শুক্রবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

পুজার শহর ত্রিনিদাদ থেকে বিদায় এবং আমার বুকে হেলিয়েটের মৃত্যু [ চলার পথের গল্প # ১৬ ]





২৫ অক্টোবর পাগলাবাবা মন খারাপ করে ফিরে গেল টরেন্টোতে আমায় ত্রিনিদাদ একা ফেলেই। কারণ আমার ফ্লাইট বেলা ১০টায়, বাবার ছিল সকাল ৭টায়। হোটেলে, সৈকতে কোথাও মন বসাতে পারলাম না আমি। পুজার স্মৃতি, পাগলা বাবার বাকরুদ্ধ কণ্ঠ, তার বিমর্ষ চিত্তে বিদায় আমার মনটা দারুণ খারাপ করে দিল। তাই সুন্দর হোটেল ছেড়ে ফ্লাইট ডিপারচারের ৪ ঘন্টা আগেই এয়ারপোর্টে এসে মানুষের হাঁটাচলা, পা আর ব্যাগ গুণতে থাকলাম আমি। কি কারণে জানিনা বোর্ডিং করতে গেলাম ৯.৩০টায়। তখন ইকোনমিক ক্লাসের সম্ভবত সব সিট শেষ। কা্উন্টারের নিগ্রো ইয়াংম্যান বললো, আমাকে "বিজনেস" ক্লাসে দিলে কি আমার কোন আপত্তি আছে? আমি অনাপত্তির কথা জানালে লাল বোর্ডিং মিললো আমার অগ্রাধিকার স্কাইপির। 

পুজার স্মৃতি জড়ানো পিয়ারকো এয়ারপোর্ট দ্রুত হেঁটে সরাসরি ব্রিজ পার হয়ে ইভা এয়ারের নতুন জ্যাম্বো জেটের ককপিটের পেছনেই বিজনেস ক্লাসে ঢুকলাম আমি। ২০ সিটের বিজনেস ক্লাস সব ফাঁকা, কেবল আমার পাশের সিটে সুন্দর দাঁড়িওয়ালা এক ককেশীয় পুরুষ দেখলাম। আমি দাড়ি রাখাকে কখনো ভাল চোখে দিখিনি, কিন্তু এ সহযাত্রীর সোনালী দাড়ি দেখে নিজের দাড়ি রাখতে ইচ্ছে হল আমার। যদিও ইকোনো ক্লাস একদম হাউসফুল। আমার ইকোনমিক ক্লাসের টিকেট থাকলেও সম্ভবত ঐ ক্লাসে সিট না থাকাতে আমায় ১ম শ্রেণি দেয়া হয়েছে এ শেতাঙ্গর পাশে। আমায় দেখেই হেসে খুব জোরে হ্যালো বলে উঠলেন ভদ্রলোক। সম্ভবত একাকিত্ব তার ভাল লাগছিল না, তাই শেতাঙ্গ হয়েও বাংলাদেশি দ্রাবিঢ় রঙয়ের মানুষ পাশে পেয়ে নানা কথা জুড়ে দিল সে।

বিমান ছাড়ার আগেই "জন হেলিয়েট" নামের আইরিশ ভদ্রলোক তার চৌদ্দ পুরুষের পরিচয় দিলেন নিজেই। তাইপেতে আইটি ফার্মে কাজ করেন তিনি। বেড়াতে এসেেছিলেন ক্যারিবীয় গ্রানাডা, বাহামা, হনুলুলু আর ত্রিনিদাদ টোবাগোতে ১৪ দিন আগে। এখন এ ফ্লাইটেই হাওয়াই ট্রানজিট হয়ে ফিরবেন তাইপে নিজ কর্মস্থলে। Eva Air থেকে হাওয়াই-তে ANA Air এ ফ্লাইট বদলের আগ পর্যন্ত একটানা নানাবিধ কথা শোনালেন হেলিয়েট। হাওয়াই নেমে দুপেগ "জিন" খেলেন পানি ছাড়াই এ বিকেলে। সন্ধ্যার আগেই তাইপের পথে ANA Air আমাদের নিয়ে উড়াল দিল। এবারও ট্রানজিট প্যাসেঞ্জার হিসেবে হেলিয়েট আমার পাশের সিটেই। নানাবিধ কথার মাঝে স্কটল্যান্ডে কর্মরত তার ফিঁয়ান্সে ক্যানিথের বিজনেস কার্ডও দিল আমায়। বাংলাদেশে বেড়াতে আসার কথা দিল হেলিয়েট। অনেক ওপরে মাইনাস তাপমাত্রায় বিমান ওঠে গেলেও, আমি জানালা দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে চলমান জাহাজ আর ঢেউ খুঁজতে থাকলাম অবিরত। অন্ধকার রাতে সমুদ্রে চলমান জাহাজের মালার মত আলো আমি উপভোগ করতে থাকি। হেলিয়েট তার গল্প বলে যায় একটানা।

দু'ঘন্টা বিমান চলার পর বিমান ক্রুরা যখন যাত্রীদের চা-কফি-জুস দিচ্ছিলেন ট্রলিতে করে, ঠিক সেই মুহূর্তে প্রচন্ড ঝাকুনি দিয়ে বিমানটি এয়ার পকেটে পড়ে গেল। মহাকাশে এয়ার পকেটে বিশালাকৃতির এ আকাশ যানটি অন্তত ১০০ মিটার বায়ুশূন্য পথে চলাতে অনেকেরই হাতের পানীয় নিচে পরে গেল। বিমানবালারা টাল সামলাতে না পেরে কেউ কেউ যাত্রীদের উপর গিয়ে পড়লো। টয়লেটের সামনে অপেক্ষমান যাত্রীরা ৩-জন গিয়ে দরজার সাথে ধাক্কা খেল। কিছুটা ভয়ে পেলেও আবার বিমানটি সোজা হয়ে চলতে শুরু করলে অনেক যাত্রীই জোরে আনন্দধ্বনি করলো নানাবিধ শব্দে। আমি আমার হাতের পরে যাওয়া কফি প্যান্ট থেকে মুছবো এ প্রস্ততিকালে হঠাৎ "জন হেলিয়েট" নামের আইরিশ সহযাত্রী বুক চেপে আমার গায়ের উপর পড়লো। ক্ষীণ শব্দে কেবল "হার্ট এ্যাটাক" উচ্চারণ করেই পুরো এলিয়ে পড়লো আমার বুকের উপর। আমি তার মাথা আমার বুকের সাথে চেপে ধরে 'হেলপ-হেলপ' বলে খুব জোরে চিৎকার দিলাম। ৩ যাত্রী আর ২ বিমান ক্রু ছুটে এলো আমাদের কাছে। 

ততক্ষণে হেলিয়েটের মুখ দিয়ে সাদা ফ্যানা বের হচ্ছে। সবাই ধরাধরি করে তাকে ফ্লোরে শোয়ালাম। বালারা বিমানে কোন ডাক্তার থাকলে সাহায্যের জন্যে বার বার আসতে বললেন। দু'জন চাইনিজ ফিজিশিয়ান দৌঁড়ে এসে তার বুকে প্রচন্ড চাপ দিলো, মুখে ক'বার ফু দিল, পেটে চাপ দিল। এক বালা কৃত্রিম শ্বাস করানোর পাম্প মেশিন এনে মুখে লাগিয়ে ৩/৪ বার চাপ দিলেন। কিন্তু ৩৭,০০০ ফুট উঁচুতে, মাইনাস ৫২ ডিগ্রি তাপমাত্রায় প্রশান্ত মহাসাগরের অন্ধকার আকাশে "জন হেলিয়েট" নামের আইরিশ হাসিখুশির মানুষটি অনাত্মিয় পরিবেশে সম্ভবত আমার বুকের উপর থাকাকালীনই মারা গেলেন। হাজারো যোজন দূরের সুন্দর সোনালি দাঁড়ির এক অপরিচিত পুরুষ এক আদিম এশিয় দ্রাবিঢ় মানুষের বুকে মৃত্যুবরণ করলো, যা এখনো আমায় বিস্মিত, ব্যথিত আর প্রকৃতির অমোঘ বিধানে তিরস্কার করে সর্বক্ষণ।

২ সিটের মাঝে ফ্লোরে শুইয়ে একটা চাঁদর দিয়ে হেলিয়েটকে ঢেকে রাখা হলো। আমাকে সরিয়ে নেয়া হলো তার থেকে সবচেয়ে দুরের সিটটিতে। পুরো বিমানের গানবাজনার ধ্বনি সব স্থিমিত হলে গেল। যাত্রীরা অন্ধকার আকাশে কেবল সময় গুণতে থাকলো, কখন ভোর হবে আর কখন এ লাশ নিয়ে বিমানটি নামবে তাইপে এয়ারপোর্টে। 

সূর্য ওঠার আগেই আমাদের বিমান সুচারুভাবে ল্যান্ড করে তাইপে পোর্টে। যাত্রীরা নামার আগেই হেলিয়েটকে স্ট্রেচারে নামানো হয় সবার আগে সাথে তার মালপত্র। আমি দ্রুত বের হয়ে আমার একদিনের সহযাত্রীবন্ধু হেলিয়েটের ফিঁয়ান্সে ক্যানিথকে ফোন দিতে তার নেমকার্ড বের করি। স্কটল্যান্ডে সরাসরি ফোন করি ক্যানিথকে। নারীকণ্ঠে হ্যালো বলে ক্যানিথ কিন্ত বিস্ময়করভাবে আমার গলা দিয়ে কোন শব্দই বের হয়না। মাত্র কয়েকঘন্টার জার্নিতে আমার ভালোবাসার সেলাইমেশিনে বুনেছে অনেক বুনন। এ বন্ধুত্বের নকশিকাঁথায় এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিল হেলিয়েটের জন্যে আমার ভালবাসা। সৃষ্টি-অবসাদ-মৃত্যু আর নিঃসঙ্গতা সব একাকার করে আমার বাক রুদ্ধ হয়েই রইলো, শত চেষ্টা করেও আমি ক্যানিথকে হেলিয়েটের আমাকে বুকে ঢলে পরে মৃত্যুুুর খবরটা দিতে পারলাম না। 

সম্প্রতি গ্রামে গিয়ে এক রাতে স্বপ্নে হেলিয়েটকে দেখি আমি, সোনালি দাড়ির হেলিয়েট। দেখি অরণ্যের মাদকতায় ঝরে পড়া শব্দফুলে হেলিয়েটের স্মৃতি। ঘুম ভাঙলে স্বপ্নেরা উড়ে যায়, তখন জীবনের নিরর্থকতা প্রেমহীনতায় পরিণত হয়ে শব্দভুখ পাখি হয়ে আমাকে মহাকাশে ওড়াতে থাকে। সেখানে ক্যানিথরা বাঙালি লললার রূপে নদীতীরে দৌঁড়ে বেড়ায়। এরা সবাই ক্যানিথ কিংবা বাঙালি কষ্ট লালিত রমণি হয়ে একাকার করে আমায় আর আমার পথ চলার স্মৃতিগুলোকে।



লেখাটি ফেসবুকে দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যান প্লিজ 



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন