রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

আমার মা আজো অশ্রুবিন্দু, আকাশলীনায় আমার মা আজো টলমল করে [কাব্যিক গল্পমালা সিরিজ-৩] গল্প # ৩৫


২-৩ দিন যাবত শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। সারাদিন প্রায় ঘরেই কাটাচ্ছি, আজ অফিসের কাজে বেড় হয়েও শরীর আর মন সাথ না দেয়াতে ফিরে এসেছি ঘরে। মন খারাপ হলেই মাকে খুব মনে পড়ে আমার। কারণ আগে মাকে বিষয়টা বললেই সে ভালর একটা "ম্যাডিসিন" দিয়ে দিতো তাক্ষণিকভাবে, তাতে অল্পলেই "অসুখের" অ উড়ে গিয়ে তা সুখের ডালে বসতো। এখন মা নেই বলে দীর্ঘায়িত হচ্ছে "অ-সুখ" নামক অসুখটি। মায়ের সাথে নিবিড় গহিণ বন্ধন ছিল আমার কৈশোর থেকেই, ঐ সময় সারাদিন তার কাপড়ের খুট ধরে থাকতাম আমি। কেবল স্কুলে গেলেই মা খুট মুক্ত হতো আমার থেকে। সম্ভবত মাও বিষয়টি খুব উপভোগ করতেন, তাই হয়তো বড় হওয়ার পরও খুট ধরতে বলতেন আমায়। অন্য কোন নারীর সাথে এমন সখ্যতা আমার আর হয়নি, কেউ বোঝেনি আমায় মা যেমনটি বুঝেছিল। যদিও মা হারানোর পর আমার বোনেরা নানাভাবে চেষ্টা করছে আমার মা হতে। কিন্তু বোনদের খুট কেন যেন ধরতে পারিনি আমি সপ্তপদি অবোধ্য কারণে।

আর তাই বিশ্বের সর্বত্র মাকে খুঁজে ফিরি আমি প্রতিনয়ত। অনেকে বলেন মৃত মায়েরা তারা হয়ে আকাশে থাকেন। কিন্তু নক্ষত্রের গঠন পড়ে মাদের "তারা" মানতে কষ্ট হয় আমার। আমি যখন বিমানে আকাশ ভ্রমণ করি, তখন ব্যোমযানটি খুব শীতার্ত আকাশ মালায় উঠে গেলে অনেক নিচে মেঘমালাকে মাদের জগত মনে হয় আমার। আমার মায়ের মুখ অনেক মেঘমালার মাঝে খুঁজে পাই আমি। কিন্তু রানওয়ে থেকে মেঘমালাকে ছিঁড়ে যখন প্রচণ্ড রোষে বিমানটি উঠতে থাকে উপরে, তখন চোখ বন্ধ করে রুদ্ধশ্বাসে থাকি আমি, মনে হয় মাদের উড়ন্ত শরীরকে ছিন্নছিন্ন করছে সুপরিসর ব্যোমযানগুলো মহাকাশে।

একবার নিউজিল্যান্ড ভ্রমণকালে বিমান আকাশে উড়তে থাকে ক্রমাগত, নীচে ভাসমান সাদা আর গোলাপী মেঘের মাঝে আমি সুষ্পষ্ট দেখতে পাই আমার মাকে। যিনি ককপিটের ফোঁকর দিয়ে দেখতে চা্ইছেন তার সন্তানকে, যে সন্তান সারা জীবন তার আঁচল ধরে থাকতো তার, মৃত্যুর সময় যে সন্তানকে খুঁজেছিল মা কিন্তু দেখতে পায়নি বিদেশ থাকার কারণে। যতক্ষণ পর্যন্ত খ্রাইস্টচার্চে বিমান না নামলো, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি মেঘমালা থেকে চোখ সরালাম না, যে মেঘের মাঝে সাঁতরে বেড়াচ্ছে আমার মা, আরো কতো সন্তানের মা'রা। যারা তাদের সন্তানদের আকাশে খুঁজে ফিরছে অহরহ। মেঘের মাঝে থেকে কে যেন আমায় বললো, তারা উড়ন্ত বিমান দেখলেই মেঘের মাঝ থেকে উড়তে উড়তে খুঁজতে থাকে তাদের সন্তানদের, যেন আশির্বাদ দিতে পারে মৃত্যু পরবর্তী এক অবোধ্য জীবন থেকে, কেবল সুসন্তানের জন্যে ! হয়তো এ কারণেই পৃথিবীর সকল বিপদ থেকে আমার মা আমায় মুক্ত রাখেন অদৃশ্য আর দৃশ্যমান বিপদ থেকে। তাই নানাবিধ জটিল জীবনচক্রেও আমি এ পঙ্কিল পৃথিবীতে বেঁচে আছি। কিন্তু সব সন্তানরা কি এমন মা'দের কাছে যেতে পারে?

মাকে খুঁজতে সাদা গোলাপি সপ্তবর্ণা মেঘের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ আমি মৃত হুমায়ুন আজাদকে দেখতে পাই সুষ্পষ্টরূপে, যিনি মেঘের ভেলায় ভেসে বেড়ানো মাদের শোনাচ্ছেন তাঁর "আমাদের মা" কবিতাটি, যার রেশ এখনো বিমানে উঠলেই আমি শুনি-

"আমাদের মাকে আমরা বলতাম তুমি, বাবাকে আপনি।
আমাদের মা গরিব প্রজার মত দাঁড়াতো বাবার সামনে,
কথা বলতে গিয়ে কখনোই কথা শেষ ক’রে উঠতে পারতোনা।
আমাদের মাকে বাবার সামনে এমন তুচ্ছ দেখাতো যে
মাকে আপনি বলার কথা আমাদের কোনোদিন মনেই হয়নি।

আমাদের মা আমাদের থেকে বড় ছিলো, কিন্তু ছিলো আমাদের সমান।
আমাদের মা ছিলো আমাদের শ্রেনীর, আমাদের বর্ণের, আমাদের গোত্রের।
বাবা ছিলেন অনেকটা আল্লার মতো, তার জ্যোতি দেখলে আমরা সেজদা দিতাম
বাবা ছিলেন অনেকটা সিংহের মতো, তার গর্জনে আমরা কাঁপতে থাকতাম
বাবা ছিলেন অনেকটা আড়িয়াল বিলের প্রচন্ড চিলের মতো, তার ছায়া দেখলেই
মুরগির বাচ্চার মতো আমরা মায়ের ডানার নিচে লুকিয়ে পড়তাম।
ছায়া সরে গেলে আবার বের হয়ে আকাশ দেখতাম।

আমাদের মা ছিলো অশ্রুবিন্দু-দিনরাত টলমল করতো
আমাদের মা ছিলো বনফুলের পাপড়ি;-সারাদিন ঝরে ঝরে পড়তো,
আমাদের মা ছিলো ধানখেত-সোনা হয়ে দিকে দিকে বিছিয়ে থাকতো।
আমাদের মা ছিলো দুধভাত-তিন বেলা আমাদের পাতে ঘন হয়ে থাকতো।
আমাদের মা ছিলো ছোট্ট পুকুর-আমরা তাতে দিনরাত সাঁতার কাটতাম।
আমাদের মার কোনো ব্যক্তিগত জীবন ছিলো কিনা আমরা জানি না।
আমাদের মাকে আমি কখনো বাবার বাহুতে দেখি নি।

আমি জানি না মাকে জড়িয়ে ধরে বাবা কখনো চুমু খেয়েছেন কি না
চুমু খেলে মার ঠোঁট ওরকম শুকনো থাকতো না।
আমরা ছোট ছিলাম, কিন্তু বছর বছর আমরা বড় হতে থাকি,
আমাদের মা বড় ছিলো, কিন্তু বছর বছর মা ছোটো হতে থাকে।
ষষ্ঠ শ্রেনীতে পড়ার সময়ও আমি ভয় পেয়ে মাকে জড়িয়ে ধরতাম।
সপ্তম শ্রেনীতে ওঠার পর ভয় পেয়ে মা একদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে।
আমাদের মা দিন দিন ছোটো হতে থাকে
আমাদের মা দিন দিন ভয় পেতে থাকে।

আমাদের মা আর বনফুলের পাপড়ি নয়, সারাদিন ঝরে ঝরে পড়েনা
আমাদের মা আর ধানখেত নয়, সোনা হয়ে বিছিয়ে থাকে না
আমাদের মা আর দুধভাত নয়, আমরা আর দুধভাত পছন্দ করিনা
আমাদের মা আর ছোট্ট পুকুর নয়, পুকুরে সাঁতার কাটতে আমরা কবে ভুলে গেছি।
কিন্তু আমাদের মা আজো অশ্রুবিন্দু, গ্রাম থেকে নগর পর্যন্ত
আমাদের মা আজো টলমল করে"।


লেখাটি ফেসবুকে দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যান প্লিজ

https://www.facebook.com/logicalbengali/posts/1585971391637011



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন