রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

৯-জন হিন্দু যুবতি মেয়ে ও আমার মায়ের গল্প : পর্ব # ২ [ চলার পথের সত্যি ঘটনার গল্পসিরিজ : ২১ ]




মাসিমা বলতে থাকে ব্যথাতুর একাকি বিরহী জোনাকির মতো, "তোমাদের কাঠ আর টিনের তৈরি বড় দোতলা ঘরের উপরের ধান-চাল রাখার "মাচায়" বুদ্ধি করে গোপনে মাসিমা তৈরি করে দিয়েছিল ৯-মেয়ের থাকার বিছানা। আমরা দিনে নিজ ঘরে থাকলেও, সন্ধ্যার প্রাক্কালেই চালভাজা, মুরি এসব নিয়ে ঐ মাচায় চলে যেতাম। বিশেষ দরকার ছাড়া সারারাত কেউ নামতো না। আমাদের হিন্দু বাড়িতে রাজাকাররা অনেকবার হানা দিয়েও, একটি মেয়েকেও ধরতে পারেনি ৮-মাসে। আমাদের সবার বয়স ছিল ১৫-২৫ বছরের মধ্যে। কিন্তু নভেম্বরের দিকে গোপনে খবর পেয়ে রাতে সরাসরি তোমাদের বাড়িতে আসে রাজাকার পাক আর্মিদের নিয়ে। টের পেয়ে মাসিমা সবাইকে পেছনের গোপন সিঁড়ি দিয়ে ভাগিয়ে দেন দুরের বিলের আখ ক্ষেতে। কিন্তু তাড়াতাড়ি নামতে গিয়ে আমার পা ভেঙে গেলে আমি আর হাঁটতে পারিনা, তোমার মা মানে মাসিমা আমাকে একাই টেনে টেনে আখক্ষেতে নিয়ে যায় মৃত লাশের মত। সারারাত সেও আমাদের সাথে আখ-ক্ষেতে রাত কাটায়, পুরুষরা সবাই পালিয়ে গিয়েছিল আগেই। কাউকে না পেয়ে পাঞ্জাবি আর রাজাকাররা তোমাদের ঘরে আগুন দিয়ে চলে যায়। আখ ক্ষেতে আমরা দেখতে থাকি তোমাদের ঘরের আগুনের লেলিহান শিখা। ভোরে যখন আমাকে সবাই কোলে করে বাড়ি ফিরে আসি, সবাই দেখি প্রত্যেকের গায়ে ৩/৪টা করে জোঁক রক্ত খেয়ে মোটা হয়ে ঝুলছে। আমার পা ফুলে একাকার। ঐদিন রাতেই গোপনে মাসিমা আমাদের ৯-মেয়েকে নৌকোয় করে নিয়ে চলে যায় পাশের ছোট্ট দ্বীপ "লক্ষ্মির চরে", যেখানে কেবল গরু, মহিষ আর রাখালেরা ছোট অস্থায়ী টংঘর তুলে থাকতো। মানুষহীন হোগলা পাতার চরে প্রায় ১-মাস মাসিমা রাতে থাকতো আমাদের সাথে, আর দিনে নৌকোতে ফিরে আসতো নিজ বাড়িতে। খাবার ইত্যাদি নিয়ে আবার অন্ধকার রাতে গোপনে নৌকো নিয়ে চরে যেতো আমাদের কাছে রাখালদের সাহায্যে। চরে ছিল তোমাদের গরু আর মহিষের বাথান! সারাদিন গরু মহিষের দুধ খেতাম আমরা। থাকতাম হোগলা পাতার বনে লুকিয়ে। 
:
নিজ মায়ের মুখে এমন বিস্ময়কর কথা শুনে সুরেন্দ্র জড়িয়ে ধরে আমায় পরম কৃতজ্ঞতায়। স্বর্ণা আর মৃত্তিকার চোখে ছলছল করতে থাকে পাতাঝরা বৃক্ষের ব্যথাতুর কান্নারা। ওর মা আবার বলে, হিন্দু হলে তোমার মাকে দেবতা বানিয়ে পুজো করতাম আমরা। তারপরো ভগবান অবশ্যই ভাল করবেন তার। আমরা তার আত্মার মঙ্গলের জন্যে পিন্ডদান করবো আগামী মাসে। তোমাদের কিন্তু আসতে হবে সবাইকে। 
:
মার সাথে প্রগাঢ় ভালবাসা ছিল আমার। তার এ মহত্বের কথা শুনে দু:খের লিকলিকে তরুণাস্থিরা কিলকিলিয়ে ওঠে আমার বুকে। মার জন্যে বুকের মাঝে কষ্টে লালিত গুল্মলতাগুলোরা আবার যেন জলসেচনে পুষ্পিত হয় তাৎক্ষণিক তাগিদে। এ পরিবারের চার সদস্যের সামনে আমার মুখ বনস্পতির সুষমায় আলোকিত হয় এবার। মাসিমার দিকে তাকিয়ে আমার মৃত মার চেহারা দেখি তার মাঝে, ভেজা কর্ষিত জমির মতো আমি গলে যাই মূহূর্তে। মাসিমার কথায় কষ্টের বেহালায় দেঁহাতি সুর কে যেন বাজিয়ে চলে এক অজানা অখ্যাত গোচরণ স্টেশনে। 
:
অনেক রাতে জানালা খুলে গোচরণ স্টেশনে তাকিয়ে থাকি আমি পলকহীন দৃষ্টিতে। চলন্ত ট্রেনের হাজারো মানুষের জীবনময়তার স্বাপ্নিক কথোপকথনে মা আর ন'টি যুবতি মেয়ের পালিয়ে বেড়ানো জীবন দেখতে পাই আমি স্বচ্ছতার জালে। ট্রেন হারিয়ে গেলে জোছনা-স্নান সেরে আমি চাঁদ-মেঘের কেলি দেখি আমার দ্বীপগ্রাম থেকে বহুদুরের গোচরণ ভুমির রাতের আকাশে। যে আকাশে ভেসে বেড়ায় আমার মা আর একাত্তরের ন-টি হিন্দু যুবতি মেয়ে, যারা এক সময় নৈকট্যের দিঘির পাড়ে ভালবাসায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল। নটি ক্ষয়িষ্ণু যুবতি আর আমার মা এই দশ নারীর কেবল একজনের ঘরে আকাশ, চাঁদ আর নক্ষত্রের ভালবাসার উজ্জ্বল দ্যুতিময়তা দেখছি আমি। কিন্তু বাকি নয় নারী কোথায় হারিয়ে গেল? বাকি ৮ নারী আর আমার মাকে খুঁজতে থাকি আমি দু:খাতুর উঁকিমারা আকাশটায়। গোচরণের এ রাতের ঘুমন্ত প্রাণহীন ঘনান্ধকার ঘরে আমি কি তাদের অপেক্ষায় থাকবো? এ চিন্তনে আমার দু'চোখ ঘুম রাতের কৃষ্ণগহ্বরে তলিয়ে যায়। দিঘির কালো জলের অনাথ মাছ হয়ে আমি আকাশ সমুদ্র জলে সাঁতরাতে থাকি। যেখানে হয়তো ভেসে বেড়াচ্ছে আমার মা আর ঐ আট হিন্দু নারী। যেমনটা একাকি বিলের মাঝে বৃহন্নলা তালগাছ জন্মসূত্রে খোঁজে তার হারানো সাথীদের!
;

লেখাটি ফেসবুকে দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যান প্লিজ


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন