শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

চলার পথের চোখের দহন # ৫৯


পৃথিবীতে যত রকম জার্নি আছে তার মাঝে ট্রেনজার্নি খুবই প্রিয় আমার। তাই বিমান টিকেট ফিরিয়ে দিয়ে আমি ২০০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে চড়ে বসি "জ্ঞানেশ্বরি এক্সপ্রেসে" হাওড়া-থেকে মুম্বাই-পর্যন্ত ৩-দিনের বিরামহিন যাত্রা। কত মানুষ, কত পথ, কত সবুজের মাঠ পেড়িয়ে ট্রেন ছুটে চলে বেঙ্গল, উড়িষ্যা, ঝাড়খন্ড, বিহার, ছত্তিসগড়, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রের নাম জানা না জানা কত স্টেশন ফেলে। আমি বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি কৃষিজমিতে মালকোচা মারা বিহারি নারীদের কাজের গতিতে, সারা মুখ তিলক-চন্দনে ল্যাপ্টানো কেরালা তরুণির হিন্দি আর ইংরেজি কথা শুনে হাসি আটকাতে পারিনা আমি। কৃষাণি যখন তার নিজের বাগানের আপেল আর কাজু বেচতে আসে জানালার ফাঁক দিয়ে আধুনিক ট্রেনে আমি বিস্ময়ে মানুষ আর তার সংগ্রামশীলতায় বিমোহিত হই। এক সময় তারাভরা রাতে ছুটে চলা ঝিকঝিক ট্রেনের শব্দ যখন মহারাষ্ট্রের "বইহাটি-খাজুরাহ-অজন্তা-ইলোরা" স্টেশন ফেলে এগুতে থাকে সামনে, তখন ঘুমহীন রাতে জীবনানন্দ আমার পাশে এসেে বসে তার কবিতা নিয়ে - সে নিজেই যেন প্রকৃতির নিঝুমতার মাঝে আবৃতি করতে থাকে --

"একটি নক্ষত্র আসে; তারপর একা পায়ে চ'লে
ঝাউয়ের কিনার ঘেঁষে হেমন্তের তারাভরা রাতে
সে আসবে মনে হয়; - আমার দুয়ার অন্ধকারে
কখন খুলেছে তার সপ্রতিভ হাতে!
হঠাৎ কখন সন্ধ্যা মেয়েটির হাতের আঘাতে
সকল সমুদ্র সূর্য সত্বর তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাত্রি হতে পারে
সে এসে এগিয়ে দেয়; 
শিয়রে আকাশ দূর দিকে
উজ্জ্বল ও নিরুজ্জ্বল নক্ষত্র গ্রহের আলোড়নে
অঘ্রানের রাত্রি হয়;
এ-রকম হিরন্ময় রাত্রি ইতিহাস ছাড়া আর কিছু রেখেছে কি মনে।

শেষ ট্রাম মুছে গেছে, শেষ শব্দ, কলকাতা এখন
জীবনের জগতের প্রকৃতির অন্তিম নিশীথ;
চারিদিকে ঘর বাড়ি পোড়ো-সাঁকো সমাধির ভিড়;
সে অনেক ক্লান্তি ক্ষয় অবিনশ্বর পথে ফিরে
যেন ঢের মহাসাগরের থেকে এসেছে নারীর
পুরোনো হৃদয় নব নিবিড় শরীরে"।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন