রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

চীনের উহান সিটির ক্যাথি কং এবং পুরণো একটা ভালবাসার পটের ভাঙা টুকরো ! [ চলার পথের সত্যি ঘটনার গল্পসিরিজ : ২৭ ]




সযত্নে রাখা সিরামিক পট-টা যখন ভেঙে গেল আজ হাত থেকে পরে, তখন বোধ আর বোধির পরতে জমা কষ্টের তুষারগুলো একাকার করলো আমার পথচলাকে। আমি পলকহীন চেয়ে রইলাম ভাঙা টুকরোগুলের দিকে, আর কেয়াবনের হলদে টিয়ার স্বপ্নময়তা জেগে উঠলো আমার হৃদয়ে নিখুঁত পোট্রেটের মত! চীনের উহান শহরের ক্যাথি কংয়ের দেয়া উপহার ছিল এ ভাঙা টুকরোগুলো। ছেঁড়া ছাতার ভেতর রৌদ্র লুকানোর মত ফিরে যাই আমি আমার স্বপ্নদিনের অতীতের উহান সিটিতে, যেখানে বাস করতো ক্যাথি কং। 

:
বর্তমান আমার পেশায় ঢোকার আগে ছোট্ট একটা ব্যবসা ছিল আমার এক আরব পার্টনারের সাথে। আরবরা নর্মালি ভাল হয়না এমন জনশ্রুতি ছিল সর্বত্র। তবে 'মুহাম্মদ আল-শায়ের' নামের এ আরবি লোক-কবির সাথে খুব বন্ধুত্ব হয়েছিল আমার। তায়েফ ভ্রমণে গিয়ে আঙুর বাগানে পরিচয় হয়েছিল এ লোকগানের কবির সাথে। চীনের সাথে ব্যবসা ছিল তার কিন্তু ইংরেজি বুঝতে অক্ষমতার কারণে এক সময় অনুরোধ করলো, আমি যেন তার খরচে তার সাথে একবার চীনে যাই। তাহলে আমাকেও ব্যবসায় নেবে সে তার পার্টনার হিসেবে। দেশভ্রমণ আমার সুখহীন জীবনের অন্যতম অনুসঙ্গ, তাই তার প্রস্তাবে সানন্দে রাজি হই আমি। চীন থেকে সপ্তপদি জিনিসপত্র কেনাকাটার ব্যবসা ছিল তার। ফ্যাক্টরি থেকে বিবিধ জিনিস কিনে সাংহাই বা উহান বন্দরে কন্টেনার শিপমেন্ট করে ফিরে আসতাম আমরা জেদ্দা। সেই সূত্রে দুতিন মাসে অন্তত একবার চীনে যেতে হতো আমাদের দুজনকে। বিবিধ কাজে আটকা পরাতে একবার একাই যেতে হলো আমাকে সেনঝেন শহরে। বিমানে হংকং হয়ে ট্রেনে 'লুউয়ান' স্টেশনে নেমে ট্রলি টেনে হেঁটেই ঢুকলাম চীনের সেনঝেন সিটিতে একা। 
:
চীনের সরকারি 'উহান ইলেকট্রিক গুডস ইমপোর্ট এক্সপোর্ট কর্পোরেশনের' সাথে আমাদের মুল ব্যবসা ছিল। তাই দোভাষি হিসেবে ঐ কর্পোরেশনের 'ক্যাথি কং' নামের মেয়েটি এসেছিল সেনঝেন থেকে আমাকে কর্পোরেশনের ফ্যাক্টরিগুলোতে নিয়ে যেতে। যাতে বাছাই করে জিনিসপত্র অর্ডার দিতে পারি আমি। সারাদিন ক্যাথির সাথে সেনঝেন ঘুরে বিকেলে লোকাল বিমানে উহান যাই আমরা। বাংলাদেশের পদ্মা নদীর মত 'ইয়াংঝু' নদীর তীরে উহান সিটি। ১৮-তলা কপোর্রেশন ভবনে থাকার ব্যবস্থা হলো আমার তাদের আপ্যায়ন আর খরচেই। দোভাষি হিসেবে কাজ করে ক্যাথি, চীনের মানুষেরা ইংরেজি জানেনা তাই, এমনকি বিরাট পদধারীর কেউই। ক্যাথিকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল, একটা নির্দিষ্ট কোটার জিনিসপত্র যেন সে আমার কাছে বিক্রি করে তার নিজ দক্ষতায়। না হলে তাদের কোম্পানীর কোটা অপূর্ণ থাকার কারণে, বেতনসহ প্রবলেম হতে পারে তার অকর্মন্য হিসেবে। তাই ক্যাথি তার খরচে একটা বড় হোটেলে ডিনার করাতে চাইলো আমায়, যেন ডিনারে খুশি হয়ে আমি তার মাধ্যমে বড় অর্ডারের বিবিধ মালপত্র কিনি। 
:
উৎসুক আমি জানলে চাইলাম ক্যাথির বেতন সম্পর্কে। বিস্মিত করে সে জানালো, তার বেতন বাংলাদেশি টাকায় মাত্র ৬০০০ টাকার মত। অথচ ভাল একটা হোটেলে ডিনার করালে অন্তত ৬ হাজার টাকাতো লাগবেই তার, মানে এক মাসের বেতন। কৈশোর অবস্থা থেকেই আমার মায়ের মত মানবিক ছিলাম আমি, তাই তার টাকা বাঁচাতে বললাম, হোটেলে খাবোনা আমি, তোমার ঘরে খাওয়ালে খাবো। কিছুটা বিব্রত হয় সে বললো, আমাদের ঘরতো খুবই গরিবি টাইপের, তাতে নিতে লজ্জিত হচ্ছি আমি বিদেশি কাস্টমারকে। কিন্তু তাকে নানা কথা বলে রাজি করালাম তার ঘরের ডিনারেই।
:
সত্যিই বিষ্মিত হলাম তখনকার চীনের সরকারি বাসস্থান দেখে। ক্যাথির মা, বাবা আর ক্যাথি একসাথে থাকে বলে, তাদের তিনজনকে ফ্লাটবাড়ির একটা ছোট ফ্লাট দেয়া হয়েছে মাত্র। যাতে সাকুল্যে রুম দুটো। একটাতে তার মা-বাবা, অন্যটাতে ক্যাথি থাকে তার ৪-বছরের ছোট মেয়েকে নিয়ে। হ্যাসব্যান্ডের সাথে ডিভোর্স হয়েছে তার কদিন আগে কি কারণে যেন। তাই ক্যাথির বেডরুম কাম ড্রয়িং রুমে বসলাম স্টিলের বিছানায়। যা সবই সরকার প্রদত্ত জৌলুসহীন পুরণো। মা বাবা ছাড়াও পরিত্যাগি জামাইকেও দাওয়াত করলো, আমার সম্মানের ডিনার পার্টিতে। ক্যাথি ছাড়া কারো সাথেই কথা বলতে পারলাম না ভাষাজনিত কারণে। হাঁসের মাংস আর শাকপাতার অনেক জিনিস তৈরি করেছিল ক্যাথির ঘরে। কিন্তু অনাভ্যাসের কারণে সাদা ভাত আর ভাপে সেদ্ধ শাক ছাড়া কিছুই খেতে পারলাম না আমি। 'উ-চি' নামের ক্যাথির ছোট মেয়েটি আমার কোলে উঠে কাঠি দিয়ে খেলো অদ্ভুৎ নিপুণতায়। ভাঙা ডাইটিং টেবিলে বসলাম সকলে।
:
বিদায় প্রাক্কালে কাগজে মোড়ানো একটা চমকপ্রদ উপহার দিলো ক্যাথি আমায়। বিনয়ের সাথে ক্যাথি বললো, খুব কমদামি উপহার। তারপরো যেন বড় অর্থের একটা এলসি করি আমি, নাহলে তার বেতন আটকে যাবে হয়তো। ওর মা বাবাও মাথা নিচু করে আকুতি জানিয়েছিল তার মেয়েকে যেন হেলপ করি আমি। ক্যাথি পরিবারের জীবন ব্যাকরণ-বৃত্তান্তে জল এসেছিল আমার চোখে। চীনের তখনকার দরিদ্র মানুষের কষ্ট এখনো স্পষ্ট ভাসে আমার মননে। কিছু না নিয়ে খালি হাতে গিয়েছিলাম ক্যাথির ঘরে, তার বেবির কথাও জানতাম না আমি, তাই লজ্জিত হয়ে আবার ঘরে ডুকে 'উ-চি'র হাতে ১০০ ডলারের একটা নোট রাখলে, নিজ ভাষায় বারবার তা ফেরত নিতে বলে ক্যাথি আমায়। চোখে জল নিয়ে বলে, ডলার না দিয়ে একটা বড় এলসি যেন করি আমি।
:
রাতে রুমে ফিরে ক্যাথি পরিবারের উপহার দেখে তাদের দু:খের স্বরবর্ণ ব্যঞ্জণবর্ণ বুঝতে কষ্ট হয়না আমার। ইয়াংঝু নদীর নীলুয়া অপরাজিতা বাতাসের কান্নায় আমি ক্যাথির মুখ দেখি বার বার। সারারাত ক্যাথির কথা মনে করে পৌরাণিক হস্তিনাপুরের প্রেমজ ভালবাসা জাগতে থাকে ক্যাথির জন্য। সকালে কাঠবাঁধাই রূপোলি স্লেটে লিখি ক্যাথির অসমাপিত জীবনের গান। ১৮ তলা ভবন ছেড়ে বিকেলে উহানের রাই-সর্ষের রোদমাখা ফসলের মাঠে গিয়ে ক্যাথিকে বলি, বাংলাদেশে যাবে তুমি আমার সাথে? ওখানে স্বাধীন জীবন পাবে, খেজুর রসে ধোয়া মুখ পাবে, বেগুনি জারুল ছায়ার হাতছানি পাবে, বালিহাঁসের ওড়ার শব্দময়তার মাঝে এক নিটোল ভালবাসার জীবন পাবে। আদিম ছাপামেশিনের পেষণ থেকে মুক্তির জন্যে ক্যাথি বলে, হ্যা যাবো কিন্তু আমারতো পাসপোর্ট নেই, কিভাবে যাবো আমি? এখানের বন্দি জীবন থেকে বেরুতে চাই্ আমি।


:
প্রেমিকের গন্ধের আভায় ভরা চোখে চোখ রেখে দৃঢ়তায় বলি, কোন প্রবলেম নেই ক্যাথি, বাংলাদেশে পাসপোর্ট করা খুব সহজ। কেবল তোমার ছবি আর একটা স্বাক্ষর করে দাও একটা কাগজে। এরপর তোমার নামের পাসপোর্ট নিয়ে আসবো আমি "জয়া চাকমা" নামে। তোমাদের মত এমন মঙ্গোলিয় চেহারার চাকমা মেয়ে আছে বাংলাদেশের পার্বত্য জেলাতে। তাই হংকং হয়ে তোমাকে বাংলাদেশে নিয়ে যাবো আমার গাঁয়ে। তুমি কেবল হংকং পর্যন্ত চীন বর্ডার পার হয়ে যেতে পারলেই হবে। হয়তো আশাতিত মুক্তি আর প্রেমের বানভাসি চাঁদের উঠোনে ভেসেছিল ক্যাথির মন।
:
এরপর জীবন বেলা গড়িয়ে যায় দিগন্তপারে অনেক। বিদেশ থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসি আমি নানাবিধ জীবনসংঘাতে। চীনা ব্যবসা ছেড়ে দাসত্বের কাজ নেই বাংলাদেশের প্রশাসনে। ক্যাথির জন্য ভালবাসার পাসপোর্ট আর করা হয়না আমার। পুরণো ভাললাগার তৈজসপত্রের মাঝে কেবল ক্যাথির উপহার পাত্রটি সযত্নে সংরক্ষণ করি নিজ ঘরে। গত বছর ডিসেম্বরে সরকারি কাজে চীনে গেলে, নেটে সার্চ দিয়ে ক্যাথিকে খোঁজার চেষ্টা করি অনেকবার। হাজারো ক্যাথি কং এসে নেটে ভীর করে কিন্তু ঐ ক্যাথিকে আর খুঁজে পাইনা নেটে। ক্যাথির হয়তো চীনা অন্য নাম আছে কিংবা সে মৃত এখন জীবন থেকে। 
:
আজ ক্যাথির সে উপহারটি যখন মায়াজলের মৈনাক সমাধির মত ভেঙে যায় আমার হাতেই, তখন কি এক পুরণো ভালবাসার উনুন-অঙ্গারে পুড়তে থাকি আমি। আমার দু:খ চিতার অন্তিম ঘরে অনেকদিন পর ক্যাথি এসে দাঁড়ায় 'উ-চি' নামের ৪-বছরের তার মেয়েকে নিয়ে। ত্রিকালের তিতির পাখির শব্দে জয়া চাকমার পাসপোর্ট নিয়ে ক্যাথি শালিক হয়ে, শালিধান হয়ে, তিল-কাউনের ক্ষেত হয়ে, চলমান মেঘের ভেলা হয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। এলোকেশী সাঁঝ সন্ধ্যায় উঁকি মারে বুড়ো চাঁদ ঢাকার ক্লেদময় আকাশে। শীত সকালের ধুমায়িত ভাঁপাপিঠার মত ভালবাসা জেগে থাকে আমার ক্যাথির জন্যে। কষ্টকর মিহিন মৌনতায় আমি ভাঙা পাত্রটির টুকরোগুলো কুড়োই, যাতে লেগে আছে উহানের সেই ক্যাথি মেয়েটির স্পর্শ !



লেখাটি ফেসবুকে দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যান প্লিজ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন