শুক্রবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

ফেসবুকে ড. ভ্লাদিমির ইলিচ আন্দ্রিউসা, ডা: চন্দ্রাবতির বন্ধুত্ব এবং তারপর [ চলার পথের গল্প # ৭ ]




ড. আন্দ্রিউসা এই মাত্র ‘এফিডেভিট’ করে তার বাঙালি নাম পরিবর্তন করলেন। এখন তার নাম ভ্লাদিমির ইলিচ আন্দ্রিউসা। এ নামটি তার খুবই পছন্দের। কারণ বছর পাঁচেক আগে যখন তিনি রাশিয়া যান প্যাট্রিক লুমুম্বা ফ্রেন্ডশিপ বিশ্ববিদ্যালয় পিএইচডি করতে, তখন তার ‘রিচার্স উপদেষ্টা’
ছিলেন এই অধ্যাপক ভ্লাদিমির ইলিচ আন্দ্রিউসা। ভাষার মহাসমুদ্র আর মহামানব ছিলেন তিনি। নিজে বাঙালি না হয়েও জানতেন বাংলা, ইংরেজি, আরবি, ফার্সি, হিন্দি, উড়িয়া, মৈথিলি, অহমিয়া, আর্মেনীয়, আন্দামানি আরো কতো ভাষা! হাতে কলমে তিনি বুঝিয়ে দিতেন বাঙলা বর্ণ প্রতিকের সাথে হিন্দি বা উড়িয়ার সাদৃশ্য কিভাবে কিংবা রুশ, উজবেক, কাজাক, আর আর্মিনিয় ভাষার বর্ণ, শব্দ, আর উচ্চারণ তত্ত্বে কি অপূর্ব ঐকতান! রাশিয়াতে তখন রুশ ছাড়াও আরো অনেকগুলো ভাষা প্রচলিত ছিল। চেচেন, চুভাশ, কাল্মিক, কাবার্দিয়ান, কোমি, মারি, মর্দ্ভিন, অসেতীয়, তাতার, তুভিন, উদমুর্ত, ইয়াকুত, আভার, বুরিয়াত, বাশকির কত কি? এসব ভাষার সাথে পরিচয় করান তিনি ড. আন্দ্রিউসাকে। ভাষা ছাড়াও এ অধ্যাপক তার সকল ছাত্রকে ঘুরিয়ে দেখান উত্তর থেকে দক্ষিণের তুন্দ্রা, তৈগা, স্তেপ ও অর্ধ-ঊষর রুশ মরুভূমি; বরফাচ্ছান্ন আর্কটিক ও সাইবেরিও শৈত্যপ্রবাহ। ভলগা, ইউরাল, ওব, ইয়ানা, লেনা, দানিয়ুব, ইখটস্ক নদীতে নৌবিহারে যান শিক্ষার্থীদের নিয়ে। ঘুরিয়ে দেখান ভাষিক বৈচিত্রের গাঁ আলতাই, তুবা, কুরভ, পার্ম, তমস্ক, ওমস্ক, কিয়স্ক আর পুস্কানভ। আর বিশেষ বোটে ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলেন বৈকাল, ইমান্দ্রা, কুবেনেস্কা, লুভেজেরো, ভলদাসেভকো আর ভিসলিতিজ হ্রদ!

নারীহীন জীবন কাটান এ অধ্যাপক একাকি বরফাচ্ছিত কাঠের পুরণো ঘরে, যেখানে সারাদিন পুড়তে থাকে ওক কাঠ। পৃথিবীর অনেক মহতি মানুষের জীবন কি এমন একাকিই কাটে দু:খবোধের মাঝেই? এ অধ্যাপকের কাছেই আন্দ্রিউসা বুঝতে পারেন সত্যিই ভাষাও এক জটিল অথচ আনন্দের উপাখ্যান মানুষের জীবনের মতই। ৩-বছর বাইরে থেকে দেশে ফিরে এসেছেন দু’টো জিনিস ত্যাগ করে ড. আন্দ্রিউসা। এক নিজের পৈত্রিক নাম, দুই নিজের পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত ধর্ম। আর নাম পরিত্যাগের আরেকটি প্রধান কারণ তার নাম মোহাম্মদ, গনেশ, মাইকেল, বড়ুয়া শুনে কেউ যেন তাকে ধার্মিক না ভাবতে পারে। তাই নাম আন্দ্রিউসা, যাতে কেউ বুঝতে না পারে সে মূলত কোন ধার্মিক না নধার্মিক! তার মতে ধর্মমুক্ত মানুষই প্রকৃত মানুষের গুণ ধারণ করতে পারে, যা ধর্মাশ্রয়িরা কখনোই পারেনা।

ঢাকায় ফিরে পুরণো সরকারি দাসত্বের কর্মটি ছাড়াও নতুন যে কাজটি আন্দ্রিউসা শুরু করে তা হচ্ছে ফেসবুকে লেখালেখি। ৩-বছর বিদেশে থাকাকালিন এটায় ভিষণ নেশাসক্ত হয়েছে সে। সরকারি সকল কর্তারা যখন একটা যুৎসই পোস্টিংয়ের জন্য ইুঁদর দৌঁড়ে লিপ্ত থাকে সারাক্ষণ, তখন আন্দ্রিউসা এসবের কোন খোঁজই রাখে না বলতে গেলে, সে তার ভূবনে উড়তে থাকে একাকি গাঙচিল হয়ে নীলাভ আকাশে।

এর মাঝে একদিন ফেসবুক সূত্রে পরিচয় হয় ডা: নিবুলা চন্দ্রাবতির সাথে। কয়েক বছর আগে ডাক্তারি পাস করে মাত্র বিসিএস দিলো ডা: চন্দ্রাবতি, আপাতত কাজ করছে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে ‘ইমারজেন্সি মেডিকেল অফিসার’ হিসেবে। ইনবক্সে অভাবিত সৌন্দর্যমন্ডিত কথার ছলে, দু’জনের শেকলের পর শেকল চুরমার করা ঝনঝনে শব্দে জীবনের করুণতা বাজে প্রায়ই। আদিগন্ত আর্তনাদ আর নানা ছন্দে ছন্দায়িত হয় দু’জনের জীবন কথা বিবিধ প্রপঞ্চে! নিজের দু:খগুলোকে ভাগাভাগি করে তারা কিন্তু কেবলই ক্ষীয়মান নক্ষত্রের মতই। আন্দ্রিউসা কখনোবা জানতে চায় টুকটাক কিংবা যোগাযোগ মাধ্যম কিন্তু চন্দ্রাবতি ধূসর মাটিতে তা গড়িয়ে দিয়েছে নানা কথার ছলে; জল পড়ে যা ভিজে গলে গিয়েছে এক সময়।

এভাবে প্রায় প্রত্যহ কাজের ফাঁকে ফাঁকে কথা হয় ড. আন্দ্রিউসা আর ডা: চন্দ্রাবতির সাথে। ধর্ম, দর্শন, সমাজ, দেশ, রাষ্ট্র, স্বাধিনতা, স্বাস্থ্য কিছুই বাদ যায়না তাদের আলোচ্য বিষয় থেকে। দু’জনের ফেলে আসা জীবনের বিজন অশ্রুবিন্দুর গান আর জীবন দ্রোহের কথাও বাদ দেয়না কখনো তারা। জীবন পিঠে অজস্র চাবুকের দাগের কথা তারা প্রায়শই আওড়াতে থাকে জান্তে কিংবা অজান্তে। আন্দ্রিউসার সাধ জাগে কখনো ডা: চন্দ্রাবতির সাথে দেখা করার, কথা বলার, যৌথ চাষাবাদে কোন ফসল ফলাবার। কিন্তু কেন যেন হয়ে ওঠে না এসব। অজানা কারণে শেকলে বাঁধা প’ড়ে থাকে দুর্বিনীত আশা বৃক্ষরা। বিস্ময়কর ব্যাপার! এতদিন তারা অনেক কথা বলেছে ইনবক্সে ঘটার পর ঘন্টা, সাজিয়েছে শব্দমালার অসিম সমুদ্র! কিন্তু কেউ দেখেনি কাউকে এমনকি ছবিতেও নয়, একি বিশ্বাসযোগ্য? অবিশ্বাসের হাটেও কখনোবা বিশ্বাস কেনাবেচা হয় না কি?

কখনো আন্দ্রিউসা প্রবোধ দেয় নিজেকে এভাবে, সভ্যতার সমস্ত শিল্পকলার মাঝে অধরা ‘অপ্সরা’রাই সম্ভবত মানুষের কল্পনার ছন্দে ছন্দায়িত বেশি। আর তাই ডা: চন্দ্রাবতি এভাবেই থাকুক অধরা হিসেবে, ধানসিঁড়ির হারিয়ে যাওয়া সুতীব্র জলঢেউ হয়ে ! শিশির না ধরলেই সুন্দরতর থাকে বোধহয়! কিন্তু তারপরো তার মাথায় একটা হৃদয় টাটানো ঝড়ো বাতাস খেলা করতে থাকে প্রতিনিয়ত। একদিন প্লান করে ডা: চন্দ্রাবতিকে না জানিয়েই তার হাসপাতালে আকস্মিক গিয়ে দাঁড়াবে; বলবে, ‘হ্যালো আমি আন্দ্রিউসা’! আকস্মিকতায় বিস্মিত আর চমকিত করবে তাকে। এসব ‘কুচিন্তা’ মাথায় ভেতর খেলা করে সকাল বিকেল মাঝ বয়েসি আন্দ্রিউসার কাজের ফাঁকে ফাঁকে।

সঙ্গোপনে খবর নেয় কখন ইমারজেন্সিতে ডিউটি থাকে ডা: চন্দ্রাবতির। এমন এক রৌদ্র দুপুরে সত্যিই হাসপাতালে যেতে বের হয় সে ঘর ছেড়ে। ‘পরস্পর হৃদয়ের শব্দাবলি ভাগ করবে’ এমন দৃশ্যাবলি কল্পনায় কখন ঢাকার যানজট পেড়িয়ে চলে আসে স্কয়ারের একদম কাছাকাছি। কিন্তু রাজপথের আকস্মিকতা আর ছন্দপতনতা ঘিরে ধরে আন্দ্রিউসাকে। সড়ক সন্ত্রাসি আর র‍্যাবের ক্রোস ফায়ারের বানানো গল্পের বদলে এবার সত্যি ঘটনা ঘটে স্কয়ারের ব্যস্ত সড়কে। আর তাতে গুলিবিদ্ধ হয় ক’জন সন্ত্রাসি আর নীরিহ পথচারি আন্দ্রিউসা নামক চন্দ্রাবতির ফেসবুক বন্ধু, যার হাতে ছিল একগুচ্ছ গ্লাডিওলাস, হয়তোবা ডা: চন্দ্রাবতির জন্যে! বুকে গুলি লাগে তার, গ্লাডিওলাস ছিন্নভিন্ন হয় তীব্র দহনে। অপরাজেয় ধীবরেরা যেমন প্রচণ্ড ঝড়ে নিমজ্জিত হয় পর্বতাকৃতির ঢেউয়ে, তেমনি হৃদয়ে ধারণকৃত দেহ-জ্যোৎস্না হারিয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে আন্দ্রিউসা। পথিকরা ধরাধরি করে তাকে নিয়ে যায় স্কয়ার ইমারজেন্সিতে, যেখানে ডা: চদ্রাবতি ডিউটিরত অবস্থা শেষে মুক্ত হয়ে বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন। অঘোর অন্ধকার অমাবশ্যায় আন্দ্রিউসা চাঁদ, নক্ষত্র আর তারার মাঝে ভাসতে থাকে স্বজনহীন ছুটে চলা অনাথ নক্ষত্রের মত।

তখন আকাশ অন্ধকার করে বৃষ্টি নামে পৃথিবী জুড়ে। কিন্তু নিস্তেজ চেতনাহীন আন্দ্রিউসাকে কি চিনতে পারে ডা: চন্দ্রাবতী? আন্দ্রিউসা কি বেঁচে উঠবেন আর কখনো? সে কি হারিয়ে যাবে চন্দ্রাবতিকে না দেখেই? চন্দ্রাবতী কি চলে যাবেন এখন আন্দ্রিউসাকে ফেলে? এভাবেই কি এ ফেসবুক গল্পের ইতি ঘটবে? জীবনের এই সব নিভৃত কুহক কি স্কয়ার ইমারজেন্সিতে নিভে যাবে আজই? দিগন্তের নীল জোছনারা কি উঠবে না আর বাড়ির ছাদে? সে কি এসবের কিছুই জানবে না? ডা: চন্দ্রাবতি কি লগইন করে ইনবক্সের অপেক্ষায় থাকবে তার ফেসবুক বন্ধুর? সে কি এখনই চলে যাবে এ বৃষ্টিস্নাত দুপুরে তার বন্ধুর কপালে হাত না রেখেই? আন্দ্রিউসার ফিনকি দেয়া লাল রক্ত সমস্ত শরীরে মেখে যখন গড়িয়ে পড়ে মেঝেতে; তখনো আন্দ্রিউসার রক্তাক্ত বুকে শাঁইশাঁই চাবুকের শব্দ গোঙাতে থাকে তার ক্ষীয়মান বুকের ওঠানামার সাথে ! গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর বিষের দহনে ড. আন্দ্রিউসার জীবন কি ক্লেদাক্ত হবে আজই, এ স্কয়ার ইমারজেন্সিতে?



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন