মঙ্গলবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

দলিত নারীর সাথে জীবন দহনের ঈদ যাপন [চলার পথের গল্প # ৬২

 দলিত নারীর সাথে জীবন দহনের ঈদ যাপন
:
কোলকাতা এসেছি গত ১৮ তারিখ প্রাগৈতিহাসিক দু:খগুলো ভুলতে । কথা ছিল মুর্শিদাবাদে ঈদের দিন কাটাবো কিন্তু ফেসবুক বন্ধুর মা মারা গেলেন পরশু হঠাৎ। অন্যজন আবার একইসাথে জন্ডিস আর টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি জটিল অবস্থায়। তাই মানবতার ঝান্ডাটি উড়িয়ে হাজার দুয়ারি এক্সপ্রেেসে বসলাম মুর্শিদাবাদের পথে। বিকেলে ফিরছি লালগোলা এক্সপ্রেসে। প্রায় খালি ট্রেনে আনন্দবাজারে পড়ছিলাম মক্কায় "আল্লাহর মেহমানদের" করুণ মৃত্যুুর খবর। বেলডাঙা থেকে এক অরূপসি নারী তার ৪/৫ বছরের সন্তান নিয়ে পাশে বসলেন আমার। প্রথমে নজর পড়েনি হঠাৎ রিণরিণে কান্নার শব্দ শুনি তাকিয়ে দেখি কাঁদছে ঐ নারী। পাশের সব যাত্রীরা জানতে চাইলো কান্নার কারণ। অনেক কথা বললো নারী, যার মর্মার্থ হচ্ছে স্বামী নামক পুরুষটি নেশাগ্রস্থ অবস্থায় তাকে মারধর করে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। এ পৃথিবীতে ঐ নারীর মা-বাবা, ভাইবোন কেউ নেই। তাই স্বামীর অত্যাচারে ঘর থেকে বের হয়ে ট্রেনে উঠে বসেছে সে শিশুসহ অজানার উদ্দেশ্যে। জানেনা সে কোথায় যাবে।
:
সবাই বোঝালো তাকে স্বামীর ঘরে ফিরে যেতে কিন্তু কিছুতেই যাবেনা সে। পলাশী থেকে বেলডাঙা পর্যন্ত প্রায় সবাই পরিচিতজন। অবশেষে ভয় দেখালো পরিচিত যাত্রীরা কোলকাতা গিয়ে কোথায় উঠবে সে? শিশুসহ বিপদে পড়বে সে নির্ঘাৎ। বার বার রক্তলাল চোখ মুছে অবশেেষে সিস্ধান্ত হলো বেলডাঙার দোকানি "সুব্রত" নিয়ে যাবে তাকে বেলডাঙা। ওঠাবে তার নিজ ঘরে। খবর দিয়ে আনবে স্বামীকে। তারপর মেলানোর চেষ্টা। সব শুনে কি করবো বিদেশী আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। ঢাকা হলে পুলিশ নিয়ে ধরে আনতাম দলিত নারীটির স্বামীটিকে। মামলা ঠুকে দিতাম ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে। কিন্তু এখানে অসহায় অবস্থায় কেবল শুনছি সব কিছু।
:
যাত্রীদের ইচ্ছেতে নারীটিকে নিয়ে নামলো "সুব্রত" কৃষ্ণনগর জংশনে। সে এখন অপমানিত নারীটির ঘর জোড়া দেয়ার চেষ্টা করবে। তাই ফিরে যাবে তারা বেলডাঙাতে ঐ নারী আর সুব্রতর বাড়ি। কিন্তু আমার নিজের সাথে যুদ্ধ শুরু হলো আমার। প্রতারণায় পড়বে নাতো নারীটি? কি করবো এখন? নারীটি কি সামনে এগিয়ে গিয়ে বিপদে পড়বে নাকি পেছনে গিয়ে? কৃষ্ণনগর ছাড়লো আমাদের ট্রেন নারী আর সুব্রতকে রেখে। দু:স্বপ্নের ভয়ে নির্ঘুম রাতের মত কষ্টকর সময় কাটছে আমার।
:
ট্রেন যতই এগুলো থাকে সামনে, বিবর্তিত পৃথিবীর ভূ-গোলকে আমি ঐ নাম না জানা নারীটিকে নিয়ে ভাবতে খাকি ক্রমাগত। মানবিক বিপন্ন বোধের ব্যাকরণে আমি মেলাতে পারিনা কোন সুত্র। অচেনা ঐ নারী আর তার সন্তানের জন্যে ক্ষীণ ভালবাসার প্রেমজ মধুরতা জাগে আমার মনে। আমি যতই অপলক দূর-দিগন্তে চোখ রাখি, ততই হৃদ মননে প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাস হয়ে ঐ নারী আমার সামনে কাঁদতে থাকে। সমগ্র পৃথিবীর প্রাগৈতিহাসিক গল্পগুলোর মাঝে এ নারী এক অনন্য চরিত্রে খেলা করে হৃদ মননে আমার। 
:
ক্রমাগত সন্ধ্যার আঁধারে দমদম জংশনে ঢোকার আগেই ট্রেন দাঁড়িয়ে যায় হঠাৎ। চোখ ঝলসানো আলো জ্বালিয়ে, আর তীব্র হুইসেল বাজিয়ে দ্রুতগামি এক ট্রেন লালগোলা এক্সপ্রেসের পাশ দিয়ে ছুটে আসে আকস্মিক । এক অশরিরী হাত হঠাৎ জানালা দিয়ে আমায়ে টেনে নিয়ে যায় ঐ কালান্তরের ট্রেনে। প্রচন্ড রোষে সব স্টেশন পাস কাটিয়ে ট্রেনটি ছুটতে থাকে বহরমপুরের দিকে। লাইনে দাঁড়ানো সব দুরপাল্লার, এক্সপ্রেস, প্যাসেঞ্জার, লোকাল ট্রনগুলো দ্রুত সরে গিয়ে কালান্তর ট্রেনকে ট্রাক ছেড়ে দেয়। যাত্রীহীন ঐ ট্রেনের ইঞ্জিনরুমে আমি আর ঐ অশরিরী মানুষ কেবল ছুটতে দেখি সমস্ত স্টেশন আর যাত্রী। যেন ট্রেনটি দিকচক্রবালে উড়ে যেতে থাকে যুদ্ধ বিমানের মত। এক সময় পলাশীর কাছে গিয়ে ঐ নারীর পাশাপাশি চলতে থাকে কালান্তর ট্রেন। একইভাবে সে জানালা দিয়ে টেনে আনে শিশুসহ ঐ নারীকে। চালকের আসনে বসায় তাকে। ছুটে চলছে কালান্তর ট্রেন পাশে আমি, শিশু, অশরিরী মানুষ আর নারী। 
:
প্রচণ্ড আলোকময়তায় ষ্পষ্ট দেখি আমি ট্রাকের ওপর একটা মানুষ। মানুষটি ঐ নারীটির স্বামী। তাকে ধরে এনেছে ঐ অশরীরি। নারীটি থামাতে চায় ট্রেনটি। কিন্তু অশরিরী দৃঢ়তায় বলে, চালিয়ে যাও ট্রেন থামালে বিপদ আছে তোমার। এবার চোখের জলরক্ত মুছে নারীটি ট্রেনের গতি আরো দ্রুততর করে। ঝড়োবেগে ট্রেন এগিয়ে যায় নাম না জানা নারীর স্বামীকে দ্বিখন্ডিত করে। তারপরো ট্রেন থামেনা। ঝরাপাতা কুয়াশায় হিম বিষণ্ণতা এড়িয়ে ট্রেন সামনে এগুতেই থাকে। স্বাপ্নিক দৃষ্টিভ্রমে উড়ে চলা ট্রেন যাত্রী হয়ে দু:খের যাপিতকালে ফিরে যেতে চাই আমি। আমার চোখ ঝাপসা হয়। কিছুুই নজরে পরেনা আমার। দু:খ জলের ন্যুব্জতা ভেঙে প্রচণ্ড রোষে কালান্তরের ট্রেন সামনে এগুতেই থাকে। ড্রাইভিং সিটে বসা ঐ দলিত নারী। 
:

https://web.facebook.com/logicalbengali/posts/1709763512591131:0

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন