সাভার ক্যান্টনমেন্টের দেয়াল সংলগ্ন আলির বস্তিতে থেকে পাশের সরকারি প্রাইমারিতে পড়ে মাসুম, রিয়াদ আর দুর্জয়। একসাথে স্কুলে যাওয়ার পথে কিশোর ৩-বন্ধুর লোভ ছিল ক্যান্টনমেন্টের দেয়াল সংলগ্ন কাঠবাদামের গাছটির দিকে। প্রচুর কাঠবাদাম পেকে পরে থাকতো গাছের নিচে মাটিতে। ঐ বাদাম কেটে শ্বাস বের করে খেতো ওরা ওদের দরিদ্র বস্তির জীবনে। কিন্তু বাদাম সংগ্রহে যেতে হতো দেয়াল টপকে মিলিটারি এরিয়ার ভেতরে। বেশ কবার আর্মিরা রাইফেল উঁচিয়ে তাড়া করেছিল ওদের। শাসিয়েছিল লাল চোখ তুলে। বলেছিল শাস্ত্রী আবার ভেতরে ডুকলে গুলি করবে ওদের। কৈশোর চপলতায় মুখ ভ্যাংচে দৌঁড়ে পালিয়েছিল ১০/১১ বছরের ফাইভে পড়া ৩-কিশোর বন্ধু। যেন আ্নন্দ প্রমোদ তীর্থের আকাশময় সুখস্বপ্নভরা জীবন ওদের।
:
কর্নেল ফারুকের কক্ষটি ছিল বাদাম গাছটি সংলগ্ন। বস্তির দুরন্ত এ ৩-বালকের প্রায় প্রত্যহ দেয়াল টপকে বাদাম সংগ্রহে বিরক্ত ছিল সে রীতিমত। মেজর সাকিলসহ অধিনস্তদের ডেকে বেশ কবার বলেছিল, 'ঐ শিশুরা যেন আর না ঢোকে মিলিটারি এরিয়ায়। হতে পারে তারা কোন চর, বাদাম সংগ্রহের ছলে ডুকছে মিলিটারি এরিয়ায়া'। অফিসারের কড়া নির্দেশে গার্ডরা সবাই নজর রাখতো বাদাম গাছ আর ঐ ৩-শিশুর চুরি করে বাদাম নেয়ার দিকে।
:
স্কুল ছুটির পর ফেরার পথে ৩-বন্ধুর চোখ গেলো বাদাম গাছের তলায় পরে থাকা হাজারো বাদামের দিকে। দুর্জয় বললো, চলো বাদাম নেই, ঘরে গিয়ে কেটে খাবো। আগের দিনের মিলিটারির তাড়া খেয়ে মাসুম আর রিয়াদ ভয়ে এগুতে চাইলো না। কিন্তু সাহসি দুর্জয় বললো, 'তোমরা দেয়ালের এদিকে থাকো। আমি টপকে ২-মিনিটে বাদাম নিয়ে আসছি। তারপর ৩-জনে মজা করে খাবো'। এক লাফে কৈশোর চপলতায় দুর্জয় দেয়াল টপকে কুড়োতে থাকলো পাকা কাঁচা শুকনো কাঠবাদাম। ৩-মিনিটের মাথায় হাফপ্যা্ন্ট আর স্কুল ড্রেসের পকেট ভরে লাফিয়ে উঠলো দেয়ালে ফেরার জন্যে। কিন্তু দেয়ালে দাঁড়ানো মাত্র একটা গুলি লাগলো দুর্জয়ের বুকে। মুহূর্তে হৃদপিণ্ড ভেদ করে বেড়িলে গেল গুলিটা। অন্ধকারের আলোবিদ্বেষী প্রাণ নৌকোর মাঝির মত দুর্জয় দুহাতভর্তি বাদামসহ পরে গেলো ক্যান্টনমেন্টের ভেতরেই বাদাম গাছতলায়। চিৎকার আর রক্ত দেখে ভয়ে দৌঁড়ে পালালো তার দুবন্ধু মাসুম আর রিয়াদ বস্তির দিকে।
:
মিলিটারির নিজস্ব তদন্ত রিপোর্টে বলা হলো, গুলিটি ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে নয়, বাইরে থেকে এসেছে। তাই এ মৃত্যুর জন্য আর্মিগণ দায়ী নন কোনক্রমেই। তা ছাড়া সদ্য অবসরে যাওয়া কর্নেল ফারুক, মেজর সাকিল পুলিশকে জানালো, ৩-টি ছেলেই বস্তির ছিল বিধায় তারা অসভ্য, শিষ্ঠাচার বহির্ভুত ছিল। বাদাম নিতে এসে তারা হাই র্যাংকের আর্মি অফিসারদের মুখ ভ্যাংচাতো, যা রীতিমত অবমাননাকর ছিল সবার তাদের কাছে। ওদের বারবার সতর্ক করার পরও, তারা এ চুরি থেকে বিরত হয়নি, তাই পুরো ক্যান্টনমেন্টই বিরক্ত ছিল এ তিন বস্তির ছেলের উপর।
:
পুলিশকে তদন্তের জন্যে মিলিটারি এলাকায় প্রবেশে অস্বীকৃতি জানালো ক্যান্টনমেন্ট কর্তৃপক্ষ। তারা পুলিশকে বললো, এ ঘটনার তদন্ত তারা করেছে, তাতে প্রমাণিত হয়েছে গুলিটা বাইরে থেকে করা হয়েছিল। তাই পুলিশ যেন এ ব্যাপারে আর নাক না গলায়। বিশেষ করে আর্মিদের ব্যাপারে। মৃত ছেলেটি সিভিল, পুলিশও সিভিল, গুলিটিও এসেছিল সিভিল কারো থেকে, তাই ব্যাপারটি যেন এখানেই শেষ করা হয়। সিভিল ঝামেলা পছন্দ করেনা হাই আর্মি অফিসিয়ালরা।
:
অবশেষে নিবিড় তদন্তের জন্যে কেসটি প্রেরিত হয় পুলিশের বিশেষ তদন্তশাখা "সিআইডির" কাছে। সিআইডি ইন্সপেক্টর নাবিলের হাতে পড়লো বিষয়টি তদন্তের ভার। ইন্সপেক্টর নাবিলকেও কর্নেল-মেজর পর্যায়ের অফিসারগণ বাঁধা দিলো ক্যান্টনমেন্ট প্রবেশে। নাবিল উচ্চপর্যায় থেকে অনুমতি সংগ্রহ করলেন, যেন তদন্তের স্বার্থে প্রবেশাধিকার পান সে ভেতরে যেতে। ২-সহযোগিসহ সিআইডি ইন্সপেক্টর নাবিল ভেতরে ঢুকতে পারলেও, কোন সহযোগিতাই করলো না মিলিটারি সদস্যবৃন্দ। বিশেষ বুদ্ধিমত্বায় ইন্সপেক্টর নাবিল প্রথমেই খুঁজে পেলেন দুর্জয়ের বুক থেকে বের হয়ে দেয়ালে ইটের ফাঁকে গেঁথে থাকা রক্তলাগা গুলিটি। নিজ অফিসে এসে পরীক্ষা করে দেখলো PSS silent pistol এর 7.62×42mm necked round SP-4 বোরের বুলেট এটি। খোঁজ নিয়ে জানলেন, বাংলাদেশে আর্মিতে কোনদিন PSS silent pistol কেনা হয়নি বা কেউ ব্যবহার করেনা এটি। তদন্তে হতাশা এলো ইন্সপেক্টর নাবিলের মনে। আবার গেলেন খুনের স্পটে। মেপে দেখলেন মাত্র ৫০ মিটার রেঞ্জ এ পিস্তলটির। কদিন আগে অবসরে যাওয়া মেজর রশিদের প্রায় ২০ মিটার দুরের রুম থেকে গুলি করলেই বক্ষভেদ করে গুলিটি দেয়ালে গেঁথে থাকতে পারে। বাইরে থেকে গুলিটি এলে কখনো এটি ক্যান্টনমেন্টের ভেতরের দেয়ালে ঢোকার কথা নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ অস্ত্রটি কোনো আর্মি অফিসার কখনো ব্যবহার করেনি বাংলাদেশে।
:
ইন্সপেক্টর নাবিলের হঠাৎ মনে হলো আর্মিদের কারো ব্যক্তিগত লাইসেন্স করা পিস্তল থাকতে পারে। তাই আবার প্রবল উৎসাহ নিয়ে পুনরায় গেলেন তিনি ক্যান্টনমেন্টে। দেখতে চাইলেন ব্যক্তিগত লাইসেন্সকরা অস্ত্রের তালিকা ও অফিসারদের নাম। প্রথমে অস্বীকার করলেও, শেষে বিরক্তভরে ব্যক্তি-অস্ত্রের তালিকাটি দেখালো নবনিযুক্ত কর্নেল ওমর। কিন্তু সেখানে কারো নামেই PSS silent pistol পাওয়া গেল না। কিন্তু দমলো না বস্তির নিহত শিশু দুর্জয়ের হত্যাকারীকে খুঁজে বের করতে দৃঢ়চেতা ইন্সপেক্টর নাবিল। এ ঘটনায় অনিদ্রিত হিমেল রাত কাটে ইন্সপেক্টর নাবিলের বেদনার নীল জলে প্রতিক্ষণে প্রতিনিয়ত!
:
২-সহযোগিকে খুঁজতে পাঠালো দেশের সব থানাগুলোতে বিশেষ করে ক্যান্টনমেন্ট আছে এমন এলাকার থানাগুলোতে PSS silent pistol এর লাইসেন্স কারো নামে ইস্যু করা হয়েছে কিনা তা দেখতে। টাঙ্গাইলের ঘাটাইল থানায় পাওয়া গেল এক সুদুরপ্রসারি স্পষ্টতর স্বচ্ছ সূত্র। ১০-বছর আগে ঘাটাইল সেনানিবাসে কর্মরত থাকাকালীন মেজর ফারুক একটা PSS silent pistol এর লাইসেন্স করার জন্যে দরখাস্ত দিয়েছিলেন ঘাটাইল থানায় কিন্তু বদলী হয়ে যাওয়ার কারণে লাইসেন্স আবেদনটি ওভাবেই পরে থাকে ওখানে। দরখাস্ত ফরমটিতে স্বাক্ষর করা ছিল ঐ সময়ের মেজর ফারুকের যিনি বর্তমানে কর্নেল ফারুক সাভারের।
ইন্সপেক্টর নাবিল এবার ক্যান্টনমেন্ট অভ্যন্তরে সিনিয়র অফিসার্স বাঙলোতে কথা বলতে চান অবসরে যাওয়া কর্নেল ফারুকের সাথে। কিন্তু কর্মরত অফিসারগণ এটাকে আর্মি অফিসারদের প্রতি চরম অবমাননাকর বলে প্রত্যাখ্যান করেন ইন্সপেক্টর নাবিলকে। জিজ্ঞাসাবাদে বাঁধা দিলে তিনি ওয়ারেন্ট ইস্যু করাতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলে, তাকে যেতে দেয়া হলো কর্নেল ফারুকের বাঙলোতে। অন্য ৪-জন অফিসার ও বেশ কজন সৈনিকের উপস্থিতিতে ইন্সপেক্টর নাবিল ঐ পিস্তলের কথা জানতে চাইলো কর্নেল ফারুকের কাছে। সার্চ করলো তার পুরো ঘর। কর্নেল তার প্রতি এমন সন্দেহকে 'অপমান' বললেন এবং ইন্সপেক্টর নাবিলকে ভয় দেখালেন তার পদমর্যাদা, যুদ্ধের অভিজ্ঞতা, সততা, দক্ষতা, রাষ্ট্রপতি পদক প্রাপ্তির কথা স্মরণ করিয়ে। এমনকি উচ্চপর্যায়ে তার প্রভাবের কথাও বলতে ভুললেন না তিনি। ইন্সপেক্টর নাবিল ১০ বছর আগের ঘাটাইল সেনানিবাসে থাকাকালীন PSS silent pistol এর জন্য তার দরখাস্তফরম দেখালেন। কিন্তু ওটাকে ইন্সপেক্টর নাবিলের বানানো রাস্তার কাগজ বললেন কর্নেল ফারুক দৃঢ়তার সাথে। এবার নাবিল বের করলেন দরখাস্ত ফরমে কর্নেল ফারুকের নিজ হাতের স্বাক্ষর এবং সিআইডি কর্তৃক ঐ স্বাক্ষরের নিরীক্ষাপত্র।
:
পরদিন সিআইডি অফিসে সকাল ১০-টায় উপস্থিত করতে বললেল কর্নেল ফারুককে কর্মরত মেজরকে। অন্যথায় ওয়ারেন্ট নিয়ে গ্রেফতার করতে আসবেন এ কথাও বলতে ভুললেন না দৃঢ়চেতা ইন্সপেক্টর নাবিল। পুরো ঘটনা আর ইন্সপেক্টর নাবিলের দৃঢ়তা আর সংগৃহীত প্রমাণাদিতে বিস্মিত হলো উপস্থিত সব সেনা সদস্যরা। মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো সবাই বোধ আর লজ্জায়। সারারাত নির্ঘুম কাটলো কর্নেলের। রাত দুটোর দিকে ফোন করে ইন্সপেক্টর নাবিলকে বললেন, হ্যা খুব বিরক্ত ছিলাম ঐ ৩-টা বস্তির ছেলের প্রতি আমি। তাই আমিই হত্যা করেছি বস্তির ছেলে দুর্জয়কে। ৩-জনকেই হত্যা করতাম আমি, যদি ঐদিন ৩-জন ঢুকতো ভেতরে। কিন্তু ঘটনাক্রেম ১টা ঘুকেছিল মাত্র। ইন্সপেক্টর নাবিলের প্রশ্নের জবাবে প্রবল উত্তেজনায় তখনই বলে ফেললো সে, পাশের পানির কুপটিতে ছুঁড়ে ফেলেছে সে হত্যায় ব্যবহৃত পিস্তলটি রাগে তখনই।
:
খুব ভোরেই সিআইডির লোক নামিয়ে কুপে খুঁজে পাওয়া গেল PSS silent pistol টি। ঠান্ডা মাথায় হত্যাকারী হিসেবে কর্নেলে ফারুককে গ্রেফতার করে চার্জসিট দেয়া হলো তার নামে। বিচারে আমৃত্যু কারাদন্ড হয় কর্নেলের। সিজ করা হয় মিলিটারি পদমর্যাদা আর সুবিধাদি।
:
ভালবাসার আগুনে জ্বলা মোম হয়ে গলতে গলতে ঐ পথেই প্রতিদিন স্কুলে যায় মাসুম আর রিয়াদ। কষ্টকর ভুলের সাগরে জন্মানো বাদাম গাছের দিকে তাকায় তারা ক্ষীয়মান কালক্ষণে। বৃষ্টিভেজা পথের দোআঁশ মাটির ঘ্রাণে দুর্জয়ের গন্ধ পায় দুবন্ধু। সারাদিন চলহীন বিকল জীবনের ইস্টিশানে হাঁটে ওরা, আর খুঁজে মরে কাউন বনের ঘাস ফড়িংরূপি দুজর্য়কে। স্কুল পথের বাদাম বৃক্ষটি শান্তির মহিমান্বিত ছায়া হয়ে হাতছানিতে ডাকে ওদের। বোধহীন ভাললাগার কষ্টেরা নেচে চলে দুবন্ধুর জীবনে। বাদামগাছটির দিকে তাকালেই পুতে রাখা ব্যথার ছায়ামূর্তিরা উঠে দাঁড়ায় মৃত্যু দেয়ালে। এক সময় মৃত দুর্জয়ের ভালবাসার ঘ্রাণ প্রেমহীনতার নষ্ট ন্যাফথ্যালিনের মত লাগে ওদের নাকে। শিশিরভেজা ঘাসেদের ঘুমরাতে গলাটিপে দু:খের বীজ বুনতে বুনতে ওরা আক্ষরিক স্বপ্নের মিলিটারি হয়। বন্ধুত্বের অহম ভুলে ভালবাসাহীনতার বুকে ঝাপ দেয় ওরা। বড় হয়ে দুবন্ধু সেনাবাহিনিতে যোগদান করবে ওদের জলজ দিঘিতে বাইতে থাকে এমন কল্পনায় নাও। প্রতিনিয়ত স্কুলে যাওয়ার পথে জল ধোঁয়া নদীর কলতানে ওরা দেখে বন্ধু দুর্জনকে জড়িয়ে আছে বাদাম গাছটি। মৃত দুর্জয়ের ভালবাসায় ওরা পাটখড়ির পচা ঘ্রাণে কখনো আমোদিত হয়, কখনো ঢেঁকিছাটা চালের সুবাসিত বাতাসে ভাসে ওদের মন।
:
প্রবল বৃষ্টিতে পাতার চেয়ে বেশি বাদামে ভরে থাকে গাছটা ফলবতী নারীর মতন। ত্রস্ত চোখে ঈশ্বরের বাদাম সৃষ্টিতত্ত্বে তাকায় ওরা। শঙ্খ লাগা সাপ দেখার মত দৌঁড়ে পালায় দুবন্ধু পকেটে থাকা মৃত বন্ধুর প্রেমপত্র ছিঁড়ে। প্রত্নঘোরের মধ্যে ধূলোবাড়ি মাটিতে জন্মশোধের ঋণ শুধতে দাঁড়িয়ে থাকে গাছটি।
[ঘটনাটি ঘটেছিল ভারতে। ইন্ডিয়া ফাইট ব্যাকে (সাবধান ইন্ডিয়া) দেখানো হয়েছিল ঘটনাটি। যার ছায়া অবলম্বনে বাংলাদেশের রূপকে গল্পটি লিখিত]
Khoob sundor golpo. Pore bhalo laglo.
উত্তরমুছুনRasik Pagal
ধন্যবাদ দাদা। ব্লগে ঢোকার কারণে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি
উত্তরমুছুনধন্যবাদ দাদা। ব্লগে ঢোকার কারণে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি
উত্তরমুছুন