মার ঘ্রাণে ঘাসফড়িং হয়ে মনোজোৎস্নায় উড়তে থাকি আমি। আহারে কি মার পেটেই না জন্ম আমার! সব সন্তানরা কি এমন যুক্তবর্ণা সুখভরা সমুদ্রকনা মা পান? এমন মার ক্লোন যখন করা যাবে, তখন কি থাকবো আমি পৃথিবীতে? এ চিন্তনে শোকাচ্ছন্ন ঝিঁ ঝিঁ পোকার গান শুনি আমি মার সৃষ্ট হৃদ-পুকুরে। 
:
সন্তানের ফিউচার গাড়ির জন্যেও মারা কিভাবে জলতলে রেখে যান তার পুঁজি, তা চিন্তনে সুখহীন নির্ঘুম রাতেরা প্রতিযোগিতা করে আমার সাথে। এ মারা কেন হারিয়ে যায় তার সন্তানদের এ কষ্টকর বিশ্বে রেখে? এ সন্তানরা কেন ক্লোন করে বের করেনা মৃত মায়েদের। বিজ্ঞান কেন এতো কৃপণ এ মাদের ফিরিয়ে দিতে? মায়ের টাকায় গাড়ি চড়া এ সন্তানরা কি মনে রাখে এসব মাদের তৃষ্ণার্ত মহাকালের প্রগাঢ় ছায়ায়? 
:
আজ অফিস ছিলনা সারাদিন, তাই দাপ্তরিক গণতন্ত্রের কুৎসিত আর কদাকার চেহারা উল্টে গাড়িতে উঠে বসি আমি। মৃত মা প্রদত্ত গাড়ি যখন ড্রাইভ করে যাচ্ছিলাম এয়ারপোর্ট রোড ধরে; তখন সড়কদ্বীপে-ফুটপাথে-ঝুলন্ত ট্রেনে-ওভারব্রিজে সর্বত্র এমন হাজারো মা এসে দাঁড়ায় তার সুখাতুর জীবনের মৃন্ময়ী হাসি হেসে আমার সামনে। আর বলে, কেমন লাগছে আমার প্রদত্ত গাড়িতে ঘুরতে বাবা? আমি তখন ড্রাইভিং সিট ছেঁড়ে মার জলপাইরঙা মৃত্যু শোক খুঁজতে আকাশে ভেসে বেড়াই। আর ঢাকার সর্বত্র ছুটে চলা এমন হাজারো মাকে দেখি, যারা তার সন্তানদের সুখের গাড়ি দিতে ছুটে চলছেন তুরাগ থেকে বুড়িগঙ্গা, আর শীতলক্ষা থেকে পদ্মাময়। ঢাকার আকাশে তখন ইচ্ছেমেঘেরা হাহাকার তোলে আর বলে, তোমরা মা হারোনা এ সন্তানরা কেন ধরে রাখোনা তোমাদের এ মাদের? 
:
জীবন প্রগাঢ়তায় সুন্দরের সিঁথি ছুঁয়ে অসুন্দরেরা পালায় আমার মার শোক দহনে। মা প্রেমের পরিযায়ী অক্ষরেরা পাখা মেলে আমার শৈবাল জলতলে। আষাঢ় ভেজা মৃত্যু জেতা ঝড়ো-কাকেরা জলমগ্ন ঢাকার জারুল গাছে ডেকে ওঠে, 'মা' !


লেখাটি ফেসবুকে দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যান প্লিজ


https://www.facebook.com/logicalbengali/posts/1699824950251654?comment_id=1699834546917361&offset=0&total_comments=2&notif_t=feed_comment

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন